আতাউর রহমান মিটন ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয় ২০১২-১৩ সালের দিকে আমি তখন একটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থায় আঞ্চলিক সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করতাম। ইউএস এইড এর অর্থায়নে পরিচালিত আমাদের প্রকল্পের কাজটি ছিলো কৃষি ভিত্তিক কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা এনজিওকে আমেরিকা থেকে স্বেচ্ছাসেবী বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে সেবা প্রদান করা। আমেরিকা থেকে আসা দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ও উচ্চ দক্ষতা সম্পন্ন বিশেষজ্ঞগণ মূলত হাতে কলমে প্রশিক্ষণ দিয়ে কৃষক বা কৃষি উদ্যোক্তাদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন। কাজের সূত্র ধরেই মিটন ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ ও সাক্ষাতের সুযোগ ঘটেছে অনেকবার। বগুড়ার ছেলে মিটন ভাই সাধাসিধা গেট আপ সহ খুব সাধারণ একজন মানুষের মতো জীবনযাপন করেন কিন্তু আমার কাছে প্রথম দেখাতেই মনে হয়েছিলো এই সাধাসিধা মানুষটির ভিতরে লুকিয়ে আছেন একজন সুবিবেচক ও উচ্চ ধ্যানধারণায় সমৃদ্ধ বিশ্ব নাগরিক। দৈনিক প্রথম আলো সহ বেশ কিছু জাতীয় ও আঞ্চলিক পত্রপত্রিকায় তাঁর লেখাগুলো দেখলেই সহজে বোঝা যায় তিনি কতটা গভীর মানবিক বোধ সম্পন্ন একজন দেশপ্রেমী।
আমাকে মিটন ভাইয়ের সবচেয়ে যে দিকটি আকৃষ্ট করেছিলো সেটি অবশ্যই রাসায়নিক ও বিষমুক্ত কৃষি ফসল উৎপাদনের জন্য অক্লান্ত শ্রম প্রদান। ব্যর্থতার পরোয়া না করে অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে লেগে থেকে একটি এলাকাকে কেঁচো কম্পোষ্ট সারের ক্লাস্টার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। এই কাজটি করার জন্যই তিনি প্রত্যন্ত গ্রাম এলাকায় আমেরিকা থেকে আসা একজন স্বেচ্ছাসেবী বিশেষজ্ঞকে সাথে নিয়ে গ্রামের চাষীদের কেঁচো কম্পোষ্ট উৎপাদন প্রক্রিয়া শিখিয়েছিলেন। তাঁর সেই উদ্যোগ আজ কোন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে নীচের সংবাদটি দেখলে বোঝা যাবে-
“ঝিনাইদহ কালীগঞ্জ উপজেলার দাপনা গ্রাম এখন কেঁচো আর কম্পোস্ট সারের গ্রামে পরিণত হয়েছে। শতভাগ বাড়িতে এখন সার উৎপাদন হচ্ছে। গ্রামের ৬০ ঘর পরিবার এখন আর রাসায়নিক সার ব্যবহার করে না। নিজেদের উৎপাদিত পরিবেশ বান্ধব কম্পোস্ট সার দিয়েই জমিতে চাষাবাদ করছে। মাসে তারা ৫০ হাজার টাকার সার ও কেঁচো উৎপাদন করছে। নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে এখানকার কম্পোস্ট সার সৌদি আরব, দুবাইসহ মধ্যপ্রচ্যের বিভিন্ন দেশে রফতানি করা হচ্ছে। আর এই কাজটি যারা করছে তারা সবাই গৃহিনী। বাড়ির প্রয়োজনীয় কাজের শেষে তারা বাড়তি কাজ হিসেবে এই কাজটি করছে। এই কাজে তাদের সহযোগীতা করেছেন জাপান ভিত্তিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা হাঙ্গার ফ্রি ওয়ার্ল্ড ও উপজেলা কৃষি অফিস।
ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলা থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার পূর্বের গ্রাম দাপনা। এই গ্রামের নারীরা খুবই কর্মঠ। প্রত্যেকের বাড়িতেই ২ থেকে ৮টি পর্যন্ত গরু আছে। তারা তাদের গরুর গোবর কাজে লাগিয়ে সার তৈরি করছে। যে সার পরিবেশ বান্ধব। এই গ্রামে শতভাগ বাড়িতে কম্পোস্ট প্লান্ট বানাতে পরামর্শ সহযোগীতা দিয়ে সহযোগীতা করেছেন রেবেকা ও সোনাভান নামের দুই গৃহবধু। তারা প্রথম পর্যায়ে হাঙ্গার ফ্রি ওয়ার্ল্ডের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহযোগীতায় এই কাজ শুরু করেন। এর পর সারা গ্রামে ছড়িয়ে দেন এই কার্যক্রম। রেবেকার ঘরের মধ্যে, রান্নাঘরে, বারান্দায়, গোয়ালঘরে, বাড়ির পরিত্যক্ত জায়গায় কাচা, পাকা বেশ কয়েকটি কম্পোস্ট প্যাল্ট তৈরি করেছেন। প্রতি মাসে তিনি প্রায় ৪০০ কেজি কম্পোস্ট ও প্রায় ১০ কেজি কেচো উৎপাদন করছে। এক কেজি কম্পোস্ট সার ১০ টাকা আর এক কেজি কেচো ১৫০০-১৮০০ টাকায় বিক্রি করছেন।
একই গ্রামের কৃষানী আতিয়ারের স্ত্রী শাহনাজ, মশিয়ারের স্ত্রী সোনাভান,শওকতের স্ত্রী সুখজান, কুদ্দুসের স্ত্রী হাজেরা বেগম, জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইরিনসহ ৬০টি পরিবারের সকল গৃহিনীরা তাদের বাড়িতে কেউ মাটির রিং স্লাব, কেউ বা পাকা করে কম্পোস্ট প্লট তৈরি করেছে। প্রতি মাসেই তাদের প্লট থেকে সার উৎপাদন হচ্ছে। তারা উৎপাদিত কম্পোস্ট সার নিজেদের জমিতে ব্যবহার করে বাকিটুকু বিক্রি করছে। দেশের যশোর, চুয়াডাঙ্গা, সিরাজগঞ্জ, কুমিল্লার ব্যবসায়ীরা এখান থেকে ট্রাক ভরে সার ও কেঁচো ক্রয় করে নিয়ে গিয়ে পরে সেগুলো প্যাকেটিং করে মধ্যপ্রাচ্যের দুবাই, সৌদিআরবসহ বিভিন্ন দেশে বিক্রি করছে। কেচো কম্পোস্ট সার বিশেষ করে ধান, পান চাষী, সবজী জাতীয় চাষাবাদে বেশি উপকার পাচ্ছে।”
(সূত্র: এফএনএস-টিপু সুলতান; কালীগঞ্জ, ঝিনাইদহ, প্রকাশ: ৩১ মে, ২০১৯)
মিটন ভাইয়ের উদ্যোগে শুধুই কেঁচো কম্পোষ্ট সারই নয় জৈব বালাই নাশক উৎপাদন ও ব্যবহার করছে ঝিনাইদহ জেলার কালিগঞ্জ উপজেলার বেশ বড় একটি কৃষি ক্লাস্টারের প্রান্তিক কৃষকগণ। কৃষকদের মাঝে রাসায়নিক ও বিষমুক্ত কৃষি প্রযুক্তি হস্তান্তর ও সম্প্রসারণের জন্য মিটন ভাই জাপান ভিত্তিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা হাঙ্গার ফ্রি ওয়ার্ল্ড এর সহযোগিতায় প্রত্যন্ত গ্রামীন এলাকায় দুইটি আধুনিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (একটি বলিদাপাড়া গ্রামে আপরটি আগমুন্দিয়া গ্রামে) স্থাপন করেছেন। সেখানে শিশুদের থেকে শুরু করে সব বয়সীদের জৈব বা অর্গানিক কৃষির উৎপাদন পদ্ধতির উপর সারা বছর প্রশিক্ষণ প্রদান করা, তথ্য প্রদান করা ও ডকুমেন্টারি দেখানোর ব্যবস্থা রয়েছে। সম্প্রতি দেশের সর্ব উত্তরে অবস্থিত প্রত্যন্ত জেলা পঞ্চগড়ের বোদায় “বোদা সেন্টার ফর অর্গানিক ফার্ম” প্রতিষ্ঠিত করে নিরাপদ কৃষি ফসল উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনা করছেন।
এই জৈব কৃষি অন্তপ্রাণ মানুষটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একই বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন। এখানেই তাঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধা ও বিস্ময়ের মাত্রা ছাড়িয়ে যায়, তিনি কৃষিবিদ না হয়েও দেশের মানুষকে নিরাপদ কৃষি পণ্য উপহার দেবার জন্য দিনরাত চব্বিশ ঘন্টা ধ্যানজ্ঞান হিসেবে কিভাবে নিতে পেরেছেন? রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিষয়ের ছাত্র ছিলেন বিধায় দেশের মানুষের কল্যানের জন্য কেমন রাজনীতি প্রয়োজন সে বিষয়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তাঁর বাস্তবধর্মী লেখা আমাদের মুগ্ধ করে। অন্যদিকে নিরাপদ খাদ্য নিয়ে দেশে বিদেশে তিনি তাঁর লেখা ও কার্যক্রম নিয়ে সবসময় সোচ্চার থাকেন। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই তিনি বিসেফ ফাউন্ডেশন (BSAFE Foundation) এর ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাহী পরিষদে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন। https://www.bsafefoundation.org/excommittee.php
আমার দুঃখবোধের জায়গাটি হচ্ছে মিটন ভাইয়ের মতো আমরা সবাই যদি নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন আন্দোলনের সাথে লেগে থাকতে পারতাম তাহলে এই দেশের স্বাস্থ্য খাতের ব্যয় অর্ধেকে নেমে আসতে পারতো। রাসায়নিক ও কীটনাশক দিয়ে উৎপাদিত খাদ্য বাহিত বিভিন্ন জটিল রোগ বালাই হতে মানুষের মুক্তির জন্য মিটন ভাই যেনো একাই লড়ে যাচ্ছেন সীমিত সক্ষমতা কিন্তু অতুল প্রাণশক্তি নিয়ে। আমিও প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষ, আমার গ্রামটিতে এমন জৈব কৃষি প্রযুক্তির মাধ্যমে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের মহতী উদ্যোগ নেয়ার সুযোগ আছে। অথচ আমি বা আমরা তা করছি না? মিটন ভাই শত প্রতিকূলতা অতিক্রম করেও গভীর দেশপ্রেম থেকে মানুষের জন্য নিরাপদ জীবন উপভোগের ভিত্তি তৈরি করে চলেছেন। আমি সরেজমিন ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জের বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে দেখেছি তিনি কতটা কষ্ট করে সাধারণ চাষীদের বুঝিয়ে সুঝিয়ে এই নিরাপদ কৃষি প্রযুক্তির সম্প্রসারণ কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। এভাবে দেশের প্রতিটি গ্রামেই আমরা যদি মিটন ভাইয়ের মত নিরাপদ কৃষি প্রযুক্তি সম্প্রসারণে এগিয়ে আসতে পারতাম তাহলে আজ দেশে জটিল ক্যান্সার সহ বিভিন্ন দূরারগ্য ব্যাধির বিস্তার ঘটতে পারতো না। আমার খুব আফসোস হয়, আমি কেনো মিটন ভাইয়ের মতো হতে পারি না!
আমাদের সুস্থতার প্রথম শর্ত নিরাপদ খাদ্য গ্রহণ, গ্রামে গ্রামে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন ব্যতীত স্বাস্থ্যবান জাতি গঠনের অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জন করা অসম্ভব। মিটন ভাই অন্যান্যদের মতো নিজের নিরাপদ খাদ্য আন্দোলনকে শুধুমাত্র সেমিনার সিম্পোজিয়াম আর বক্তৃতা বিবৃতির মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে নিজেই প্রান্তিক কৃষকদের নিয়ে হাতে কলমে প্রয়োগের উদ্যোগ নিয়েছেন। এই কাজটি গত দুই আড়াই দশক ধরে তিনি নীরবে অব্যাহত রেখেছেন হাজারো পাওয়া না পাওয়ার সীমাবদ্ধতার মাঝে। তিনি এখানেই অন্যদের থেকে আলাদা, নিরাপদ কৃষি পণ্য উৎপাদন নিয়ে তাঁর অপরিসীম নিষ্ঠার কারনে এই জগতে তিনি সকলের অনুকরণীয় হয়ে উঠেছেন। এখন আমাদের দায়িত্ব মিটন ভাইয়ের পাশে থেকে তাঁর অসমাপ্ত কাজগুলোকে ত্বরান্বিত করতে সহযোগিতা করা। নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থাপনা উন্নয়নে তাঁর মহতী উদ্যোগগুলোকে সফল করতে আমরা সকলে উদারভাবে এগিয়ে আসি।
পল্লব খন্দকার, ১৭ অক্টোবর ২০২৩
mazhabkh93@gmail.com
Leave a Reply