প্রিয় রেজা শামীম,
তোর নিশ্চয়ই মনে আছে রাতের পর রাত আমাদের আলোচনা ও তর্ক হতো, ভোরের আজান শুনে বুঝতাম রাতের শেষ।
এই বাংলাদেশের রাজনীতি, শিল্প, সাংস্কৃতি ছাড়িয়ে
নাটক, সিনেমা, হুমায়ন আহমেদ থেকে এলআরবি, মাইলস, মাকসুদের মৌসুমী কারে ভালোবাসো তুমি গানের আকুলতা নিয়ে।
আমরা ছিলাম এনালগ প্রজন্ম, পাশের বাসায় টিএন্ডটি ফোনই ছিলো আমাদের একমাত্র ভরসা।
আমাদের ছিলো চিঠি লেখা, ডাক বাক্স
বন্ধুর চিঠি চুরি করে পড়ার নির্মল আনন্দ।
কতো রাত যে দেশ ও দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে দার্শনিকের মতো মতামত দিয়েছি, কতশতবার সমালোচনা করেছি ছাত্রদল, লীগ অথবা শিবিরের লেজুড়বৃত্তিক ঘৃণ্য কর্মকাণ্ডের।
আমদের সময় রগ কাটা, ক্যাম্পাসে ছাত্র সংগঠন গুলোর আধিপত্য বিস্তারের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ
স্বৈরশাসক এরশাদের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন এর সবগুলো বিষয় নিয়ে আমাদের ছোট্ট মাথা ঘামাতাম কারণে অকারণে।
প্রিয় রেজা শামীম,
কতো স্বপ্ন ছিলো বাংলাদেশ থেকে হানাহানির রাজনৈতিক সংষ্কৃতি চিরতরে বিদায় নেবে
সহবস্থান করে এই দেশটাকে উন্নতির শিখরে পৌঁছে দেবেন কে?
আমাদের সময় বংগবন্ধু ছিলেন সেলুলয়েড ফিতায় বন্দী, শুধুই ছিলো এরশাদের উন্নয়ন জোয়ারের স্তুতিগাথা বিটিভি।
মনে আছে হঠাৎ করেই বিএল কলেজ, দৌলতপুর, খালিশপুর, ডাকবাংলা নব্বুইয়ের ডিসেম্বরে কেমন অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছিলো?
পট পরিবর্তনের স্বপ্নে আমরা বিভোর হয়ে অপেক্ষায়
ক্ষমতা নিরুংকুশ করতে হঠাৎ করেই এরশাদের ট্রাম্প কার্ড সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের ঘৃণ্য পায়তারা।
আজো আমাকে পীড়া দেয় সেই কয়টা দিন
আমাদের বাসায় কয়েকজন বন্ধু পরিবারের নারীদের সুরক্ষার জন্য পাঠিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলো, ঐ জঘন্য দানবগুলো ওদের বাড়িঘর তছনছ করে জ্বালিয়ে দিয়েছিলো।
এরপরও বহুবার দেশের যেকোন পট পরিবর্তনের সময় অসহায়ের মতো তাকিয়ে দেখেছি সংখ্যালঘু তত্ত্বের নিকৃষ্টতম উন্মাদনা যেখানে আমাদের ঠুটোঁ জগন্নাথ হয়েই নিরবতা পালন করতে হয়েছে।
প্রিয় রেজা শামীম,
তুই দেশ ছেড়েছিস দুই যুগ আগে
আমাদের রাতের পর রাতের গল্পগুলো এরপর শূন্যে মিলিয়ে গেছে, দেশ নিয়ে দেখা স্বপ্নগুলো কাচাবাজারের থলি ভর্তি হয়ে সংসারী করেছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মকে।
আমরা দিব্যি ভুলে গেছি দেশের ভবিষ্যৎ
নিজের আর পরিবারের সুখের জন্য আমি নিজ হাতে ঘুষ দিয়েছি প্রকল্প পরিচালক মহোদয়দের।
আমার ড্রাইভিং লাইসেন্স ঘরে বসেই হাতে পেয়ে গেছি
বারবার আমার বিবেকের লাইসেন্স তুলে দিয়েছি
মুখোশধারী স্বৈরশাসকদের তৈল মর্দনে।
অবিরাম মিথ্যায় হিংস্র থাবা লুকিয়ে হীরক রাজারা
এদেশে লুটপাটতন্ত্র অব্যাহত রেখেছে গত চৌত্রিশ বছর
এই আমি তোর সাথে কতো রাত জেগে বিশুদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলা নিয়ে কতোনা তত্ত্ব ঝেড়েছি
সেই আমি এই জুলাই ম্যাসাকারে ছিলাম ডিজিটাল ভন্ড, একটিও বিবৃতি আসেনি পক্ষে বা বিপক্ষে।
প্রিয় রেজা শামীম,
স্বাধীন বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এক মায়ের সন্তানের বুকে সরাসরি গুলি চালিয়ে হত্যা করেছে
অগণিত মায়ের বুক খালি করে ঘটিয়েছে ইতিহাসের বর্বরোচিত গণহত্যা!
তুই নিশ্চয়ই আমাকে সবচেয়ে ভালো করে জানিস
এই জঘন্যতম গণহত্যার তথাকথিত ডিজিটাল প্রতিবাদ আমি জানাতে পারিনি, আমার চারপাশে রঙ চড়ানো অনেক প্রতিবাদী অতি উৎসাহীদের দেখেও আমার হাত দিয়ে একটি লেখাও প্রসব হয়নি।
আমি তাই তোকেই লিখছি চিঠি
আমার অব্যক্ত হাহাকার তো আর কেউ বুঝবে না তোর মতো করে, আমি আজ কিইবা লিখতে পারি?
যখন আমাদের বয়স এই তরুণদের সমান ছিলো
তখনো কিন্তু বৈষম্যের চাদরেই মুড়ে ছিলো বাংলা
আমরা শুধুই করেছি লম্বা তর্ক, চায়ের কাপে ঝড় তোলা অহেতুক আলসেমি।
তুই জানিস উল্টো রথের বংগপ্রেমিদের চন্ডাল তান্ডবে কিভাবে বংগবন্ধু, রবীন্দ্রনাথ, জয়নুল আবেদীন রাস্তায় গড়াগড়ি খাচ্ছেন আমাদের মেরুদন্ডের ভংগুরতায়।
প্রিয় রেজা শামীম,
জুলাইয়ের তরুনেরা প্রবল প্রতিপক্ষের অস্ত্র ভান্ডারের গর্জন উপেক্ষা করে চায়ের দোকানের ঝাপ ফেলে
নেমে এসেছে রাজপথে অলিতে-গলিতে
গাল-গল্প আর কল্পনার ফানুস না উড়িয়ে ডিজিটাল প্লাটফর্মকে হাতিয়ার করে গর্জে উঠেছে একসাথে এক সুরে টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া।
ওদের উপর তাই রেখেছি আস্থা
তুলে নিয়েছি শাসন বারন
ওরাই পারবে, আমি নই
আমাকে কোন প্রশ্ন করে ভুল উত্তর আশা করে কি লাভ
ওদের পরামর্শ দেয়ার মতো জ্ঞান দক্ষতা সক্ষমতা কোনটাই আমার নেই রে বন্ধু।
প্রিয় রেজা শামীম,
তুই আজ দেশে নেই, আমি তাই আমাদের সন্তানদের অভাবিত এই বিজয়ে রাস্তায় নামতে পারিনি নিজের দায়িত্ব অবহেলার লজ্জায়, আমার মাথা হেট হয়ে গেছে এই প্রজন্মের সন্তানদের বীরোচিত আত্মত্যাগ আর গোটা সংষ্কারের জন্য নিঃস্বার্থ জীবন বিনিয়োগ দেখে।
আমাদের নব্বইয়ের প্রজন্মের ভীরু, চাটুকার আর স্বার্থপরদের উত্তরসুরি এই চব্বিশের প্রজন্ম কোন যাদুর ছোয়ায় আমাদের অন্তর্দাহকে হৃদয়ংগম করে এমন দ্রোহের আগুনে বিস্ফোরিত হয়ে উল্টো পথের সবগুলো সুচক ধরে টান মেরে উপড়ে ফেলতে পারলো সেই ঘোর আর এই জীবনে আমার কাটবে নারে।
যে মায়েরা বুকে আগলে এই তরুন প্রজন্মকে যুদ্ধের ময়দানে সম্মুখ যোদ্ধা হিসেবে পাঠানোর মতো সাহস দেখিয়েছেন আমি বিনম্র শ্রদ্ধায় তাদের গর্ভকে জানাই স্যালুট।
পল্লব খন্দকার
দৈনিক আলোকবর্তিকা।