— আতাউর রহমান মিটন
সহ-সভাপতি, বিসেফ ফাউন্ডেশন।
প্রথম পর্ব:
একদিকে যুদ্ধের দামামায় শঙ্কিত মানবতা, অন্যদিকে জলবায়ূ পরিবর্তনজনিত প্রভাবে খাদ্য উৎপাদনে ঝুঁকি বৃদ্ধি বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনাকে শঙ্কার মধ্যে ফেলেছে। বাংলাদেশে কৃষিতে নিয়োজিত শ্রমশক্তি কমছে। এমতাবস্থায়, অল্প জমিতে এবং কম সময়ে অধিকতর খাদ্য উৎপাদনের চাহিদা বা তাগিদ বাড়ছেই। খাদ্য বিজ্ঞানীদের মতে, খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়ায় মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার, কীটনাশক, এবং অপ্রাকৃতিক উপায়ের অধিকতর ব্যবহার, ইত্যাদির ফলে খাদের নিরাপদতা ঝুঁকি বাড়ছে। পাশাপাশি কমছে খাদ্যের পুষ্টিমানও। ফলে সরকারের কৃষি, মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ খাতের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের পাশাপাশি সচেতন নাগরিক সমাজেও উদ্বেগ—উৎকণ্ঠা বাড়ছে। সরকার নিরাপদ ও পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্যের নিশ্চয়তা বিধানকে ‘বিশেষ অগ্রাধিকার’ বলছে বটে কিন্তু আমরা সকলেই জানি খাদ্যের নিরাপদতা ও পুষ্টিমান নিশ্চিত করতে হলে সরকারের সাথে সাথে ব্যক্তি, পরিবার ও সামাজিক পরিসরে সচেতন উদ্যোগ প্রয়োজন। সকলকে সম্পৃক্ত করতে হবে, দায়িত্ব নিতে হবে সকলকেই। আমার প্রত্যাশা মানবসেবার মহান ব্রতে উজ্জীবিত রোটারিয়ানগণ হবেন “রোল মডেল”।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫ (ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সকল নাগরিকের খাদ্যের মৌলিক চাহিদা পূরণের ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের অন্যতম ‘মৌলিক দায়িত্ব’। সরকার এই দায়িত্ব পালনে অঙ্গীকারাবদ্ধ। সরকারের সেই অঙ্গীকারের ফলেই ২০১৩ সালে গঠিত হয়েছে নিরাপদ খাদ্য আইন এবং এই আইনের আওতায় গঠিত হয়েছে ‘নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। উৎপাদন থেকে শুরু করে খাবার প্লেট পর্যন্ত বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতির যথাযথ অনুশীলনের মাধ্যমে নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্তি নিশ্চিতে সমন্বয়ের ভিত্তিতে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সরকার তার লক্ষ্য ব্যক্ত করেছে। কিন্তু মানুষের মধ্যে এখনও নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্তির নিশ্চয়তা এখনও ‘অধরা আকাঙ্খা’ হয়েই রয়েছে। কেন খাদ্য নিরাপদতার নিশ্চয়তা এতটা কঠিন? কেন সরকার সদিচ্ছা থাকা সত্বেও নিরাপদ খাদ্যের সহজ প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে পারছে না? আমার মতে, প্রথমতঃ সরকার একা এটা করতে পারবে না। নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার জন্য ব্যক্তিগত সচেতনতা ও উদ্যোগ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি খাদ্য ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত প্রায় ২৫ লক্ষ ব্যক্তি ও ১৮টি মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয় সাধন করাটা এখনও অনেক বড় একটা চ্যালেঞ্জ। তবে এটি অসম্ভব নয়।
সরকার অনেক ক্ষেত্রেই ‘মেগা প্রকল্প’ বাস্তবায়ন করে দেখিয়ে দিয়েছে সত্যিকারের সদিচ্ছা থাকলে অনেক ‘অধরা’ হাতের মুঠোয় চলে আসে। জনস্বাস্থ্যকে অগ্রাধিকার দিয়ে দেশের সকল মানুষের জন্য নিরাপদ ও পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্যের নিশ্চয়তা বিধানে যথাযথ বিনিয়োগ দরকার। প্রাথমিকভাবে কেবলমাত্র সারাদেশের হোটেল—রেঁস্তোরায় কর্মরত সেবদানকারীদের মধ্যে নিরাপদ খাদ্য সম্পর্কিত প্রশিক্ষণ প্রদান এবং অবকাঠামোগত সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। কাজটি কঠিন কিন্তু শুরু করতে হবে। সবার চিন্তা ও পরামর্শগুলোকে সমন্বিত করে এ লক্ষ্যে একটি বাস্তবানুগ কর্মকৌশল নির্ধারণ করার জন্য নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে জোর দাবী তুলতে হবে। আমি মনে করিয়ে দিতে চাই যে, ২০০৯—২০১২ সাল পর্যন্ত দেশের গণমাধ্যমে খাদ্যে ভেজাল ও দূষণ বিষয়ে অনেক সচিত্র প্রতিবেদন প্রচারের ফলে জনস্বার্থে ২০১৩ সালে নিরাপদ খাদ্য আইন প্রণীত হয়েছে। বাচ্চা না কাঁদলে যেমন মা দুধ দেয় না, ঠিক তেমনি নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্যের জনদাবীকে গণমাধ্যমের সহায়তায় এমনভাবে তুলে ধরতে হবে যাতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ‘দিবানিদ্রা’ ভঙ্গ হয়! এটা সময়ের দাবী এবং সম্মানিত রোটারিয়ানগণ নিজ নিজ অবস্থান থেকে এ বিষয়ে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারেন।
খাবার নিরাপদ হবে, পুষ্টিসমৃদ্ধ হবে এটাই স্বাভাবিক। বাজারে বিক্রি হচ্ছে যে খাবার তার নিরাপদতা ও পুষ্টিমানের নিশ্চয়তা বিধানের দায়িত্ব সরকারের। পারিবারিক পর্যায়ে খাদ্যের নিরাপদতা ও পুষ্টিমান নিশ্চিত করার দায়িত্ব পরিবারের হলেও তাদেরকে সচেতন করাটা সরকারেরই দায়িত্ব। আমরা অনেকদিন থেকেই গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনিরাপদ ও মানবস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে এমন সব ‘জাঙ্ক ফুড’ এর বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ করার দাবী জানিয়ে আসছি। আমরা বিসেফ ফাউন্ডেশন থেকে ইতিবাচক তথা সচেতনতা বৃদ্ধিতে সহায়ক বিজ্ঞাপন বেশি বেশি প্রচারের দাবী করেছি। আমরা প্রস্তাব করেছি, ‘সকল স্তরে নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্য শিক্ষা’ বিস্তার করতে হবে। ধর্মীয় নেতা ও সমাজে প্রভাব সৃষ্টিকারী ব্যক্তিবর্গের সহায়তায় নিরাপদ খাদ্যের সচেতনতা বিস্তারে বছরব্যাপী (২৪/৭) কার্যক্রম থাকতে হবে। গণমাধ্যমে যেমন প্রতিদিন খেলা বা বিনোদন পাতা/অনুষ্ঠান থাকে ঠিক তেমনি নিরাপদ ও পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্য বিষয়ক পাতা/অনুষ্ঠান থাকা প্রয়োজন। এটা সরকারকেই নিশ্চিত করতে হবে। অনিরাপদ খাদ্যের বিজ্ঞাপন ও বিপণন নিয়ন্ত্রণ একটি কঠিন কাজ হলেও এটা করা সম্ভব। বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে গণমাধ্যমসহ সর্বস্তরে সিগারেট ও অন্যান্য তামাকজাত পণ্যের বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছে। এই দৃষ্টান্ত মনে রাখা দরকার।
সর্বস্তরে নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্যের নিশ্চয়তা বিধানে ভোক্তা পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ এখনও অতিথি আপ্যায়নে, প্রিয়জনদের সাথে সাক্ষাতের সময়, এমনকি আদর করে প্রিয় সোনামণিদের হাতে এমন সব খাবার (অখাদ্য?) তুলে দেন যা তাদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। এটা অব্যাহত রয়েছে কারণ মানুষ জানে না, চিপস, এনার্জি ড্রিঙ্কস, অতিরিক্ত চিনি, লবণ, তেল মিশ্রিত খাবার, ইত্যাদি কতখানি ক্ষতিকর। ‘সতেজ ও সবুজ খাবার স্বাস্থ্যের জন্য উপকারি’ এই ধারণাটি বেশি বেশি ছড়িয়ে দেয়া প্রয়োজন। এটা শুরু করতে হবে ব্যক্তিগত খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের মাধ্যমে অর্থাৎ ঘর থেকেই। মানুষের মধ্যে বাইরে খাওয়ার অভ্যাস বাড়ছে। বিশেষ করে শিশু—কিশোর—তরুণ—যুব প্রজন্মের মধ্যে ‘জাঙ্ক ফুড’ তথা অনিরাপদ, অস্বাস্থ্যকর এবং ক্ষতিকর উপাদান মিশ্রিত খাবার গ্রহণের প্রবণতা ভয়ঙ্করভাবে বিস্তৃত হচ্ছে। এসব খাবার গ্রহণের দীর্ঘমেয়াদী কুফল সম্পর্কে সচেতনতা এখনই তৈরী না হলে জনস্বাস্থ্য ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সেই ক্ষতি টাকা খরচ করেও পুষিয়ে নেয়া সম্ভব হবে না।
বাজারে অনিরাপদ খাদ্যের বিক্রি নিষিদ্ধ করতে হবে। এক্ষেত্রে ‘মানদন্ড বা ষ্টান্ডার্ড’ খুবই বড় একটি বিষয়। কারণ বাজারে এমন অনেক খাদ্যপণ্য পাওয়া যায় যা সরকারের নির্দিষ্ট বিভাগের সীলমোহর অঙ্কিত অথচ জনস্বাস্থ্য বিবেচনায় তা ঝুঁকিপূর্ণ। যেমন কোমল পানীয় বা এনার্জি ড্রিংকস্ এর কথাই যদি আমরা বিবেচনা করি তাহলে দেখবো যে, এই পণ্যগুলো সরকার কর্তৃক অনুমোদিত। কিন্তু এই পণ্যগুলো কি মানবদেহের জন্য নিরাপদ? চিকিৎসক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞগণ এ বিষয়ে কি বলেন? যদি নিরাপদ না হয় তাহলে তা বিক্রির অনুমোদন পাচ্ছে কিভাবে? আবার পথের ধারের খোলা খাবারের অবস্থাটা বিবেচনা করুন। কি পরিমাণ মানুষ প্রতিদিন এসব অস্বাস্থ্যকর খাবার খাচ্ছে? এটা দেখছে কে? এখানে নিরাপদতা নিশ্চিতের উদ্যোগ কোথায়? মিডিয়া নির্ভর ‘মোবাইল কোর্ট’ নয়, খাদ্যের নিরাপদতা নিশ্চিতে কঠোর অবস্থান নিশ্চিত করতে হবে। ভোক্তা যেন অভিযোগ করতে পারে এবং অভিযোগ করে প্রতিকার পায় সেটা নিশ্চিত করতে হবে।
লেখার উৎস্য: District Seminar on Safe & Nutritious Food 2023: What Rotarian can do? Organized by Rotary Club of Gulshan Lake City (18/11/2023).
সংকলন: দৈনিক আলোকবর্তিকা।
Leave a Reply