জানালার ওই পাশটা হীমশীতল, মৃত্যুকূপ। সবকিছু সাদা কফিনে মোড়া। এরমধ্যে কিভাবে নিজেকে গরম রাখা যায় ভাবছিলাম। হঠাৎ বাংলাদেশের রাজনীতির চিন্তাগুলো মাথার মধ্যে চলে এলো। এ বিষয়ে কথা বলার ইচ্ছা ছিল না, তবুও বলছি, প্রসঙ্গ যখন বিএনপি।
আশির দশকের প্রথম দিকে, সবে স্কুলে যাওয়া শুরু করেছি, প্রেসিডেন্ট জিয়াকে যখন মেরে ফেলা হলো, চারপাশের সব মানুষের মধ্যে একটা কষ্ট দেখেছিলাম। বাজারে ঈদকার্ড, ভিউকার্ড, স্কুলের চটিখাতার কভার সবখানে জিয়ার ছবি থাকতো। ভালো লাগতো। শ্রদ্ধা জাগতো।
পঞ্চমশ্রেণিতে বৃত্তি পাবার পর পৌরসভা থেকে সংবর্ধনা দেয়া হলো। জীবনের প্রথম পুরস্কার একটা বই পেলাম, ”জীবন বাংলাদেশ, মরণ বাংলাদেশ - আলী ইমাম (সম্ভবত)। ওটা সংক্ষেপে জিয়ার জীবনী। অনেকবার পড়েছি। বইটার শেষে তার পছন্দের ওই বিখ্যাত গানটা ছিল- প্রথম বাংলাদেশে আমার শেষ বাংলাদেশ---, মুখস্ত হয়ে গেল। মুখস্তটা কাজে লেগেছিল তারও এক যুগ পরে। ভার্সিটির বন্ধুরা মিলে স্টেজে গেয়েছি কাদিরাবাদ ক্যান্টনমেন্টে সব আর্মি অফিসারের সামনে।
ছোটকালে মনের অজান্তে এক প্রয়াত প্রেসিডেন্টকে ভালো লাগলেও ভালো লাগাতে পারিনি বিএনপি দলটাকে। এখনও মাঝে মধ্যে ভাবি - এই দলটা আসলে কী! এরা কী চায়, কেন চায় আর কিভাবে চায়, কিচ্ছু মিলাতে পারিনে। প্রেসিডেন্টকে হত্যা করা হলো ব্রাশ ফায়ারে, ছোটছোট বন্ধুরা আলাপ করতাম ব্রাশ ফায়ার কি জিনিস। বাড়ী আমার সিনেমাহল পাড়ায়, তাই ব্রাশ ফায়ার বুঝতে অসুবিধা হয়নি। তবে অসুবিধা হয়েছে দলটাকে বুঝতে। স্কুলমাঠে মৃত প্রেসিডেন্ট-এর জন্য মিলাদ হবে শুনে গেলাম, বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল জিলাপী। মিলাদ হলো, জিলাপী বিতরণ হলো, কিন্তু জিলাপী পেলাম না। মনে হলো, মিলাদে উপস্থিত ছোটদেরকে তেমন গুরুত্ব দেয়া হলো না। হোঁচট খেলাম, এটা আবার কেমন দল!
অনেক কাঠখড়ি পুড়িয়ে নব্বই’র দশকে বিএনপি সরকারে এলো জামাতের সমর্থন নিয়ে। কিছুদিন যেতে না যেতেই দ্বন্দ শুরু হলো জামাতের সাথে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন বা অধিপত্য বিস্তার নিয়ে মারামারি, গন্ডগোল, রক্তপাত, খূন খারাবী। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গন্ডগোলগুলো সাধারনত বড় কোনো কারণে সংঘটিত হয়না। খুবই ছোটখাট বিষয় নিয়ে তুলকালাম হয়ে যায়। এই বিষয়গুলো যারা বুঝে না বা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না তাদের জন্য মানুষ কেন নিজের জীবন দিবে? কিছুদিন পর ভার্সিটি ভর্তি হতে গিয়ে দেখলাম, নিজেরা নিজেরা মারামারি করে। ঢাকা ভার্সিটির ওরকম দুই পক্ষের মধ্যে পিস্তল বা বন্দুক যুদ্ধ খুব কাছ থেকে দেখেছি। ছাত্রদলের ভয়ে শিবিরের ছেলেরা ভার্সিটির হল বা ঘরবাড়ি ছেড়ে কত রাত যে এদিক সেদিক ঘুমিয়েছে তার হিসেব নেই। কখনো ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসী কখনো নিজ হাতে খুন করতে থাকে শিবিরের ছাত্রদেরকে। বিএল কলেজে ওরকম কয়েকটা বড় বড় হত্যা দেখলাম। এরকম মারামারি হত্যার ঘটনা আমার ছোট্ট শহরেও নিয়ে এলো। সেখানে অনেকে আহত বা পঙ্গু হয়ে এখনও ধুকধুক করছে তাদেরও দেখেছি কাছ থেকে। এটার পতন দেখতে মানুষ মনে হয়তো মুখিয়ে ছিল। তাই পতন হলো। এর ঠিক কয়েক বছরের মাথায় বিএনপির বন্ধুরা বা আত্মীয়রা ফোন করে বলা শুরু করলো তারাও আজ ঘরছাড়া। আমার হিসেব মিলে গেল। একজনকে ঘরছাড়া করলে আরেকজনেরও ঘরছাড়া হতে বেশী সময় লাগে না!
বিএনপির দ্বিতীয় দফার ক্ষমতা আরো ভয়াবহ রূপ নিল। জামাত তখনও ক্ষমতার শরীক এবং তারেক জিয়া বিএনপির দৃশ্যতঃ প্রধান ক্ষমতাধর। ছাত্রদল আর শিবিরের মারামারি এবারও তুঙ্গে। উভয়ের বিবাদ মিমাংসায় মিটিং হলো তারেক জিয়ার সঙ্গে। মিটিং শেষে শিবির কিছুটা আস্থা পেয়েছিল হয়তো, যেহেতু দলের বড় নেতা মিমাংসা করে দিয়েছে। ওরা তারেক জিয়াকে ভাইয়া ডাকতে শুরু করলো। তাতে কি হবে, বাস্তবে যা ছিল তাই রয়ে গেল। কে বড়, তুই না আমি? আমি তোকে সালাম দিবো না তুই আমাকে দিবি? এটাই। আধিপত্য। তাতে চাদাবাজী সহজ হয়, সহজে পয়সা বানানো যায়, আমরা এটাই দেখলাম। তাহলে দল কোথায়! মানুষ আবার আস্থা হারালো। পতনের পর - একজন উচ্চপদের সরকারী অফিসারের সাথে আমার কথা হয়েছিল থাইল্যান্ডে। তিনি আক্ষেপ করে অনেকগুলো কথা বলেছিলেন সেদিন দলটার নেতৃতের বিরুদ্ধে অথচ তিনিও একজন কট্টর বিএনপি সমর্থক। বুঝেছিলাম এর মাশুল গুনতে হবে দলটাকে। হয়েছে, কিন্তু শিক্ষা যে হয়নি বোঝা যাচ্ছে।
এবার বিএনপি যখন ক্ষমতা ফিরে পেতে মরিয়া ততদিনে সবকিছু এলোমেলা। ঢাকা সিটি নির্বাচনে অনেক কষ্ট করে একবার আমিও ভোট দিলাম। বাসায় আসতে নাআসতেই শুনলাম তিনি নির্বাচন বর্জন করেছেন। তার বাপ ছিল বিএনপির নেতা সেই সূত্রে তিনি নেতা না হয়েও দলের ভোট করছেন। লোকজনের সাথে কথা বলে বুঝলাম, সবই নাকি টাকার খেলা। দিন শেষে নেতা না হয়েও যদি টাকা ওয়ালারাই নমিনেশন পায় তাহলে দলটা কোথায়?
এবার জুলাই-আগষ্টের স্বাক্ষী হলাম। আগষ্টের ৪ তারিখে যখন জনমনে টানটান উত্তেজনা, মুটামুটি সবাই বুঝতে পারছে ৫ তারিখে কিছু একটা হবে। এশার নামাজ শেষে এক মুরুব্বি ছয়তলা বিল্ডিঙে উঠার আগেই সিমেন্টের বেঞ্চে ধপাস করে বসে পড়লো। ডাকদিয়ে তার পাশে বসতে বললো। সবাই একই বিল্ডিঙের। চারজন পাশাপাশি বসলাম। বললো, ভাই কী আর বলবো দুঃখের কথা। একটু আগে পরিচিত এক বিএনপি নেতাকে ডেকে একটু মশকরা করতে গেছিলাম। তাকে জিঞ্জেস করলাম যে, ভাই পতন তো এবার হয়েই যাচ্ছে, আর আপনারাই তো পরবর্তী ক্ষমতায় যাচ্ছেন, কেমন লাগছে? লোকটা বললো কী জানেন? বললো, হ্যাঁ ভাই যোলোটা বছর না খেয়ে আছি, পুষাতে তো হবেই। দ্যাখেন, এখনও পতন হয়ে পারে নাই, ও ব্যাটার নিয়্যতই খারাপ, ক্ষমতায় গিয়ে কী করবে এরা! এরপর পতনের পরেরদিন, মীরপুর হোপ মার্কেটের ফুটপাত ব্যবসায়ীদের কাহিনী শুনলাম। পতনের সাথে সাথেই তারা এলাকার বিএনপি নেতাকে খুঁজে বের করে তাকে টাকা দিয়ে এসেছে যে টাকাটা এতোদিন তারা পতিত দলের সাঙ্গপাঙ্গদের দিত। কারণ কী? ওরা সব সময় একটা নিরাপত্তা চায়। কারণ, ওদের ব্যবসাটা অবৈধ। এই অবৈধ ব্যবসাকে উচ্ছেদের হাত থেকে একমাত্র নেতারাই বাঁচাতে পারে, এটা ওরা জানে। তাহলে দলের, আদর্শ, নীতি, নৈতিকতা কোথায়? ওগুলো নেই, কারণ ওগুলোর চর্চা দলে হয় না হয়তো। কোথায় কর্মী প্রশিক্ষণ, কোথায় প্রশিক্ষণ দেবার জন্য প্রয়োজনীয় আয়োজন? দেখিনি বা শুনিনি কখনো। হয়তো নীতি নৈতিকতা নিয়ে থাকতে গেলে রাজনীতি করা যায় না, নাকি ওগুলো থাকলে নেতা হওয়া যায় না। নেতা না হলে দল করে লাভ কী?
দলে ”ত্যাগী নেতা” কথাটা প্রায়ই শোনা যায়। এদের কাছে এই ত্যাগীর অর্থ কী? দলের জন্য নিজের জানমালের ক্ষতি করা নাকি জনগনের জন্য নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থকে ত্যাগ করা?
সংগ্রহ: ইকবাল আহমেদ এর ফেসবুক পেজ থেকে। উল্লেখ্য, তিনি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি এন্ড উড টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের প্রাক্তন শিক্ষার্থী এবং কানাডা প্রবাসী।
সংকলন: দৈনিক আলোকবর্তিকা।