এখন থেকে চল্লিশ বছর আগে মায়ের হাত ধরে গ্রামের পাড়া মহল্লার পরিচিত মানুষ বা আত্মীয় বাড়িতে বেড়াতে গেলে নাস্তার মেনুতে মুড়ি চানাচুর বিস্কিটের সাথে একটা ডিম পোঁচ ছিলো অবধারিত। সেসব দিনে আমাদের বাড়িতেও আত্মীয় স্বজন কেউ বেড়াতে এলে নাস্তার সাথে ডিম পোঁচ দেয়ার প্রচলন ছিল। সে সকল ডিমের উৎস্য ছিল নিজেদের বাড়িতে পালন করা দেশি জাতের মুরগি। মুরগিগুলো বছরে দুই তিনবার ডিম দিতো, সেগুলোই গুছিয়ে রাখা হতো অতিথি আপ্যায়নের জন্য। অবশ্য পনেরো কুড়িটা ডিম জমানো হতো বাচ্চা ফুটানোর জন্য, বাকিগুলো উৎসবের দিনে অর্থাৎ আত্মীয় স্বজন বাড়িতে এলে রান্না হতো। হাঁটের দিন ছাড়া গ্রামের বাজারের দোকানে ডিম মিলতো না, অনেক সময় বাড়িতে পর্যাপ্ত ডিম না থাকলে পাড়ার আর কারো বাড়ি থেকে ধার করা বা কিনে এনে আত্মীয় আপ্যায়নের ব্যবস্থা করতে হতো। ডিমের আকার কিছুটা ছোট, সাদা রঙ হলেও ডিমের ভিতরে কুসুমের রঙ একদম কমলা। সেই সময়ের দেশি মুরগির ডিমের স্বাদ ছিলো ভীষণ মন ভুলানো, সপ্তাহে একটা ডিমও খাবার সুযোগ পেতাম কিনা সন্দেহ, তাই বাড়িতে যেকোন উপলক্ষে ডিম রান্না হওয়া মানে আমাদের জন্য তা উৎসব।
আমাদের গ্রামের বাড়ির মোরগ মুরগির ঘর বলতে বাঁশের তৈরি খুপরি বা খোপ। সেখানে দৈনিক সন্ধ্যায় বাড়ির চারিদিকে চরে বেড়ানো মোরগ মুরগিগুলো নির্দিষ্ট খোপের ভিতরে ঢুঁকে যেতো। গাদাগাদি করে সারারাত সেই খোপের ভিতরেই হাঁস মুরগি মিলেমিশে রাত কাঁটিয়ে ভোর সকালে মোরগের ডাকে ঘুম ভাঙ্গতো আমাদের। একটু রোদ বের হলে খুপরির ছোট দরজাটা খুলে দেয়া হলে হইচই করে আটকা থেকে বের হয়ে প্রথমেই ডানা ঝাঁপটানো, খুনসুটি এবং মলমূত্র বা বিষ্টা ত্যাগ করে খাবারের জন্য অপেক্ষা বা আশেপাশে খুঁটে খেতে বের হয়ে পড়তো। বোঝাই যায় আমরা সারারাত ধরে অনেকটা বেশি ঘনত্বে আঁটকে রাখাটা তাদের জন্য আরামদায়ক হতো না। সেকারনেই হয়তো ডিম ও মাংস উৎপাদন পর্যাপ্ত পরিমাণ পেতাম না আমরা, অবশ্য সেসব নিয়ে কোন হিসাবও আমাদের ছিলো না। শুধুমাত্র কিছু নির্দিষ্ট মৌসুমে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে মুরগি মরে যেত, কখনো কখনো ছোঁয়াচে রোগে একই খোপে থাকা সকল মুরগিই মরে যেতো!
সকালে খোপের দরজা খুলে দিয়ে সব মোরগ মুরগি বের হয়ে গেলে খুঁজে দেখা হতো খোপের ভিতরে কোন ডিম পড়ে আছে কিনা? ডিম দেয়া মুরগিগুলো রাতেই ডিম দিতো বেশিরভাগ সময়, দুই একটা মুরগি আবার দিনে ঝোপ ঝাড়ের মধ্যে অথবা আমাদের বসবাসের ঘরে সুবিধাজনক জায়গায় গিয়ে ডিম পাড়তো। আসলে রাতে খোপের গাদাগাদির মধ্যে ডিম দেয়াটাও রিস্কি ছিলো মুরগির জন্য, কারন আমরা জানি ডিম পাড়ার সময় সেগুলোর খোলস বেশ নরম থাকে, চাপ লাগলে ভেঙ্গে যেতে পারে বা আকৃতি পরিবর্তন হতে পারে। আমি এমনও দেখেছি মুরগির ঘর থেকে বের হয়ে দৌড়ে গিয়ে ফাঁকা জায়গায় বসে ডিম পেড়েছে মুরগি। এ থেকেই বোঝা যেতো বাধ্য নাহলে গাদাগাদি করে থাকা পরিবেশের মধ্যে ডিম দেয়া তাদের পছন্দ ছিলো না। সকালে ডিম যখন সংগ্রহ করা হতো সেগুলোর গায়ে লেগে থাকতো মুরগির বিষ্টা সহ বিভিন্ন ময়লা, তেমন কোন পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করার ব্যবস্থা নেয়া ছাড়াই সেই ময়লা বিষ্টা সহ সেগুলোকে সংরক্ষণ করা হতো। নিঃসন্দেহে সেই ময়লাযুক্ত ডিমকে আমরা কোনভাবেই নিরাপদ বলতে পারি না। সেইসব ময়লাযুক্ত ডিম বা নিরাপদ ডিম নিয়ে মানুষের তেমন কোন দুঃশ্চিন্তা কারো ছিলো না বা অনিরাপদ ডিম খেয়ে স্বাস্থ্য ঝুঁকির বিষয়ে কারো সচেতনতাও ছিলো না।
চল্লিশ বছর পর আমরা এখন দেশি মুরগির ডিম সেভাবে দেখতে পাই না। কিছু পরিমাণ পাওয়া গেলেও দাম প্রচলিত লেয়ার মুরগির ডিমের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ। এর কারন বেসরকারি উদ্যোক্তাদের আপ্রাণ চেষ্টায় ও প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে দেশের আবহাওয়া উপযোগী লেয়ার হাঁস-মুরগির জাত উন্নয়ন, গ্র্যান্ড প্যারেন্ট স্টক ও প্যারেন্ট স্টক খামার স্থাপন, বাণিজ্যিক খামার সম্প্রসারণ এবং মানসম্মত পোল্ট্রি খাদ্য উৎপাদনে বিনিয়োগের ফলে ডিম উৎপাদনে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ডিমের উৎপাদন ছিল ২৩৩৭.৬৩ কোটি, যা ২০১০-২০১১ অর্থবছরের উৎপাদনের (৬০৭.৮৫ কোটি) তুলনায় ৩.৫ গুণ বৃদ্ধি পাওয়ায় বর্তমানে ডিমের জনপ্রতি প্রাপ্যতা ১৩৪.৫৮ টি/বছর এ উন্নীত হয়েছে। এই লেয়ার মুরগির ডিমের প্রাচুর্যের মাঝে হারিয়ে যেতে বসেছে দেশি মুরগির ডিম ও তার চমৎকার স্বাদ। এখন দেশি মুরগির দাম বেশি বিধায় সোনালী জাতের মুরগির ডিমকে নকল দেশি ডিম হিসেবেও ব্যবহার করে অসাধু ব্যবসায়ীরা।
কথা হলো আজকের এই আধুনিক যুগে বানিজ্যিক ভিত্তিতে উৎপাদিত ডিমের সরবরাহ ব্যবস্থাপনা আমাদের কি নিরাপদ ডিম নিশ্চিত করতে পারছে? আমরা কি দেখি? যুগের পর যুগ বাজারে কিভাবে ডিম বিক্রি হয়? এই চল্লিশ বছর পরে এখনো আমরা দেখি খামার থেকে কোন ধরনের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ছাড়াই খোলা বাজারে ডিম আসে। এখনো ডিমের গায়ে বিষ্টা বা ময়লা লেগে থাকে, সে অবস্থাতেই আমরা কিনে আনি ও বাসায় সংরক্ষণ করি এবং পরিষ্কার না করেই খোলস ভেঙ্গে অমলেট বা পোঁচ করি। এটাই আমাদের ডিম খাওয়ার সংষ্কৃতি, আমরা ডিমের গায়ে নোংরা ময়লা বা ক্ষতিকারক জীবাণু আছে কিনা সেটি বিবেচনা করি না। এই অসচেতনতা থেকে যে খাদ্যে বিষক্রিয়া হয়ে আমাদের মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে পারে সেই সচেতনতার কোন লক্ষণ আমরা দেখতে পাই না। যদিও সুখের বিষয় এখনকার দিনে কিছু কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান নিরাপদ ডিমের বিজ্ঞাপন দিয়ে প্যাকেটজাত করে ডিম বিক্রি করছে। স্বাভাবিকভাবে সেগুলোর মূল্য খোলা বাজারের ডিমের চেয়ে বেশি, সাধারণ ক্রেতাদের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে।
ডিমের খোলসে ময়লা আবর্জনা থাকলে ক্ষতি কি? এই নোংরা ডিমে থাকতে পারে স্যালমোনেলা নামে এক ভয়ঙ্কর ব্যাকটেরিয়া, এই ব্যাকটেরিয়া সারা পৃথিবীতে খাদ্যে বিষক্রিয়া ঘটানোর জন্য এক নম্বর এজেন্ট! এই মারাত্মক জীবানুটির সংক্রমণে আমাদের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে, অথচ ডিমের খোলসের ময়লা আবর্জনা নিয়ে আমাদের মধ্যে বিন্দুমাত্র উদ্বেগ উৎকণ্ঠা কাজ করে না। ডিম আমাদের সকলের কাছে বিশেষ করে শিশুদের কাছে খুবই জনপ্রিয় আমিষের উৎস্য। তাই ডিম খাওয়ার আগে আমাদের নিশ্চিত হওয়া উচিত সেটি স্যালমোনেলা বা অন্য কোন ক্ষতিকারক রোগ জীবাণু মুক্ত কিনা? অন্যথায় আমাদের অসচেতনতায় ঘটতে পারে করুন ট্রাজেডি, এক্ষেত্রে খোলা বাজার থেকে ডিম ক্রয়ের পর বাড়িতে এনেই পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুয়ে সংরক্ষণ করার অভ্যাস গড়ে তোলা জরুরী।
পল্লব খন্দকার, ৭ নভেম্বর ২০২৩
mazhabkh93@gmail.com