** অনিবার্য কারনবসতঃ নিরাপদ খাদ্য নিয়ে মঙ্গলবারের নিয়মিত কলামটি প্রকাশ করা সম্ভব হচ্ছে না।
আজ একটু খেজুর গুড় নিয়ে শৈশবের স্মৃতিচারণ পাঠকের সাথে ভাগাভাগি করে নেয়ার সুযোগ নিচ্ছি, এর মাধ্যমেও নিরাপদ খেজুর গুড় সরবরাহ ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে আপনাদের ধারনা দেয়া সম্ভব হবে।
“পুরো শীতকাল কাটতো অনেক ব্যস্ততায়, বিশেষ করে শুকুর দাদা (গাছি) আমাদের বাড়ির ৩০-৪০ টা খেজুর গাছ কাটতেন। মৌসুমের শুরুতে গাছ ঝোড়া হত, সেই গাছের যাবতীয় পাতা ও সরফা গুছিয়ে শুকায়ে পাজা করে রান্নাঘরের পাশে সাজিয়ে রাখা, এইগুলো দিয়ে রস জ্বাল করে গুড় বা পাটালি বানানো হবে। এরপর যখন খেজুর গাছে চাঁচ দিয়ে ঠিলে পাতা হত তখন সেই ঠিলে সারি করে খড় দিয়ে পোড়ানো হত যাতে রস ঘোলা না হয়। প্রথম দিকের রস দিয়ে নলেন গুড় বা পাটালি তৈরি করা হত। শুকুর দাদা সপ্তাহে দুইবার গাছ কাটতেন, ঐ দুইদিন আমার কাজ ছিলো বিকালে দাদার পিছন পিছন ঠিলে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো আবার পরের দিন ভোর সকালে উঠে দাদার সাথে একেক গাছের রস পেড়ে ঠিলে ভর্তি করা।
৩০-৪০ টা গাছ মিলিয়ে প্রায় ১২-১৪ ঠিলে রস হত, শুকুর দাদা অর্ধেক রস বাঁশের শিকেয় বাঁধিয়ে নিয়ে চলে যেতেন আর আমি আর আমার চাচাতো ভাই মিলে বাকি অর্ধেক রস নিয়ে বাড়ি ঢুকে প্রথমে তাফালের নীচে কাদা মাটি দিয়ে লেপে এরপর ছাই দিয়ে দিতাম, মাঝে মাঝে দাদীই সেটা করে রাখতেন। বড় চারকোনা চুলার উপর তাফাল বসিয়ে আগুন ধরাতাম চুলায়, দাউদাউ করে আগুন জলে উঠলে রসের ঠিলের মুখে পরিষ্কার কাপড় ধরে ছেকে তাফালের ভিতর দিতাম।
চলতে থাকতো রস জ্বাল দেয়া যতক্ষণ না রসের রঙ লালচে হয়ে উঠেছে। যেদিন পাটালি বানানো হত সেদিন আরো বেশি জ্বাল দিতাম, আবার খেয়াল রাখতে হতো পুড়ে না যায়, গুড়ে পোড়া গন্ধ থাকলে ভালো দামে বিক্রি করা যাবে না। পাটালি বানানোর জন্য যখন আঠালো ও লালচে-হলদে রঙ হয়ে সরিষার ফুলের মত বুড়বুড়ি উঠতো তখন তাফাল নীচে নামিয়ে একটা খেজুরের পাতার গোড়ার ডান্টি দিয়ে তাফালের এক পাশে ঘষে ঘষে বীজ ফেলতাম, যদি বীজ ঠিকমত না আসতো আর একটু জ্বাল দেয়া লাগতো তবে দাদীর কাছে শিখতে শিখতে অভিজ্ঞতা হয়ে গিয়েছিলো, বীজ ফেলার পর নরম অংশের সাথে মিশিয়ে দিতাম পাটালি জমার জন্য, একটু জমাট ভাব আসলে কলার পাতার উপর ঢেলে দিতাম আধা শক্ত গুড়ের নির্যাস, কিছুক্ষনের মধ্যেই শক্ত পাটালি তৈরি হয়ে যেত। এরপর হাটের দিন বিক্রির জন্য ধামায় সংরক্ষণ করা হতো।
অবশ্য শুকুর দাদা (গাছি) খেজুর গাছ কাটার পরও আমার বাকী দুইদিন প্রতিটি গাছে ঠিলে বাঁধা লাগতো, বাকী দুই দিনের রস একটু ঘোলা হত, তাই সেই রস দিয়ে ঝোলা গুড় বানিয়ে ঠিলে ভরে রাখা হত বাজারে বিক্রির জন্য। আবহাওয়া একটু মেঘলা হলে রস বেশী ঘোলা হত, সেই রস দিয়ে সিরকা আর টানা গুড় বানানো হত, সবই আমার হাতের কারসাজি ছিলো। আমি এই খেজুর রসের সাপ্লাই চেইনের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি কাজের সাথে ওতোপ্রতোভাবে জড়িয়ে থাকতাম।”
পাদটীকাঃ উপরের স্মৃতিচারণ থেকে সহজেই বোঝা যায় শতভাগ নিরাপদ খেজুর রস বা গুড়ের উৎপাদন প্রক্রিয়া আবহমানকাল ধরে কিভাবে চলে আসছে। কিন্তু সাম্প্রতিককালে খেজুর রস বা গুড়ের সরবরাহ ব্যবস্থাপনা আর সহজ সরল জায়গায় নেই। দিনে দিনে সারাদেশে খেজুর গুড়ের জনপ্রিয়তা ও চাহিদা বৃদ্ধি পেলেও খেজুর গাছের সংখ্যা কমে গেছে। গাছিরা এই পেশা ত্যাগ করেছেন এবং অতিরিক্ত মুনাফার আশায় অসাধু ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে খেজুরের রস ও গুড় হিসেবে শতভাগ ভেজাল দ্রব্য বাজারজাত করা আরম্ভ হয়েছে। আপনি যত বেশী টাকা দরে গুড় কিনুন, যেখান থেকেই কিনুন সেটি শতভাগ বিশুদ্ধ খেজুরের রস হতে তৈরি করা হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত হতে পারবেন না।
সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আমরা ভেজাল খেজুর গুড়ের খবর প্রকাশিত হতে দেখি, নীচে তেমন একটা খবর দেখে আসিঃ
সাভারে গড়ে উঠেছে বেশ কিছু ভেজাল গুড়ের কারখানা। চিটাগুড়ের সঙ্গে চিনি, গোখাদ্য, রং ও ক্ষতিকর রাসায়নিক মিশিয়ে এসব কারখানায় তৈরি করা হচ্ছে আখ ও খেজুর গুড়। যেখানে আখ কিংবা খেজুর রসের লেশমাত্র নেই।
সাভারের নামাবাজারে এমনই একটি কারখানায় দিনের আলোয় উৎপাদন না হলেও রাতের বেলায় ধুম পড়ে ভেজাল গুড় উৎপাদনের। রাতের মধ্যেই টনে টনে ভেজাল গুড় উৎপাদন করে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে বাজারে। আর এমন গুড় কিনে নিজের অজান্তেই বিষ খাচ্ছেন ভোক্তারা। তবে জেনে বুঝে এমন গুড় বিক্রি থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন সাভারের ব্যবসায়িরা। তাদের দাবি ভেজাল জেনে সাভারের গুড় তারা বিক্রি করেন না।
সরেজমিনে সাভার নামাবাজার এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সারি সারি সাজানো আটার বস্তা। এখানে সাজানো রয়েছে গোখাদ্য, চিটাগুড়, কাপড়ের বিষাক্ত রং, গরুর চর্বি আর কাগজে লাগানো এ ধরনের আঠা। এসবের সংমিশ্রণে তারা নির্দ্বিধায় তৈরি করছেন গুড়। দীর্ঘদিন ধরে কিভাবে এমন ভেজাল গুড় উৎপাদন করা হয় প্রশ্ন সচেতন মহলের।
সাভার উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা বলেন, এ ধরনের খাদ্য মানবদেহে প্রবেশের ফলে ক্যান্সারের মত রোগের সৃষ্টি হতে পারে। মানুষের বিভিন্ন অর্গ্যান ড্যামেজ (ধ্বংস) হতে পারে। শিশুদের জন্য তো এমন খাদ্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এসব খাদ্য থেকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে।
সংকলন: দৈনিক আলোকবর্তিকা।
Leave a Reply