ভূমিকা:
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান বিষয়ে (ফলিত রসায়ন) লেখাপড়া চলাকালীন কোন শিক্ষার্থীর মাথায় স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করে চাকুরির বাইরে আর কোন বিকল্প চিন্তা ঢুকতে পারে তা আমরা সাধারণত মনে করি না। এই ফিচারের লেখক খোন্দকার ফয়সাল আজম বাপ্পী এক্ষেত্রে সেই ব্যতিক্রম চিন্তার অধিকারী যিনি শিক্ষার্থী থাকা অবস্থাতেই নিরাপদ খাবারের নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের উদ্যোক্তা হিসেবে জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করবার সাহস দেখিয়েছেন। তাঁর প্রতিষ্ঠানের নাম “ডিইউ মার্ট”, এটির পণ্য সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে https://www.dumart.xyz/ ওয়েবসাইটে ঘুরে আসতে পারেন।
খোন্দকার ফয়সাল আজম বাপ্পী’র ভাষ্য:
আমার শৈশব ও কৈশোর কেটেছে প্রত্যন্ত গ্রামে। জেলা সদর থেকে আমার গ্রামের বাড়ি পঁচিশ কিমি দূরে। শহরেরর যান্ত্রিকতার একদম বাইরে। আমি আমার দাদাকে দেখিনি। শুনেছি দাদা দেখতে অনেকটা আমার মত লম্বা ও পাতলা ছিলেন। তবে শেষ বয়সে উনার মেরুদণ্ড বেঁকে গিয়েছিল। কোমর সোজা করতে না পারার পিছনে অন্যতম কারণ ছিল খেজুর গাছ কাটা। দাদা খোন্দকার আমির হোসেন ১২-১৪ বছর বয়স থেকে খেজুর গাছ কাটতেন। চিত্রা নদীর পাড় ঘেঁষে মাথা উঁচু করা প্রায় শ খানেক খেজুর গাছ উনি কাটতেন। বছরের পর বছর দিনে দুই বেলা করে গাছ কাটার কারণে উনি কোমরে যথেষ্ট শক্তি পেতেন না। ফলশ্রুতিতে সোজা হতে পারতেন না।
আমার স্কুল জীবনে দেখেছি এলাকায় ৮-১০ জন গাছি ছিল। যারা শীতের সিজন জুড়ে ৪০০-৫০০ গাছ কাটতেন। কিন্তু স্বল্প সময়ের ব্যবধানে এলাকা এখন গাছি শুন্য। ছোট বেলায় যারা গাছি ছিল তাদের দুই একজন এখন ৪-৫ টা গাছ কাটেন, বাকিরা সবাই বয়সের ভারে আর গাছ কাটতে পারেন না। এলাকায় একজন নতুন আর গাছিও তৈরি হয়নি। গাছির অভাবে এলাকায় এখন খেজুর গাছ তোলা যায়না। ফলে অধিকাংশ গৃহস্থ খেজুর গাছ কেটে ফেলেছেন। ফলশ্রুতিতে এখন গাছও নেই, গাছিও নেই।
কৃষি অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী প্রতিবছর ৩০ শতাংশ খেজুর গাছের সংখ্যা কমছে। বর্তমানে যে গাছ আছে সেগুলোর বয়স অনেক বেশি। ফলে প্রতি বছর অনেক গাছ মারা যাচ্ছে। কিছু গাছ ইট ভাটায় ইট পোড়ানোর কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। ইটভাটায় খেজুর গাছ পোড়ানো আইনত নিষিদ্ধ হওয়ার পরেও ইটভাটার মালিকরা সবকিছু ম্যানেজ করে ধ্বংস করে চলেছে খেঁজুর গাছ। গত কয়েক বছর ধরে ইটভাটার জ্বালানি হিসেবে খেজুর গাছকে ব্যবহার করায় বিভিন্ন এলাকা থেকে দ্রুত খেজুর গাছ ফুরিয়ে যেতে শুরু করেছে। ফলে গ্রাম ও শহরের মানুষ এখন খেজুর রসের মজার মজার খাবারের স্বাদ অনেকটাই হারাতে বসেছে।
“ডিইউ মার্ট” ব্যবসা শুরুর পর থেকেই খেজুর গুড়ের মত ঐতিহ্যবাহী পণ্যকে টিকিয়ে রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা করছে। বিভিন্ন এলাকায় নতুন করে খেজুর গাছ রোপণ করেছে। পাশাপাশি প্রান্তিক পর্যায়ের গাছিদের যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে খেজুর গুড় উৎপাদন করে আসছে। বর্তমানে ডিইউ মার্টের তিনটা চুক্তিবদ্ধ খেজুর বাগান আছে। যেখানে প্রায় ৫০০-৭০০ খেজুর গাছ রয়েছে। ৮-১০ জন গাছি সরাসরি বাগান তিনটি পরিচর্যা করছেন। আমরা নিজেদের খেজুর বাগান থেকে সম্পূর্ণ ভেজালমুক্ত নিরাপদ খেজুরের রস ও গুড় বাজারজাত করছি। গুড়ের গুনগত মান নিশ্চিত করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বিসিএসআইআর থেকে পরীক্ষা করে গুণগত মান যাচাই করা হচ্ছে।
আমাদের গুড়ের পর্যাপ্ত চাহিদা থাকা সত্ত্বেও আমরা গ্রাহকের কাছে যথেষ্ট পরিমাণ খেজুর গুড় সরবরাহ করতে পারছিনা। দেশে ও বিদেশে খেজুর রস ও এর গুড়ের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। পরিকল্পিত উপায়ে এর উৎপাদন বাড়াতে পারলে গ্রামীণ জনপদের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে এটি ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারে। তাছাড়া, গ্রামীণ অর্থনীতিতে এর গুরুত্ব বিবেচনা করে সরকারি উদ্যোগে এর বাণিজ্যিক সম্প্রসারণ করা দরকার। যথাযথ পরিকল্পনা নিয়ে গাছিদের প্রশিক্ষণ দিয়ে ও দক্ষতা বৃদ্ধি করে এই সম্ভাবনাময় ব্যবসায় যুক্ত করতে পারলে কৃষির এই উপ-খাতটির মাধ্যমে দেশের জাতীয় অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখার পাশাপাশি বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মূদ্রাও অর্জন করা সম্ভব।
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় একসময় দেশের চাহিদা মিটিয়ে ইউরোপসহ বিশ্বের অনেক দেশে খেজুরের গুড় রফতানি হতো। “ডিইউ মার্ট” বিশ্বাস করে খেজুর গুড় রপ্তানি করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। পরিকল্পিত উপায়ে এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এ গাছের সংখ্যা বাড়ালে ও গাছিদের যথাযথ প্রশিক্ষণ প্রদান করা এবং পৃষ্ঠপোষকতা করা গেলে মৌসুমী এই খেজুর গুড়ের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা সম্ভব। আমাদের দাবী খেজুর গুড়ের ঐতিহ্য, অর্থনৈতিক গুরুত্ব ও বাণিজ্যিক সম্ভাবনাকে বিবেচনা করে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে এই পণ্যটির ব্যাপক উৎপাদন পরিকল্পনা নেওয়া হোক।
উদ্যোক্তা, ডিইউ মার্ট
dumart.xyz@gmail.com
যোগাযোগ: 01567-905199
সংকলন: দৈনিক আলোকবর্তিকা।
Leave a Reply