প্রবাসে আমাদের চারপাশে অনেক গল্প। এই যে বাড়ী কিনছি, গাড়ী কিনছি। বিশেষ করে বাড়ী কিনতে কেউ এক পা যদি এগিয়ে আসছি তো এক পা কেউবা দুই পা পিছিয়ে যাচ্ছি । কোথায় যেন একটা গোপনীয়তা। এই জন্য অনেক রকম গল্প হলেও পুরো বিষয়টা বুঝে ওঠা বেশ কঠিন। চাকরীর ঠিক প্রথম তিন মাস পার হলেই আমার সহকর্মী এক নাইজেরিয়ান ও এক চাইনিজ, আমার রুমের সামনে সুযোগ পেলেই ফিসফিস করে কি যেন গল্প করে। একদিন জিজ্ঞেস করলাম কিসের ফিসফিসানি? বললো, আমরা বাড়ী কিনছি। তখন আগামী দশ বছরের মধ্যেও বাড়ী কেনার কোনো চিন্তা আমার মাথায় ছিল না, তাই তেমন আগ্রহও ছিল না। তবু জানার জন্য একটু একটু করে শুনতে থাকলাম প্রক্রিয়াটা। ওরা দু’জনা চাকরীর ছয় মাসের মাথায় বাড়ী কিনলো, আর আমার লাগলো দু’বছর।
বাড়ী কেনার জন্য দুইজনের দুইটা নম্বর দিলো ওরা আমাকে। একজন ব্যাংক লোনের জন্য মর্টগেজ ব্রোকার আরেকজন বাড়ী খোজাখুঁজিতে সাহায্য করার জন্য রিয়েলটর কোম্পানীর লোক। দুই জনই নাইজেরিয়ান। একজন আমাকে কিভাবে ব্যাংক লোন নিতে হয় বুঝালো, প্রয়োজনীয় ব্যক্তিগত তথ্য নিলো, তারপর সে নিজেই সুবিধামতো ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে দিলো। তাকে আমাকে কোনো পে করতে হয়নি। সে নাকি টাকা পায় ব্যাংক থেকে। দ্বিতীয় জন আমার কেমন বাড়ী, কোন এলাকায় কতো বাজেটের মধ্যে জেনে নিয়ে বাড়ীর তথ্য পাঠাতে লাগলো। আমি নিজেও ওয়েবসাইট সার্চ করে বাড়ী খুঁজতে লাগলাম। পছন্দের দু একটা বাড়ী তাকে দেখাতে বললাম। সে বাড়ী দেখানোর যাবতীয় ব্যবস্থা করলো। আমাকে কোনো পে করতে হয়নি তাকেও। সে নাকি টাকা পায় বিক্রেতার কাছ থেকে। একটা পছন্দ করলাম তো সে মালিক পক্ষের সাথে যোগাযোগ করলো। দামদর ঠিক হলো। সরাসরি মালিক পক্ষের সাথে দেখা বা যোগাযোগের কোনো সুযোগ নেই যেন এখানে। বললো, এবার বাড়ী ইন্সপেকশন করাতে হবে একটা কোম্পানীর মাধ্যমে। বাড়ী কেনা হোক না হোক তাকে আমার পে করতে হবে পাঁচ’শ ডলার । ইন্সপেকশন রিপোর্ট পেলাম ও পে করলাম। এই সবই ঘটে যায় খুবই দ্রুত গতিতে। প্রথমে রিয়েলটর জেনে নেয় আমি কবে নাগাদ বাড়ীতে উঠতে চাই, সে অনুযায়ী ওরা দৌঁড়ায়।
ব্যাংক লোনের ভালো মন্দ দিকগুলো বুঝতে লাগলাম বিভিন্নভাবে, কখনও ইউটিউব কখনও ওয়েবসাইট, কারণ আামর জীবনে এটাই প্রথম ব্যাংক লোন। নিয়ম কানুনের শেষ নেই। কার মাথা থেকে যে এতসব বেরিয়েছে আল্লাহ মাবুদ তিনিই জানেন। ডাউন পেমেন্ট মোট লোনের বিশ শতাংশ যদি দিই, তাহলে ভালো, সবাই বলে। কারণ, বিশ শতাংশের নিচে গেলে আমাকে ’’সিএমএইচসি বা কানাডা মর্টগেজ এন্ড হাউজিং কর্পোরেশন” কে নিয়মিত পে করতে হবে একটা এমাউন্ট যাতে ব্যাংক আমার কাছে তার লোনকে সিকিউর মনে করবে। ওটা আমার জানা হয়নি। আবার বিশ শতাংশ বা তার ওপরে ডাউন পেমেন্ট দিতে পারলে ব্যাংক বুঝবে আমার সামর্থ্য আছে, এবং এজন্য তারা আমাকে একটু বেশী ইন্টারেস্ট রেট ধরবে, ডাউন পেমেন্ট বিশের নিচে যারা পে করবেন তাদের তুলনায়। বিষয়টা অদ্ভুত! আপনি জীবনে যতই ’জীবন্ত ক্যালকুলেটর’ খেতাব পান না কেনো ওদের ওসব হিসাব নিকাশের কাছে একেবারে অসহায়। প্রশ্ন করলে করুন, আপনাকে বুঝিয়েই ছাড়বে!
মর্টগেজ ওয়ালা প্রথমেই বুঝে নেয় যে আমি খুশি যদি আমার মাসিক মর্টগেজ এর পরিমান আমার মাসিক ঘরভাড়ার মধ্যে থাকে। এজন্য যারা বাড়ী কিনতে আগ্রহী হন তারা এই বিষয়টাকেই বারবার বলে থাকেন যে, প্রতিমাসে যে পরিমান বাড়ী ভাড়া দিয়ে থাকছি সেই টাকা দিয়ে আমার মাসিক মর্টগেজ হয়ে যাবে, তাহলে কিনবো না কেনো? আমাকে আমার মাসিক বাড়ী ভাড়ার পরিমানের মধ্যেই রাখলো তবে মেয়াদ ত্রিশ বছর। প্রথম পাঁচ বছরের জন্য যদি ইন্টারেস্ট-এর শতকরা হার নির্দিষ্ট করে নিই, তবে ওই পাঁচ বছরে যা শোধ হবে তার অর্ধেকের বেশী চলে যাবে ইন্টারেস্টে। উদাহরণ স্বরূপ, যদি পাঁচ বছরে ষাট হাজার শোধ করি আপনার আসল শোধ হবে পঁচিশ। পাঁচ বছর পরে আবার আপনাকে পরবর্তী পাঁচ বছরের হিসাব বুঝিয়ে দিবে, সে অনুযায়ী দিতে থাকবে। এভাবে চলবে। এক বছর পরে আমি আমার মাসিক মর্টগেজের পরিমান পনেরো শতাংশ বাড়িয়ে নিলাম, তাতে দেখালো, আমার মোট মেয়াদ সাত বছর কমে গেল। ত্রিশ বছরের জায়গায় হলো বাইশ। আবার এক বছরের মাথায় অল্প কিছু (লাম্পসাম) শোধ করলাম। তাতে মোট মেয়াদ আরো এক বছর কমলো। কিসের মধ্যে কোন হিসাব লুকিয়ে আছে রে ভাই!
বাড়ী কেনার আগে আমাকে একটা ইন্সুরেন্স কোম্পানীর সাথে চুক্তি করতে হলো, যা বাধ্যতামূলক মূলক, ফায়ার বা এ জাতীয় দুর্যোগকে সামলাবার জন্য। মাসে একশ পনেরো। এরপর, সিটি কর্পোরেশনকে ট্যাক্স, মাসে দুই’শ পঞ্চাশ। এই পরিমান নির্ভর করে বাড়ীর মোট দামের ওপর। বেশী দামের বাড়ী, বেশী টাকার ছড়াছড়ি। এটা আবার বছর বছর লাফাতে থাকে, মানতে হবে।
এরপর একটা ল’ ফার্মের সাথে যোগাযোগ করতে হবে। সে আমার ব্যাংক ব্যালান্স দেখে শুনে ডাউন পেমেন্ট পে করতে বলবে। আমি ব্যাংক থেকে পে অর্ডার নিয়ে তাকে দিয়ে এলাম। সে আমাকে বাড়ীর সব কাগজপত্র বুঝিয়ে দিল। তাকে ফী দিলাম দুই হাজার। এটাও বাড়ীর মোট দামের ওপর নির্ভর করে। একদিন রিয়েলটর কোম্পানীর লোক এসে আমাকে বাড়ীর চাবী আর কয়েকটা কাগজ হাতে দিয়ে ছবি তুলে নিলো।
এরপর, শুরু হলো বাড়ীর মালিক হবার প্রকৃত মজা!
প্রয়োজনীয় সকল জায়গায় ফোন করে করে ঠিকানা পরিবর্তন করা হলো। বাড়ীতে পানির হিটিং সিস্টেম সাধারণত ভাড়া নেয়া থাকে, সে কোম্পানীকে বছর বছর পে করতে হবে। ওকেও দিলাম একশত একাত্তর। এরপর আসলো সিকিউরিটি কোম্পানী যে, তাকেও দিতে হবে। পানি, গ্যাস, বিদ্যুত, ইন্টারনেট বিল তো আছেই। শীতকালে বরফ ছাফ, শীত শেষে পচা ঘাস পাতা ছাফ, গরমকালে ঘাস কাটা, শীতের শুরুতে ঝরা পাতা ছাফ। সবকিছু নিজ হাতে করলে তো ভালো, নাহলে ওগুলোও কনট্রাক্ট দেয়া। এরপর বস্তাভর্তি মাটি কেনা, পাথর কেনা, ফুলের গাছ কেনা, লাইট কেনা, ফ্রিজ, এসি, হিটিং ইত্যাদি কিছু নষ্ট হলে সেটা ঠিক করা বা কেনা। নিয়মিত ধুলোবালি ঝাড়া মোছা। চাকরী ও গাড়ী ব্যবস্থাপনা, ছেলে মেয়ের স্কুল। এরপর মহা আনন্দে মাছ ধরা বা পশুপাখি শিকারের পালা!
সংগ্রহ: ইকবাল আহমেদ এর ফেসবুক পেজ থেকে। উল্লেখ্য, তিনি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি এন্ড উড টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের প্রাক্তন শিক্ষার্থী এবং কানাডা প্রবাসী।
সংকলন: দৈনিক আলোকবর্তিকা।