এভাবেই দ্রুত বসন্ত ও গরমকালটা চলে যায়। হেমন্তের বাতাসের ঝাপটা শেষ হতে না হতেই শীত চলে আসে। শিলাবৃষ্টি, মুষলধারে বৃষ্টি, রঙধনু, ঝড়, বিদ্যুৎ চমকানী বা বজ্রপাত সবকিছুরই চলে যেন ঝটিকা সফর। বুঝি, এখানকার মানব প্রকৃতিও তাই দ্রুতগতি সম্পন্ন বা অস্থির সারাক্ষণ। আমাদের বেড়ে ওঠা ঝিরঝির বাতাস কিংবা কুলকুল বহে চলা নদীর স্রোতের সাথে। আমাদের রক্তের সাথে মিশে থাকা সুর ও সঙ্গীতগুলোও তেমনি ধীর তাল-লয়ের। মাঝে মাঝে মনে হয়, আমাদের গতি ও প্রকৃতি যেন এদের সাথে যায় না। তবুও যতই দেখছি আর শিখছি, ততই মিল খুঁজে পাচ্ছি।
যখন ভোর হয় পাখিদের কোলাহল পাই। সকালবেলায় পূব আকাশে টকটকে লাল সূর্যটা আলোর উজ্জ্বল ছটা নিয়ে জেগে ওঠে। এলোমেলো বাতাসে উড়ে চলা মেঘের ছায়ার সূর্যের সাথে লুকোচুরি খেলা, নিচে সবুজ ঘাসের ডগায় জমে থাকা শিশির বিন্দু, পথের ওপর ঝরে পড়া শুকনো পাতার মচমচ শব্দ আর তার ভেতর দারুন উচ্ছ্লতায় মগ্ন খরগোশ আর কাঠবিড়ালিরা। মাথার ওপর দিয়ে রাজাহাঁস, পাতিহাঁস, বক আর নানারকম পাখির দলবেঁধে উড়ে চলা। আশপাশের গাছপালার ঝোপের আড়ালে চড়ুই পাখির আড্ডা, দোয়েল আর কালো কাকগুলো উঁকি মেরে যায় থেকে থেকে। বাড়িগুলোর সামনে ফুলের বাগান, তাতে আছে অতি পরিচিত নানান রঙের গোলাপ, গাঁদা, কচমচ, ডালিয়া, সূর্যমুখী, ধুতরা, জবা, ফনিমনসা, আর হরেক রকম পাতাবাহার। পেছনে সবজি বাগানগুলোতে লকলক করে মিস্টিকুমড়ো আর লাউয়ের ডগা, সেই সাথে সিম, বরবটি, মটরসুটি, শশা, টমেটো, ফুলকপি, বাঁধা কপি, গাজর, বেগুন, জুকিনি, আলু, মরিচ, পেঁয়াজ, পুদিনা, ধনেপাতা, আরো কতো কী!
বাগানে সারাদিন মৌমাছির গুনগুনানি, বোলতার আনাগোনা, ভয়ংকর সুন্দর তাদের সব বাসা আর মাকড়শার জাল। মশা, মাছি, ঘাসফড়িং, প্রজাপতি, সুন্দরী লেডিবাগ আর রাঙাবৌ পোকাদের সারাদিন ব্যস্ততার সাথে পাল্লাদিয়ে কর্মজীবী বাংলার বধূও মেতে থাকে বাগানের যত্নে। বড় হিংসে বাড়িয়ে দেয় ওরা। দিনে দিনে সেও একদিন একঘেঁয়ে সংসার ভুলে গিয়ে শিখে যায় কখন বীজ লাগাতে হবে, আগাছা দমন করতে হবে, সেচ বা সার দিতে হবে, খুঁটি পুঁততে হবে, মাচা দিতে হবে, রোগবালাই দমন করতে হবে, কোন কাজে কী যন্ত্রপাতি লাগবে, ইত্যাদি ইত্যাদি। একগাল তৃপ্তির হাসি আসে ফসল ঘরে তুলে। সেখানে লাভক্ষতির হিসাব মেলে না, প্রতিটা প্রাপ্তিই যেখানে এনে দেয় একেক নতুন জন্মের অনুভূতি।
আমি শুনি রাত দুপুরে ভেসে আসা দলবাধা শেয়ালের ডাক। ভাবি, ওরা থাকে কোথায় আর খায় কী! যাহোক কারো বাড়ী মুরগী চুরি করতে যাওয়া ওদের স্বভাব নয়। ওরা রাতের অন্ধকারে ঝোঁপঝাড়ে লুকিয়ে থাকা খরগোশ, কাঠবিড়ালী বা হাঁস ধরে খায়। পথে চলতে অনেক সময় দেখা মেলে শেয়াল কিংবা হরিণের সাথে। হরিণ, খরগোশ আর কাঠবিড়ালীরা খুব মারা পড়ে পথে চলা গাড়িগুলোর সাথে ধাক্কা খেয়ে, ওদের জন্য খুব মায়া হয়। মানুষগুলো বিল বাওড়ের মতো জলাশয়ে মাছ ধরতে যায় ছিপ দিয়ে, আর তাতে টোপ হিসাবে থাকে কেঁচো, জোঁক, চিংড়ি, আটা, ভুট্টা, ছোটমাছসহ আরো অনেককিছু। বন্দুক নিয়ে হরিণ, হাঁস কিংবা পাখি শিকারেও বের হয় সাহসী শিকারীরা। বনের মধ্যে তাবু খাটিয়ে বা অস্থায়ী ঘর বানিয়ে দু’একদিন বনবাসের স্বাদ নিতে বের হয় কেউ কেউ। তারা কষ্ট করে পাহাড়ে ওঠে, প্রকৃতি দ্যাখে আবার নেমে আসে, পথে মৌমাছি ও নানারকম পোকার কামড় খায়। কাঁটায় বিদ্ধ হয়। পানিতে সাঁতার কাটে, নৌকা চালায়, রোদের মধ্যে মাটিতে শুয়ে গড়াগড়ি খায়। খালি গায়ে অনেককে দেখা যায় গাড়ি চালিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে বা হেঁটে বেড়াচ্ছে, এমনকি শহরের মধ্যখানেও।
পথের দু’ধারে কৃষি জমি, যতোদূর চোখ যায় শুধু সবুজ ফসল আর কৃষি খামার, তাতে গম, সরিষা, মসুর, ছোলা, মটরসুটি, তিল, পেঁয়াজ, আলু কিংবা মিষ্টিকুমড়ো। অক্টোবর মাস জুড়ে চলে মিষ্টিকুমড়োর ছড়াছড়ি আর নানারকম জমজমাট উৎসব আয়োজন চলে তাকে ঘিরে। কোথাও খোলা মাঠে গরু চরছে, ছাগল, ভেড়া, চীনা হাঁস, কোয়েলপাখি, দেশী মুরগী, ফার্মের মুরগী, তিতির মুরগী সব খামারের মধ্যেই বড় হচ্ছে। মেঠো পথের দু’ধারে সূর্যমূখী, কাটানটে, কিংবা বেথোশাক অথবা বিস্তীর্ণ হলুদ সরিষাক্ষেত, পাকা গমক্ষেত দেখে থমকে দাঁড়াই, বুকভরে নিঃশ্বাস নিই আর ভাবি, এগুলো সবই আমার অতি পরিচিত, একান্ত আপন।
মানুষ খুব দুধ, ডিম, চীজ আর বাটার খায়। নানান রকম পাউরুটি আর ফলমুলে বাজার ভর্তি। যখন আলুর সময় হয় তখন নাকি কৃষক পরিবারগুলোতে আলু খাওয়ার ধুম পড়ে যায়। আলু ভর্তা ওদের খুব প্রিয়, তাছাড়া আলু সিদ্ধ, আলু পোড়া, আলুর সুপ, ইত্যাদি লাগাতার চলতেই থাকে। কী এক মহা উৎসব, আলুর।
মহিলারা সময় পেলেই দুই হাতে সুঁই সুতো, উল কিংবা কুরুচের কাজ করে, রেডিও শুনতে শুনতে কাঁথা সেলাই করে, সোয়েটার, চাদর কিংবা টুপি বোনে। সেলাই মেশিনে জামা কাপড় সেলাই করে, ছবি আঁকে, বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে যায় নিশ্চিন্তে। রাতে চাঁদ ওঠে !
এদিকে আমরা বের হই পিকনিকে। চলে, খাওয়াদাওয়ার কী মহা আয়োজন। সেখানে থাকতে হবে বিরিয়ানি কিংবা খিচুড়ি, গরুর-গোস্ত, ডিম ভূণা, মুরগী রোস্ট, মাছভাজি কিংবা টিকিয়া, ডাল, মিটবল, দই, মিষ্টি, সালাদ, শেষে কোক, পরে খাঁটি গরুর দুধের চা। আর সালাদে থাকতে হবে টমেটো, শশা, কাচা মরিচ, ধনে পাতা, পেঁয়াজকুচি, আর খাঁটি সরিষার তেল। কখনো কখনো রাত পার করলে সকালটায় থাকতে হবে পরোটা, ডিমভাজি, ডাল-গোস্ত ভূণা, আর এককাপ দুধ চা। আহ্———!
[গরম চলে গিয়ে শীতের আগমনীতে দুই পশলা বরফ পড়লেও সেটা প্রায় গলে গেছে। এমন গরম নভেম্বর গত তিন বছরে দেখিনি। আজকের তাপমাত্রা +৫ডিগ্রী সেঃ, সর্বোচ্চ]
সংগ্রহ: ইকবাল আহমেদ এর ফেসবুক পেজ থেকে। উল্লেখ্য, তিনি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি এন্ড উড টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের প্রাক্তন শিক্ষার্থী এবং কানাডা প্রবাসী।
সংকলন: দৈনিক আলোকবর্তিকা।
Leave a Reply