আমরা অনেকেই ক্ষুদ্র ঋণের প্রবক্তা শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অপছন্দ করি, তীব্র ভাষায় সমালোচনা করে সুদখোর বলেও গালি দিয়ে থাকি! অনেকেই তাঁর নোবেল পুরষ্কার প্রপ্তিকে তাচ্ছিল্যের সাথে অবজ্ঞাভরে দেখি, সোজাসাপ্টা বলে দিই তিনি লবিং করে সেটি অর্জন করেছেন। তাঁর সমসাময়িক অনেক অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক ব্যক্তিগণও অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে দ্বিধান্বিত, কেউ মনে করেন তিনি স্বীয় স্বার্থে দেশের বিপক্ষে ক্ষতিকর ভূমিকা পালন করেন আবার কেউ কেউ তাঁকে একচেটিয়াভাবে সমর্থন করেন। ঘটনা যাইহোক, সুদের কারবারি বলে পরিচিত একজন শান্তিতে নোবেল বিজয়ী হলে পক্ষে-বিপক্ষে তীব্র সমালোচনা থাকাটা খুবই স্বাভাবিক। আমার কেনো জানি মনে হয় অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস সেই সমালোচনা থেকে মুক্তি পেতে পৃথিবীতে নতুন আর একটি ধারণার প্রবর্তন করেছেন যার নাম দিয়েছেন “সামাজিক ব্যবসা”। দেশের অভ্যন্তরে তাঁকে আমরা যতোই তাচ্ছিল্য করি অথবা দেশের জন্য ক্ষতিকর মানুষ বলে প্রচারণা চালাই না কেনো অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস কিন্তু আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাঁর ব্যক্তি প্রচার থামিয়ে দেননি। প্রতিনিয়তই সারা বিশ্ব চষে বেড়াচ্ছেন এবং নিজের বিভিন্ন উদ্ভাবনকে জনপ্রিয় বা প্রায়োগিক করতে প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। আপনি তাঁর সমর্থক না হতে পারেন কিন্তু নতুন ধ্যান ধারনা উদ্ভাবনে তাঁর লেগে থাকার ব্যপারটিকে কিন্তু অগ্রাহ্য করতে পারবেন না।
আজকের লেখাটির উৎস্য মালয়েশিয়াতে গত ২৭-২৮ জুলাই ২০২৩ তারিখে ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রবর্তিত ১৩তম সামাজিক ব্যবসা দিবস পালন করা নিয়ে। একটু দেখে নিই দৈনিক মানবজমিন পত্রিকার অনলাইন ভার্সন থেকে নেয়া এ সংক্রান্ত প্রকাশিত সংবাদটির নির্বাচিত কিছু অংশঃ
ইউনূস সেন্টার এবং মালয়েশিয়ার স্বনামধন্য আল বুখারী ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সৌজন্যে অনুষ্ঠিত হচ্ছে ১৩তম সামাজিক ব্যবসা দিবস। এ বছর উক্ত দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘ওয়ার, পিস অ্যান্ড ইকোনমিকস: ফিউচার অব হিউম্যান বিয়িংস’ বা ‘যুদ্ধ, শান্তি ও অর্থনীতি: মানবজাতির ভবিষ্যৎ’। মালয়েশিয়ার অন্যতম দর্শনীয় স্থান ‘ঈগলের দ্বীপ’খ্যাত ‘লাংকাউই’তে দুই দিনব্যাপী (২৭-২৮শে জুলাই) এই সম্মেলনের প্রথম দিন (বৃহস্পতিবার) মঞ্চে মালয়েশিয়ার স্থানীয় সংস্কৃতিকর্মীরা ঐতিহ্যবাহী নৃত্য পরিবেশন করে সবাইকে স্বাগত জানান। স্বাগত বক্তব্য রাখেন ইউনূস সেন্টারের নির্বাহী পরিচালক লামিয়া মোরশেদ। বিশ্বের ৩০টিরও বেশি দেশ থেকে আগত ৭০০ জনের বেশি ডেলিগেট সম্মেলনে অংশ নিচ্ছেন।
১৩তম উক্ত সামাজিক ব্যবসা সম্মেলনে দেয়া বক্তব্যে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন “সারা বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হবে, শান্তির মন্ত্রণালয় গড়ে তুলতে হবে। পৃথিবীতে যুদ্ধের মন্ত্রণালয় থাকলে শান্তির মন্ত্রণালয় কেন থাকবে না? এমন প্রশ্ন উত্থাপন করে সামাজিক ব্যবসা ধারণার প্রবর্তক, নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ, অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ত্রুটিপূর্ণ। এই ব্যবস্থার প্রধান লক্ষ্য- মুনাফা অর্জন। এটি মানুষের কল্যাণের জন্য নয়। আর, সেজন্যই সামাজিক ব্যবসার গুরুত্ব খুব অর্থবহ। সামাজিক ব্যবসার লক্ষ্য কেবল মুনাফা অর্জন নয়; বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা চিহ্নিত করে সেগুলোর সমাধান করা, মানুষের কল্যাণ করা। দারিদ্র্য, বেকারত্ব, বৈষম্য, পরিবেশ বিপর্যয় এসব সমস্যার সমাধান করা। তিনি আরো বলেন, শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে অর্থ লাগবে, বাজেট লাগবে। দুঃখজনক হলেও এটাই বাস্তবতা যে, মৃত্যুর জন্য বড় বড় বাজেট করা হলেও শান্তির জন্য কোনো বাজেট নেই। শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধের কথা বলা হলেও যুদ্ধের মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।”
আমার মনে হচ্ছে ড. মুহাম্মদ ইউনূস আরো একটি নতুন ধারণার প্রবর্তন করতে শান্তির মন্ত্রণালয় বিষয়টি সামনে নিয়ে এসেছেন এবং নিশ্চয়ই নিজেকে বিশ্ব দরবারে আরো বেশি ফোকাসড করতে চাইছেন। হয়তো এই আলোচনার সূত্রপাত ঘটিয়ে তিনি আবারো শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার পাবার চেষ্টা করছেন? তা তিনি করতেই পারেন, দেশের মানুষ যেহেতু মামলা হামলার উপর রেখেছে তাই নতুন নতুন আইডিয়া জেনেরেট করে বিশ্ব দরবারে চমক সৃষ্টি করতে তো আর কেউ বাঁধা দিচ্ছে না। এছাড়া পৃথিবীতে কিছু মানুষ আছেন বা ছিলেন যারা আইডিয়াবাজিতে অনন্য, তাঁদের কথা শুনে মুগ্ধ হতে হয়, তাঁরা কঠিন কোন বিষয়কে পানির মতো সহজ করে মানুষের সামনে উপস্থাপন করতে পারঙ্গম। তাঁরা যাই বলেন বা লেখেন ভক্ত সমর্থকদের কাছে তা চিরন্তন বাণী হিসেবে গৃহীত হয়, তাঁরা ব্যক্তিজীবনে হয়তো খুব বেশি অনুকরণীয় নন কিন্তু ব্যক্তি গন্ডির বাইরের মানুষের কাছে তুমুল আদর্শবান এবং অনুসরনীয় হয়ে থাকেন।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে আপনি পছন্দ না করলেও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তাঁর লেখা বই, প্রবন্ধ, বক্তৃতা সমূহের প্রচার প্রচারণা কিন্তু থেমে নেই। তিনি আমাদের কাছে “গোয়ালের পাশের ঘাস”, তাঁকে আমরা মূল্যায়ন করবো না এটা খুবই স্বাভাবিক। আমিও তাঁর পাঁড় ভক্ত নই, মানুষটাকে আসলেই কেমন যেনো অতি বুদ্ধিমান মনে হয় আমার কাছে! আমি বাঙ্গালী হিসেবে তাঁকে হিংসে করবো না তা হতেই পারে না, তিনি প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে নোবেল পেয়েছেন এটাও আমার হিংসা করার আর একটি কারন! তবে আমি তাঁর ক্ষুদ্র ঋণ, সামাজিক ব্যবসা ও শান্তির মন্ত্রণালয় ধারনাগুলোকে পৃথিবীর উন্নয়নের জন্য অন্যতম সমাধান হতে পারে বলে মনে করি। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, লালন ফকির এমনকি আমাদের স্বাধীনতার স্থপতি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ্য বাঙ্গালী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়েও প্রচুর সমালোচনা হয়েছে। তাঁরা কেউ কিন্তু নিজেদের অভীষ্ট লক্ষ্য থেকে কখনো সরে যাননি। এটা চিরন্তন সত্য “সমালোচনা যতো, সম্ভাবনাও তত”। আমরা যদি সত্যিকার শান্তির পৃথিবী চাই তাহলে আমাদের ভাবনায় যুদ্ধ ও হিংসাকে পরিত্যাজ্য করা জরুরি, যুদ্ধবাজি ও হিংসাত্মক মনোভাব বজায় রেখে শান্তি প্রতিষ্ঠার কথা বলা খুবই হাস্যকর।
সূত্রঃ দৈনিক মানবজমিন পত্রিকার অনলাইন ভার্সন।
সংকলনঃ দৈনিক আলোকবর্তিকা ডেস্ক।
Leave a Reply