খাওয়ার সাথে সাথে অসুস্থ হয়ে পড়ি না বা মৃত্যু হয় না বলে বহুরকম খাবারই আমরা নির্ভাবনায় খেয়ে চলি। এই যেমন ধরুন আমাদের দেশের রাস্তার পাশের তৈরি জনপ্রিয় সব খাবারগুলো যেমন ঝালমুড়ি, সিংগাড়া, পুরি অথবা চটপটি বা ফুচকা। এই জাতীয় খাবারগুলো আমরা খুব পছন্দ করে খাই, অনেকেই নিয়মিত খেয়ে থাকি, অনেকে বেড়াতে বের হয়ে বা শখের বসে খাই। মুখরোচক এসব খাবার গ্রহণের আগে আমরা আগেপিছু কিছুই ভাবি না, অল্প সংখ্যক মানুষ আছেন যারা স্থান বা পরিবেশ নিয়ে ভাবেন, কিছু মানুষ আছেন খাবার পরিবেশনের পাত্র বা পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে সচেতন হন। তবে অধিকাংশ মানুষের এসব নিয়ে কোন উদ্বেগ বা উৎকণ্ঠা নেই কারন এগুলো খাবার পরপরই তারা কোন সমস্যা বোধ করেন না।
মানুষ যদি জানে এই পাত্রটিতে বিষ রয়েছে তাহলে আত্মহত্যার উদ্দেশ্য না থাকলে কেউ নিশ্চিত সেই বিষের পাত্রে আদর করে চুমুক দেবেন না। প্রকৃত পক্ষে আমরা সচারচার ভালোবেসে মুখরোচক যে সকল খাবার রেস্টুরেন্টে বা পথের ধার হতে খেয়ে থাকি সেগুলো ধীরলয়ের বিষ! ইংরেজিতে যাকে বলে স্লো পয়জনিং, এই স্লো পয়জনিং এর প্রভাবে বর্তমানে কিভাবে ক্যান্সার, কিডনি, হার্টের রোগের বিস্তার ঘটে চলেছে তা চোখের সামনেই দেখতে পারছি অহরহ। অবিশ্বাস্যভাবে ৩০ থেকে ৪০ বছর বয়সীদের হৃদরোগে মৃত্যুর হার বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে, এই ব্যাপারটি চরম উদ্বেগজনক হলেও ব্যক্তি ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বিষয়টি মোটেও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে স্থান পায়নি। আপনি স্লো পয়জনিং এর কবলে পড়ে একসময় জটিল শারীরিক সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে হাসপাতালে যাবেন, ঔষধ ও চিকিৎসা বাবদ বড় বিল ব্যয় করতে রাজী আছেন কিন্তু খাদ্যবাহিত দীর্ঘমেয়াদী জটিল স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে এক বিন্দুও ভাবতে চান না।
এখন কথা হলো আমরা সচেতন হয়ে লাভ কি? আমাদের দেশের মূল খাদ্য উপাদানগুলো যেভাবে উৎপাদন করা হয় সেই ব্যবস্থাপনার উপর কারো হাত নেই! এমনকি উৎপাদন পর্যায়ে নিরাপদ থাকলেও বাজারজাতকরণ প্রক্রিয়ায় ঢুকে খাদ্য চরম অনিরাপদ বেশি হয়। এর অন্যতম কারন আমাদের দেশের খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থাপনার শিকল অনেক লম্বা, ভিতরে প্রচুর মধ্যসত্ত্বভোগী থাকায় অধিক লাভের আশায় অপরিপক্ক ফসলকে পরিপক্ক বা দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করতে অথবা পণ্যের চেহারা সুন্দর দেখাতে নানান ধরনের ক্ষতিকর ও অনুনমোদিত রাসায়নিক মেশানো হয়। এই পরিস্থিতিতে সাধারণ ভোক্তাদের সচেতন হয়েও খুব বেশি কিছু করার নেই। এদেশের সরকার ও বাজার বা পণ্য নিয়ন্ত্রণকারী কতৃপক্ষের ক্ষমতা খুবই সীমিত, তারা কোনভাবেই এসব বিষয়ে মনোযোগ দিতে পারে না। কিছু সভা, কিছু সেমিনার, কিছু দিবস পালনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে এসব সংস্থার কাজ। এদের উপর ভরসা করার মতো অবস্থা আগামী এক দশকেও সম্ভব হবে কিনা তা অনিশ্চিত।
তাই যার যার অবস্থান থেকে সচেতন হওয়া, নিরাপদ খাদ্য নিয়ে নিজেদের কম্যুনিটির মধ্যে আলোচনা করা, কৃষক ও ভোক্তা পর্যায়ে বিভিন্ন রকম প্রকল্প বাস্তবায়ন করে সার্বিক সচেতনতা তৈরি করার বিকল্প নেই। আমাদের সমস্যা থেকে বাঁচতে আমাদেরই রুখে দাড়াতে হবে। অন্যথায় অকাল মৃত্যু, জটিল অসুস্থতা ও হাসপাতালের অতিরিক্ত খরচ মিটিয়ে যেতে হবে চিরদিন। সেই জন্য আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে কিছুটা বেশি মূল্য দিয়ে জ্ঞাত উৎস্য হতে নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্য পণ্য সংগ্রহ করবেন নাকি যা খুশি খেয়ে রোগী হিসেবে বাঁচবেন? সুস্থতার থেকে বড় সম্পদ আর হয় না, এভাবে ভেজালে ভরা পণ্য থেকে মুক্তি পেতে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। এদেশে ধার্মিক মানুষের সংখ্যা যেমন বেশি ঠিক পাপী মানুষের সংখ্যা আরো বেশি। এই দেশে আমিই ভালো আর সবাই খারাপ এমনটাই সবাই মনে করে। এই জাতীয় ভ্রান্তবোধ থেকে বের হয়ে আমরা সবাই খারাপ, এবার সবাই মিলে ভালো হবো এই প্রকৃত বোধের উন্নয়ন ঘটাতে হবে।
আমি আশাবাদী মানুষ, এদেশে পদ্মা সেতু থেকে শুরু করে মেট্রোরেল, নদীর তলদেশে অত্যাধুনিক টানেল পর্যন্ত বৃহৎ সব স্থাপনা তৈরি যখন হয়েছে তখন সবাই মিলে চেষ্টা করলে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার মূলমন্ত্র খাদ্যকে নিরাপদ করাও সম্ভব হবে। অবকাঠামোগত উন্নয়নে আপনার জীবন গতিশীল হবে কিন্তু স্বাস্থ্যগতভাবে আপনি হয়ে পড়বেন ভালনারেবল বা দূর্বল। জাতি হিসেবে আপনার দক্ষতা হবে নিম্নগামী, আপনাকে সবসময় স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে বিব্রত থাকতে হবে। এই সুযোগে স্বাস্থ্যখাতে বিরাজ করা সিন্ডিকেট আপনাকে সর্বশ্বান্ত করতে কার্পণ্য করবে না! তাই আর দেরি না করে আজই সুস্থতার লড়াইয়ে যুক্ত হয়ে পড়ুন আগেপিছে না ভেবেই।
পল্লব খন্দকার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৩।
mazhabkh93@gmail.com