গতকাল ছিলো ২২ অক্টোবর। জাতীয়ভাবে পালিত হলো নিরাপদ সড়ক দিবস। সপ্তমবারের মতো জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস পালন করা হলো এবার। ‘আইন মেনে সড়কে চলি, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলি' প্রতিপাদ্যে এবার পালিত হয়েছে জাতীয় সড়ক দিবস। সড়ক দুর্ঘটনারোধে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে এবং কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের দাবিতে ১৯৯৩ সালে চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের নেতৃত্বে গঠিত হয় ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ (নিসচা)। নিসচার পক্ষ থেকে প্রতিবছর ২২ অক্টোবরকে নিরাপদ সড়ক দিবস হিসেবে পালনের দাবি জানানো হয়। ২০১৭ সালে মন্ত্রিসভার বৈঠকে ২২ অক্টোবরকে জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও অনুমোদন দেওয়া হয়।
সড়ক দূর্ঘটনার মৃত্যুর সংখ্যা করোনা মহামারী বা ডেঙ্গু জ্বরে মৃত্যুর চেয়ে বেশী আমাদের দেশে। তাই এই গুরুতর জীবন সংহারী সংকটকে গুরুত্ব দিয়ে বিশেষ দিবস পালন করার বিষয়টি সবার সামনে তুলে আনার জন্য চলচ্চিত্র নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন সবার সামনে তুলে ধরতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বলা যায় সড়ক দূর্ঘটনায় প্রিয়জনকে হারিয়ে তিনি সড়কে একটি মৃত্যু কতটা ভয়াবহ ক্ষতির এবং সারাজীবন ভরে দুঃখ বয়ে বেড়াবার তীব্র যন্ত্রণা হয়ে থাকে সেটাই নিজের জীবনে উপলব্ধি করেছেন। সেই থেকে সড়ক পরিবহন সিন্ডিকেটের হুমকি ধামকি চোখ রাঙ্গানি উপেক্ষা করে সড়ক দূর্ঘটনা প্রতিরোধে সচেতনতা তৈরির প্রচেষ্টাসহ বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে। তিনি সড়ক দূর্ঘটনার অপর নামকরণ করেছেন সড়কে হত্যা, তাই হত্যাকারীর যেমন মৃত্যদন্ড বা যাবজ্জীবন কারাদন্ড হয় তেমনি সড়ক দূর্ঘটনায় মৃত্যুর জন্য দায়ী বাসচালক বা মালিক একই সাজা পাবার যোগ্য।
কিন্তু আমরা শ্রদ্ধেয় ইলিয়াস কাঞ্চন সাহেবের এতো প্রচেষ্টার ফলাফল তেমন দেখতে পারছি না কিছু দুর্নীতির শিকড় মাটির অত্যন্ত গভীরে প্রথিত আছে বলে। এর প্রথমটি অবশ্যই বিআরটিএ, দেশের যে কয়টি সেবা দপ্তরের টেবিল চেয়ার পর্যন্ত ঘুষখোর তার মধ্যে সর্বাগ্রে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি। এটা আমরা সবাই জানি, আবার আমিই সুযোগ সন্ধানী বাঙ্গালি ঘুষ দিয়ে ড্রাইভিং লাইসেন্স বের করি। বিআরটিএ যে প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদান করে আমি নিজে স্বাক্ষী সেই পদ্ধতি মেনে একজনও বিত্তবানের সন্তান ড্রাইভিং লাইসেন্স নিতে যান না। যেভাবে ঘন্টার পর ঘণ্টা অনিশ্চিত লাইনে দাঁড়িয়ে লিখিত পরীক্ষা, ফিল্ড টেস্ট, মৌখিক পরীক্ষা, ফিঙ্গার দিতে হয় তা রীতিমত মহা বিরক্তিকর। এরপর লাইসেন্স রেডি হয়ে গেলে তা উঠিয়ে আনার জন্য ভোর সকাল থেকে গেটের বাইরে অপেক্ষা করে নয়টায় গেট খুলতেই উর্ধবশ্বাসে হুড়োহুড়ি করে দৌড়ে লাইন ধরা নাগরিক হিসেবে রীতিমত অপমানজনক। বেশী বড় লাইন হয়ে গেলে আবার দালালদের ঘুরাঘুরি লাইন ছাড়াই অতিরিক্ত টাকার বিনিময়ে লাইসেন্স তুলে দেয়ার প্রতিশ্রুতি।
এতো এতো ঝুট ঝামেলা এড়াতে আমার মতো আমজনতা বাড়তি টাকা দিয়ে তাই ঘরে বসেই লাইসেন্স নিতে স্বাচ্ছন্দবোধ করি। ফলাফল যা হয় তা সড়ক দূর্ঘটনার হার দেখলেই বোঝা যায়, আমার জানামতে সাধারণ জেলা শহরে অধিকাংশ মোটর সাইকেল চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স থাকে না, যাদের আছে তারাও সঠিক পদ্ধতিতে তা নেন না। এ থেকেই অনুমান করা যায় কি পরিমাণ অদক্ষ চালক যারা ড্রাইভিং এর ড ও জানে না তারা সড়কে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। ঢাকার রাস্তায় বাইকারদের এলোমেলো বিশৃঙ্খল বাইক চালানো, ফুটপাতের উপর দিয়ে চালানো, অকারনে হর্ণ বাজানো সবই এই তদবির লাইসেন্সের ফলাফল।
অন্যদিকে ট্রাফিক পুলিশের সাথে মান্থি নামক এক ধরণের ব্যবস্থা চালু আছে বাস, মাইক্রোবাস ও ট্রাক মালিকদের। লোক দেখানো কিছু অভিযান করে জরিমানা করা হয় এটা ঠিক কিন্তু বিপরীতে লক্ষ লক্ষ যানবহন রাস্তায় চলাচল করে ট্রাফিক পুলিশকে ম্যানেজ করে। সম্প্রতি আমি সুনামগঞ্জ ভ্রমণ করতে গিয়ে মজার অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিলাম। আমাদের বহনকারী গাড়িটি নির্ধারিত গতিবেগ অতিক্রম করে চালানোয় দাড় করানো হলো। ড্রাইভারের কাগজ দেখে সব ঠিকঠাক পাওয়া গেলো। এরপরেও দেখি দূরে দাঁড়িয়ে কি দেনদরবার চলছে। এই ফাঁকে একজন পুলিশ এসে দুঃখ প্রকাশ করে গেলেন দেরি করানোর জন্য! আমি বললাম- মামলা দিয়ে দেন, অকারনে দেরী করাবেন না। যদিও হাইওয়ে পুলিশের প্রধান আমার পরিচিত কিন্তু আমি তাঁকে বিব্রত করতে চাইনি, তাই ফোন দিলাম না। আধা ঘন্টা পর ড্রাইভার ফিরে এলে বললাম- কত টাকার মামলা দিলো? ড্রাইভার বল্ল- মজার কথা বলেছেন তারা! ওনারা নাকি ঘুষ খান না, মামলা দিলে বারো হাজার টাকা দেয়া লাগবে তারচেয়ে পাঁচ হাজার টাকা বকশিস দিলে সব ঝামেলা শেষ।
তাই সড়কে শুধু হত্যা নয়, ট্রাফিক পুলিশের দূর্নীতিও বন্ধ নাহলে এভাবে হত্যাকান্ড চলতেই থাকবে। সড়ক দূর্ঘটনার বিরুদ্ধে স্কুল শিক্ষার্থীদের সুতস্ফূর্ত আন্দোলন আমরা নির্মমভাবে দমন করতে দেখেছি। সরকারের আশ্বাস দেখেছি, সড়ক নিরাপত্তা আইন পাশ করতেও দেখেছি কিন্তু কোন আইনই বাস্তবায়নের কোন চেষ্টা আমরা দেখতে পাইনে। আমাদের মৃত্যু দিনে দিনে বেড়েই চলে, আমরা নিজেরাও সচেতন হই না, যানবহন চালকের লাইসেন্সটি আসল না নকল তা দেখার কোন আগ্রহ আমাদের নেই। অথচ স্কুল শিক্ষার্থীরা রাস্তা দখল করে লাইসেন্স চেক করেছিলো, সেসব দেখে আমাদের লজ্জা তো দূরের কথা আমরা আরো বেশী বেপরোয়া হয়ে গেছি। আমি বাংলামোটর এলাকায় দেখি লোকাল বাস বেপরোয়া গতিতে ধেয়ে আসছে দেখেও পথচারী হাত তুলেই রাস্তা পার হয়ে যাচ্ছে। সামান্য এদিক ওদিক হলেই দূর্ঘটনা ঘটে যাচ্ছে।
যানযট ও দূর্ঘটনার আরেকটি বড় কারন হলো যেখানে সেখানে বাস থামিয়ে যাত্রী ওঠানামা করা। এলোমেলোভাবে সড়কে বাস দাঁড়িয়ে থাকে, চলন্ত অবস্থায় যাত্রী ওঠানামা করানো হয়, পিছনের গাড়ী চেষ্টা করে বেপরোয়াভাবে সামনে চলে এসে নিজের গাড়িতে অতিরিক্ত যাত্রী তুলতে। এছাড়া সড়কে পাল্লাপাল্লি করে চালানোর অভ্যাস তো কোনদিনই যাবে না ড্রাইভার কন্টাকটারদের কন্টাক্ট ভিত্তিক বাস ভাড়া দেয়ার প্রচলিত ঘৃণ্য পরিবহন ব্যবস্থাপনার কারনে। আমরা সব সমস্যার কথা জানি, প্রচুর গবেষণাও আছে সমস্যা চিহ্নিত করা আছে, সমাধানের পথও বলা আছে। শুধুমাত্র সকল অনিয়মের বিরুদ্ধে আমাদের সংগবদ্ধ প্রতিবাদের অভাবে আর পাষন্ড বাস মালিকদের সীমাহীন লোভের বলী হয়ে আমরা মৃত্যুর মিছিলে শামিল হতে পারি যেকোনদিন যেকোনসময়।
পল্লব খন্দকার, ২৩ অক্টোবর ২০২৩
mazhabkh93@gmail.com