উপরের লিংকটির লেখায় একটি অংশে আমি উল্লেখ করেছিলাম “অর্গানিক ফুড এমন প্রক্রিয়ায় উৎপাদন করতে হয় যেখানে রাসায়নিক বা কৃত্রিম সার ও কীটনাশক, ফুড এডিটিভস, বৃদ্ধিনিয়ন্ত্রক, ইরেডিয়েশন, জেনেটিক্যালি মডিফায়েড অর্গানিজম (জিএমও) পদ্ধতিতে বা এর মাধ্যমে উৎপাদিত পণ্য ব্যবহার করা হয় না।”
এদিকে ফসলের অধিক উৎপাদন নিশ্চিত করতে গেলে রাসায়নিক বা কৃত্রিম সার ও কীটনাশক ব্যবহার করতেই হয়। এই জটিল সমস্যার সমাধানে একদল বিজ্ঞানী দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করেছেন এবং একধরণের বায়ো-অর্গানিক সার উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছেন। এই সার ব্যবহারের মাধ্যমে ধান উৎপাদনে ৩০ ভাগ সিনথেটিক ইউরিয়া এবং ১০০ ভাগ ট্রিপল সুপার ফসফেট (টিএসপি) সফলতার সাথে প্রতিস্থাপন করা সম্ভবপর হয়েছে। গবেষণায় দেখা যায় বায়ো-অর্গানিক সার তৈরিতে বিজ্ঞানীরা কাঁচামাল হিসেবে আমাদের পরিচিত ও সহজলভ্য জৈব উপাদান (যেমন- রান্নাঘরের বৈর্জ্য, ধানের চিটা, গাছের বৃদ্ধিতে সহায়ক ব্যাকটেরিয়া ইত্যাদি) ব্যবহার করেছেন।
এক্ষেত্রে ৭৯% রান্নাঘরের বৈর্জ্য, ১৫% চিটা ধানের বায়োচার, ৫% রক ফসফেট এবং ১% ব্যাকটেরিয়ার সংমিশ্রণে এই বায়ো-অর্গানিক সারটি তৈরি করা হয়েছে। একদিকে কম খরচ অন্যদিকে পরিবেশ বান্ধব এই বায়ো-অর্গানিক সার প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমাদের ধান, সব্জি, ফলমূল ইত্যাদি খাদ্য উৎপাদন করার একটি দারুন সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। ২০১৭-২০২০ সাল পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন ভৌগলিক সীমানায় ১৮ জন কৃষকের খামারে প্রযুক্তিটি গবেষণাগার থেকে নিয়ে মাঠ পর্যায়ে ট্রায়াল দেয়া হয়েছে। ট্রায়ালের ফলাফল অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক হওয়াতে ইতিমধ্যে প্রাইভেট কোম্পানির সাথে চুক্তির আওতায় বানিজ্যিকভাবে উৎপাদনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে সফলতার সাথে বায়ো-অর্গানিক সারের বানিজ্যিক উৎপাদনের মাধ্যমে কৃষকদের নিকট সহজলভ্য করতে পারলে রাসায়নিক ইউরিয়া সারের উপর আমাদের নির্ভরতা কমবে, মাটির স্বাস্থ্য উন্নয়ন ঘটবে এবং অর্গানিক খাদ্য উৎপাদনে নব দিগন্তের সূচনা হবে।
অন্যদিকে আমাদের দেশের ৮৩% চাষের জমির মাটিতে প্রয়োজনীয় জৈব উপাদানের ঘাটতি রয়েছে। মাটির স্বাস্থ্য রক্ষায় সিনথেটিক সারের ব্যবহার কমানোর বিষয়ে কৃষির সাথে যুক্ত সকল প্রতিষ্ঠান অনেকগুলো কাজ করছে। সে কারনে সাধারণ চাষীদের মাঝেও জমিতে রাসায়নিক সার ব্যবহার কমানোর প্রতি আগ্রহ বেড়েছে, কিন্তু উল্লেখযোগ্য বিকল্প না থাকায় তাঁরা বাধ্য হয়ে অধিক ফসল উৎপাদনের লক্ষ্যে যুগের পর যুগ সিনথেটিক সার ব্যবহার করে আসছেন। বায়ো-অর্গানিক সারের বানিজ্যিক উৎপাদনের মাধ্যমে কৃষকের হাতে হাতে পৌঁছে দিতে হবে বিজ্ঞানীদের দীর্ঘ গবেষণার ফসল।
এক গবেষণায় দেখা গেছে একটি পরিবারের রান্নাঘর থেকে দৈনিক ০.৫৬ কিলোগ্রাম জৈব বর্জ্য পাওয়া যায়। ঢাকা শহর থেকেই প্রতিদিন ৫৮০০ টন নির্ভেজাল জৈব বর্জ্য সংগ্রহ করা সম্ভব এর মধ্যে ৮০ ভাগই বর্জ্যই বায়ো-অর্গানিক সার উৎপাদনে কাজে লাগানো সম্ভব। এভাবে বিভিন্ন বর্জ্য উপাদানের পূনঃচক্রায়নের মাধ্যমে আমরা অর্থ সাশ্রয় করার পাশাপাশি কৃষি সেকটরে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ছড়িয়ে দিতে পারি।
বায়ো-অর্গানিক সার প্রস্তুতির আর একটি উল্লেখযোগ্য অবদান হলো এখানে গাছের বৃদ্ধিতে সহায়ক ব্যাকটেরিয়া ব্যবহার করা হয়েছে। কৃষিখাতে বায়োটেকনোলজির এজাতীয় সমন্বয় ঘটানো খুবই জরুরি কারন আমাদের অজান্তেই আমাদের মাটিতে বা পরিবেশে প্রচুর উপকারী ব্যাকটেরিয়া রয়েছে। দিনের পর দিন জমিতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের ফলে এসব উপকারী অনুজীব ধ্বংসপ্রাপ্ত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। প্রাকৃতিক এই অনুজীবগুলো বাছাই করে উন্নত কৃষি প্রযুক্তির সাথে যুক্ত করতে পারলেই এরা মাটির স্বাস্থ্য উন্নয়নে মূল্যবান ভূমিকা রাখতে পারবে।
আমাদের চাহিদা নিরাপদ খাদ্য পাওয়া। খাদ্যকে নিরাপদ করতে হলে ফসল উৎপাদন ব্যবস্থাপনায় আমূল পরিবর্তন আনা আবশ্যক। দেশ এখন কৃষি ফসল উৎপাদনে উদ্বৃত্ত কিন্তু নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের নিরিখে যোজন যোজন পিছিয়ে আছে। এ কারনে “Bio-Organic Fertilizer: A Green Technology to Reduce Synthetic Nitrogen and Phosphorus Fertilizer for Rice Production” এর সাথে সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীদের মত সারা দেশের কৃষির উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও গবেষণা কেন্দ্রকে নানা ধরণের গবেষণা অব্যাহত রাখতে হবে। অন্যথায় টেকসই নিরাপদ খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থাপনা দূর্বল হিসেবে থাকলে মাটির স্বাস্থ্য ধবংস হবার সাথে সাথে আমাদেরও স্বাস্থ্য পড়বে চরম হুমকির মুখে। আমরা সেই চরম সর্বনাশা অবস্থা থেকে চির মুক্তি চাই।
পল্লব খন্দকার, ১৪ নভেম্বর ২০২৩।
mazhabkh93@gmail.com
Leave a Reply