মনে মনে খুঁজি কোনো একজন সমাজবিজ্ঞান বা রাষ্ট্রবিজ্ঞানে শিক্ষিত ব্যক্তি কিছু লিখছে কিনা যে, বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতি এখন কোন পথে। দেশে প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ এসব বিজ্ঞানে অনার্স মাস্টার্স করে বের হয়, তারা কতজন রাজনীতিতে আসছে। জানা নেই। দেশের বাইরে থেকে খোলা চোখে দুইটা বাংলাদেশকে দেখতে পাই। প্রথমটা এক, অতিব সফল একটা দেশ; চারদিকে শুধু উন্নতি আর উন্নতি, সফলতা আর সফলতা, চাকরী, প্রোমোশন, আলো ঝলমলে রঙিন, নতুন নতুন সব ফুলের মালা। অপরদিকে এক সীমাহীন হাতাশা আর ব্যর্থতা, জুলুম নির্যাতন, অন্ধকারের অতল গহবরে বিলিন।
আমি দেখি পরস্পর বিপরীতমূখী এক গুমট আবহাওয়া। কিছুদিন যেটাতে মানুষ একটু বিনোদন পেত এখন সেখানে ভয়ভীতি এসে ভীড় করেছে। মানুষ খোলামেলা পরিবেশে আড্ডা দিত, পক্ষে বিপক্ষে তর্ক করতো। একদিন এর সঙ্গী হয়েছিলাম দুই ঘন্টার এক প্লেন ভ্রমনে। পুরো আকাশপথের যাত্রীরা সেদিন স্পষ্ট দুভাগে ভাগ হয়েছিল, বিতর্ক করেছিল, হাসি তামাসা করেছিল। বিদেশের মাটিতেও একসময় দেখতাম পক্ষবিপক্ষে বিনোদনমূলক বিতর্ক। এখন সেটা বন্ধ হয়েছে, কারণ সতর্ক হয়েছে; বুঝতে পেরেছে মানুষের মধ্যে ধৈর্য্য, সহ্য আর সহনশীলতা আর আগের মতো নেই।
আমার দেখা বাংলাদেশের মানুষ আর সমাজ আজ এই পর্যায়ে আসার কথা ছিল না। এখনকার সমাজ খুবই জনবহুল হওয়ায় একজন আরেকজনের খুব কাছাকাছি। দেশের যেকোন প্রান্তে গিয়ে কেউ যদি পরিচয় দেয় যে আমার বাড়ী অমুক জেলায়, পড়াশুনা বা চাকরী করি অমুক স্থানে তাহলেই পরিচয়ের একটা সূত্র বেরিয়ে আসে। কখনো কখনো একেবারে অচেনা অপরিচিত অবস্থা থেকে আত্মীয়তার সম্পর্কও বেরিয়ে যায়। এমন পরিবার খুব কমই আছে, যে পরিবারের সবাই একই দল করে। একই পরিবারের মধ্যে বিভিন্ন দলের সমর্থক, নেতা বা কর্মী, সেটাই তো ভালো ছিল। একজন কেন আরেকজনের জানের শত্রু হবে? সকালবেলা ঘুম ভাঙতেই দরজা খুলে যার সাথে দেখা হয় সে কেন শত্রু হবে?
একজন আরেকজনের ওপর কতটা নির্ভরশীল ছিলাম একসময় আমরা, চুলা জ্বালাবার আগুন কিংবা জ্বালানী থেকে শুরু করে লবণ, তেল, কেরোসিন, এমনকি একবাটি তরকারী বা একথালা ভাত, দুটো মরিচ, পেঁয়াজ এগুলো সবকিছুর লেনদেনই চলতো পাশের বাড়ীর সাথে। মহিলা মহলের নীরব এসব লেনদেন কখনো লিখে রাখতে হয়নি, পুরুষ মানুষ টের পায়নি, তেমন কোনো বিবাদও লাগেনি, চলে গেছে জীবন। আত্মীয়স্বজন বা প্রতিবেশীর ওপর নির্ভরশীলতা এখন চলে গেছে বাজারে বাকীর খাতায়, ব্যাংক কিংবা এনজিওগুলোর ঋণের খাতায়।
যখন শুনি এখন আর অভাব নেই আগের মতো, মানুষ আর না খেয়ে নেই। সাথে সাথে মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকে ওইসব ঋণের খাতাগুলো, ক্ষুদ্রঋণ আর ব্যাংক ঋণে মানুষ এখন আর ভয় পায় না, তাই ওগুলো কারো হিসাবেও আসে না। কেউ কেউ কেন বলছে তাহলে মাত্র একটা হাজার ডলার বা পাউন্ড মুদ্রা কিনতে সারাদিন ঘুরে ঘুরেও ম্যানেজ করতে পারেনি? ব্যাংক পাড়ায় হতাশা?
দুনিয়াটা আজ খুব বেশী জড়িয়ে গেছে, ”কে বড়” এই দ্বন্দে। আমিত্বের বড়ত্বই যেন সবকিছুকে গিলে খাচ্ছে। ক্ষমতার চেয়ারটা সবসময় এরকমই, অফিসের বস্ থেকে শুরু করে দেশের প্রধান, সবার আসনই খোদার আসনের খুব কাছাকাছি যেটার পরিবর্তন ততক্ষণ হচ্ছে না যতোক্ষণ খোদাতালার কুদরতী হাতটা সরাসরি এগিয়ে আসছে। জীবনের চেয়েও মূল্যবান এই আসনটা, আর এটাই দুনিয়ার ইতিহাস! ইতিহাসের নতুন নতুন শিক্ষা সব সময় তৈরীই হয় যেগুলো সামনে তুলে ধরতে কেউ এগিয়ে আসে না। আর হাতে ধরিয়ে না দিলে কেউ নিতেও আসে না।
নিজের ঘরে যদি সারাদিন একজন আরেক জনকে ঘায়েল করতে থাকে প্রতিবেশী সুযোগ নিবেই। নিজ দেশের মানুষ একজন আরেকজনকে যদি হিংস্র জানোয়ারের মতো মারতে থাকে চারদিক থেকে বিপদ আপদ আসতে থাকে সমানভাবে ধেয়ে। কখনো কোনো লেখা দেখিনি এই নিয়ে- আশির দশক শেষে দেশে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের সময় দমনপীড়ন চলেছে, পতন হয়েছে, প্রকৃতি সাইক্লোন দিয়েছে, সাথে এসেছে রোহিঙ্গা প্লাবন। ২০০৭ এর আগে চলেছে রাজনৈতিক ব্যাপক দমনপীড়ন, এসেছে সাইক্লোন।
এরপর ২০০৯-১০-১১-১২-১৩-১৪-১৫-১৬, এসেছে একের পর এক অনেকগুলো দূর্যোগ, ২০১৭ তে প্রতিবেশী ঠেলে দিয়েছে লাখলাখ রোহিঙ্গা। আসামটাও গরম করে রাখা আছে, প্রয়োজনে ওখান থেকেও হুমকি দেয়া আছে। আমরা যদি নিজেদের মাঝে চলমান এই পাশবিকতা বন্ধ করতে না চাই আমাদেরকে খেসারত দিতে হবে অনেক বেশী। নব্বই দশকের শেষে ও একবিংশের প্রথম দশকে যখন দেখছিলাম ক্ষমতার ভাগাভাগীতে শরীকরা একে অপরের ওপর যুদ্ধাংদেহী মনোভাব নিয়ে চড়াও হচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে, তখনই বুঝেছিলাম এদেরকে এর চরম মূল্য দিতে হবে। হচ্ছে!
পরস্পর বিচ্ছিন্ন মানবতাহীন নড়বড়ে একটা সমাজকে ভাঙতে বা এর ওপর চড়াও হতে খুব বেশী শক্তির প্রয়োজন হয় না !
সংগ্রহ: ইকবাল আহমেদ এর ফেসবুক পেজ থেকে। উল্লেখ্য, তিনি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি এন্ড উড টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের প্রাক্তন শিক্ষার্থী এবং কানাডা প্রবাসী।
সংকলন: দৈনিক আলোকবর্তিকা।