পানির অপর নাম জীবন। পানি ছাড়া যেমন মানুষ এবং জীবকূলের প্রাণ রক্ষা হয় না তেমনি পানি ছাড়া গাছেরও জীবন বাঁচে না। কৃষি কাজের জন্য তাই পানি অপরিহার্য। চাষাবাদের জন্য মাটিতে রস থাকতে হয়, মাটির পানি ধারন ক্ষমতা থাকতে হয়। তাহলেই মাটিতে বিদ্যমান কিংবা প্রয়োগকৃত পুষ্টি গাছ গ্রহন করতে পারে। মাঠ ফসল, উদ্যান ফসল, মৎস্য চাষ, প্রাণী সম্পদ লালন-পালন কোন কৃষি কার্যক্রমই পানি ছাড়া সম্ভব হয় না। তাই চাষাবাদের জন্য পানি অত্যন্ত মূল্যবান একটি সম্পদ। আরো উল্লেখ্য যে, চাষে ব্যবহৃত হয় মূলতঃ লবনমুক্ত মিঠা পানি তাই বাস্তবতা হচ্ছে এ সম্পদ খুবই সীমিত।
আমাদের পৃথিবীর উপরিভাগের ৪ ভাগের ৩ ভাগই পানি আর মাত্র ১ ভাগ জমি। অর্থাৎ পৃথিবীর উপরিভাগের প্রায় ৭১ শতাংশ পানি দিয়ে ঢাকা ও বাকি মাত্র ২৯ শতাংশ স্থলভাগ। আর তাইতো সহজ কোন বিষয় বুঝাতে আমরা সব সময় বলে ফেলি ‘ বিষয়টা পানির মত সহজ’। আসলে পানি মোটেও ততটা সহজ এবং সস্তা না যতটা আমরা মনে করি। বিবিসির পরিবেশবিষয়ক প্রতিবেদক অ্যালেক্স কারবির বেশ কয়েকটি গবেষণামূলক প্রতিবেদন থেকে আমরা জানতে পারি পৃথিবীর উপরিভাগে যে পরিমাণ পানি রয়েছে তার মাত্র ২.৫ শতাংশ পানি লবণমুক্ত অর্থাৎ পান করার উপযোগী। পানযোগ্য এই সামান্য পরিমাণ পানির দুই-তৃতীয়াংশ আবার মানুষের নাগালের বাইরে জমাট বরফ অবস্থায় রয়েছে। বাকি থাকল যে এক-তৃতীংয়াংশ, তার ২০ শতাংশ আবার জনবসতি থেকে এতটাই দূরে যে বলা যায় মানুষের পক্ষে সে পানি ব্যবহার করা প্রায় অসম্ভব। তাহলে এটা পরিষ্কার যে পৃথিবীতে যত পানি রয়েছে তার ০.০৮ শতাংশেরও কম পরিমাণ পানি মানুষের ব্যবহারের আওতায় আছে। তাই পানিকে যত সহজ এবং সস্তা মনে করা হয় মোটেও কিন্তু তা নয়।
০৯ অক্টোবর ২০২৩ এ দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, জাতিসংঘের ২৩টি সংস্থার দেওয়া তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে ইউনেসকো (UNESCO) ভিত্তিক ওয়ার্ল্ড ওয়াটার অ্যাসেসমেন্ট প্রোগ্রাম (WWAP) বলছে, লবণমুক্ত যতটুকু পানি বিশ্ববাসীর হাতে রয়েছে, তার ৭০ শতাংশ পানি ব্যবহার হয় কৃষিকাজে। বাকি ৩০ ভাগ দিয়ে খাওয়া, শিল্প-কারখানার কাজ চালানো ও অন্যান্য প্রয়োজন মেটানো হয়।
এটা ঠিক যে এক সময় পানি নিয়ে আমাদের কৃষকদের তেমন ভাবনা ছিলোনা। নদীর নাব্যতা ছিল, খাল-বিলে পানি ছিল। সেচের জন্য সময়মত পানি পাওয়ায় চাষাবাদে সমস্যাও তেমন হতো না, খরচও হতো অনেক কম। কিন্তু নানান কারনে চাষাবাদের জন্য পানি এখন আর সহজলভ্য নেই। ২০১৩ সালে আমাদের সরকার পানি আইন তৈরী এবং গ্রহন করেছেন। সে পানি আইনে আমাদের পানির উৎস্য তিনটি বৃষ্টির পানি, ভূ-উপরিস্থ পানি (Surface water) ও ভূ-গর্ভস্থ পানি (Ground water)। ভূ-উপরিস্থ পানি আমাদের বেশি প্রয়োজন যা আমরা পাই না। কারন আমাদের নদী-নালা-খাল-বিল তলানী এবং পলি জমে ভরাট হয়ে গেছে। অনেক খালে কোন পানি প্রবাহই নেই। তাই ভূ-উ্পরিস্থ পানির ভীষণ রকম একটা ঘাটতি আছে আমাদের। নদী-নালা-খাল-বিল ভরাট হওয়ার পাশাপাশি ভূ-উ্পরিস্থ পানি ঘাটটি প্রধান নদীগুলোর উৎসের উপরও নির্ভর করে। আমাদের দেশের প্রধান নদী গুলোর উৎপত্তিস্থল দেশের বাইরে হওয়ায়এসব নদী গুলোর শতকরা ৯৫.৫ ভাগই দেশের বাইরে ফলে স্বাভাবিক পানি প্রবাহে একটা অসঙ্গতির কারনেও পর্যাপ্ত পরিমাণ ভূ-উ্পরিস্থপানি পাওয়া যায় না।
আমদের দেশে বর্ষা মৌসুমে অনেক পানি আসে। পানি তখন বন্যা আতঙ্ক তৈরী করে। আবার শুস্ক মৌসুমে প্রয়োজনের সময় পানিই পাওয়া যায় না। কৃষকরা তাঁদের জমিতে সেচ দিতে পারে না। রবি মৌসুমে আমাদের উত্তরাঞ্চলে পানির অভাবে কৃষিকাজ দারুনভাবে ব্যহতহয়। আবার বর্ষা মৌসুমে বন্যায় ফসল ভেসে যায়। বার্ষিক বৃষ্টিপাত কম হওয়ার জন্য দক্ষিণ-পশ্চিম এবং উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে সবচেয়ে বেশী পানির অভাব দেখা যায়। শুষ্ক (রবি) মৌসুম বা শীতকালে অর্থাৎ নভেম্বর-মার্চ মাসে খুব কম বৃষ্টিপাতের কারনে সেচের পানির ভীষণ অভাব দেখা দেয়। অন্যদিকে বার্ষিক বৃষ্টিপাতের প্রায় শতকরা ৯৫ ভাগই হয় এপ্রিল-অক্টোবর মাসে। কিন্তু আমাদের বৃষ্টির পানি ধরে রাখার মত সুব্যবস্থা না থাকায় প্রয়োজনীয় পানির অভাবে শুষ্ক (রবি) মৌসুমে সেচযোগ্য কৃষি হুমকির মূখে পড়ে যায়।
যেহেতু প্রাপ্ত পানির বেশির ভাগই কৃষি কাজের জন্য ব্যবহার করা হয় তাই টেকসই কৃষির জন্য ভূ-উপরিস্থ ও ভূগর্ভস্থ পানির সঠিক ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
পানি ব্যবস্থাপনা নিয়ে লেখাটি চলমান থাকবে।
মোঃ মাকসুদুর রহমান
কৃষি উৎপাদন, সরবরাহ ব্যবস্থাপনা ও নিরাপদ খাদ্য বিষয়ক বিশেষজ্ঞ।
ই-মেইলঃ maksudurrahman1363@gmail.com
ভাই খুব সুন্দর লাগছে
ভাই আপনার লেখা যতই পড়ি ততই অবাক হই, খুবই তথ্যবহুল ও সমসাময়িক বিষয় গুলি আপনার লেখারমধ্যে খুজে পাই।