শিক্ষার সাথে শিক্ষক সমাজ ওতোপ্রতভাবে জড়িত। আমার পরিবারে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা করা আমার চেয়ে বয়সে ছোট ও বড় সদস্য আছেন। আমি তাঁদের প্রত্যেকের মাঝেই শিক্ষক হিসেবে পেশাদারিত্ব, নৈতিক অবস্থান ও শিক্ষার্থীদের উন্নয়নের প্রতি যত্নশীল বা দৃড় অঙ্গীকার দেখে থাকি। আমার পিতাও জীবনের প্রথম চাকুরি হিসেবে একটি বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক হিসেবে আরম্ভ করেছিলেন। আমি সৌভাগ্যবান বোধ করি তাঁর প্রাক্তন শিক্ষার্থীগণ যখন তাঁকে এখনো শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন। এখনো আমার পরিচিত মহলের অনেক শিক্ষককে তাঁদের উচ্চ নৈতিকতা, শিক্ষকসুলভ গুণাবলী ও শিক্ষকতার আদর্শের প্রতি অবিচল থাকতে দেখি। এমন শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধা বা সম্মান আপনাআপনিই জন্মে। তবে সার্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বর্তমানে শিক্ষকগণের প্রতি সর্বজন এই অকৃত্রিম শ্রদ্ধার জায়গাটি হারিয়ে গেছে আমি তা নিশ্চিত করে বলতে পারি।
এদেশে শিক্ষকগণ প্রাচীনকাল হতেই সামাজিক ক্ষমতার বা অর্থ বিত্তের বিচারে সমাজে সকলের থেকে পিছিয়ে আছেন একথাও অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে এই বিত্তহীন মানুষেরা সমাজের সম্মানের দিক থেকে একদিন ছিলেন সবার শীর্ষে। আমরা দেখে থাকি একজন উপাচার্যের উপরে শুধুমাত্র আচার্য থাকেন যিনি দেশের এক নম্বর ব্যক্তি। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হবেন দেশের শ্রেষ্ট্যতম মানুষদের একজন, যিনি বিদ্যায়, গরিমায়, ব্যক্তিত্বে হবেন সবার অনুকরণীয়! দুঃখজনক হলেও সত্য রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্ত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অধিকাংশ উপাচার্যগণ সবার কাছে অনুকরণীয় চরিত্রের হতে পারেন না। তাঁকে দলকানা হয়েই বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করতে হয়, ইচ্ছে থাকলেও সরকারের নীতির বাইরে তিনি শিক্ষার্থীবান্ধব কোন ভালো উদ্যোগ নিতে পারেন না। তিনি মন্ত্রী ও নেতাদের সুপারিশে শিক্ষক বা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নিয়োগ দিতে বাধ্য হন। সরকার শিক্ষার্থীদের স্বার্থের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে উপাচার্য মহোদয়কেও সেই পথেই হাঁটতে হয়। এভাবেই শিক্ষা জগতে সৃষ্টি হয়েছে দূর্বৃত্তায়ন চক্র, যাদের দৌরাত্ম থেকে রক্ষা পাবার উপায় আপাতত নেই।
আমার শৈশব থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত যে সকল আদর্শবান শিক্ষকগণের সান্নিধ্যে যাবার সৌভাগ্যপ্রাপ্ত হয়েছি তাঁদের মধ্যে আমার স্কুল জীবনের মাধ্যমিক পর্যায়ের প্রধান শিক্ষকই সবার মধ্যে শ্রেষ্ঠ্য ছিলেন। ঝামেলা হয়ে গেছে এখন সকল শিক্ষকদের মাঝেই সেই নিষ্ঠাবান, ত্যাগী, দক্ষ ও শিক্ষার্থী অন্তপ্রাণ শিক্ষকদের খুঁজে বেড়াই। সে কারনেই বারবার হতাশ হতে হয়, কারন আমাদের প্রয়াত প্রধান শিক্ষকের ব্যক্তিত্ব ছিলো পাহাড় সমান। ক্ষুরাধার সেই বুদ্ধিমত্তা, বাচন আর সৌম্যকান্তি চেহারায় দীপ্যমান ব্যক্তিত্বের শিক্ষকদের বড্ড আকাল এই সময়ে। আসলে শিক্ষকতাকে তাঁরা যতটা না পেশা হিসেবে নিতেন তারচেয়েও আদর্শ তাঁদের কাছে ছিলো সবার উপরে। শিক্ষকবৃন্দের গরিবী হাল মেনে নিয়েই তাঁরা শুধুমাত্র সম্মানের আশাতেই শিক্ষকতা করতেন, সমাজের অধিকাংশ মানুষ তা উজাড় করে দিতে কার্পন্য করতো না একটা সময়ে। আমাদের সময়েও শিক্ষকতার মহান আদর্শের জন্য নিজের জীবনের বিত্ত বৈভবকে তুচ্ছ করতেন এবং সেগুলোকে বৃহত্তর স্বার্থে ত্যাগ হিসেবে বিবেচনা করতেন একজন আদর্শ শিক্ষক। সেই ত্যাগের বিনিময়ে গড়ে উঠতো মানবিক ও যোগ্য মানুষ, যা শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য।
আমি কিছুদিন একটি সরকারী প্রকল্পের কর্মকর্তা হিসেবে কর্মকালীন উপজেলা পর্যায়ে বিভিন্ন স্কুল কলেজে পরীক্ষা কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত হবার সুযোগ পেয়েছি ২০০০ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত। তখন স্কুলের প্রধান শিক্ষক বা কলেজের অধ্যক্ষগণের সাথে নিবিড়ভাবে কাজ করতে হয়েছে যারা আমার চেয়ে বেশ সিনিয়র ও অভিজ্ঞ ছিলেন। কিন্তু তাঁদের সাথে কাজ করতে গিয়ে প্রথমত দেখেছি চরম ব্যক্তিত্বের ঘাটতি, দ্বিতীয়ত দায়িত্ববোধের বা নিষ্ঠার অভাব এবং তৃতীয়ত পরীক্ষার হলে নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের জন্য অন্যায্য সুযোগ নেবার প্রবণতা। তাই শিক্ষকদের নিয়ে সেই স্বল্প সময়ের সরকারী চাকুরি জীবনের অভিজ্ঞতা মোটেও সুখকর ছিলো না। উত্তর বঙ্গের একটি কলেজ অধ্যক্ষের ভাগ্নী শহর থেকে পরীক্ষা দিতে এসেছেন তাই অধ্যক্ষ মহোদয় পরীক্ষা কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত হিসেবে নির্লজ্জভাবে আমার কাছে অনুকম্পা ভিক্ষা করছেন। আমি নীতিগত কারনে তা প্রত্যাখ্যান করায় তিনি উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে আমাকে পরিবর্তন করিয়ে দিতে দাবী জানিয়েছিলেন! আর মাদ্রাসার শিক্ষকদের সীমাহীন অদক্ষতার কথা আর নাই বা উল্লেখ করলাম, শিক্ষক সমাজের নিম্নগামী হালচাল নিয়ে আমার সম্পূর্ণ ধারনা পালটে গিয়েছিলো সেই সময় থেকেই।
সর্বশেষ আমার গ্রামের বিদ্যালয়টির প্রাক্তন শিক্ষার্থী হিসেবে প্রধান শিক্ষকের বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতি ও অসদাচারনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে শিক্ষক সমাজের চরম অধঃপতনের বিষয়টি আরো বেশী করে দেখার সুযোগ ঘটেছে। এ কারনেই আমি শিক্ষা সেক্টরের সাথে যুক্ত না হয়েও এই লেখালেখির মাধ্যমে পরিবর্তনের ডাক দেয়ার চেষ্টা করছি। আমরা দেখেছি আমাদের গ্রামের অভিভাবকরা জিম্মি হয়ে পড়েছেন শিক্ষকদের স্বেচ্ছাচারিতার কাছে। বিশেষতঃ লক্ষ লক্ষ টাকা ঘুষ দিয়ে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকগণের শিক্ষকসুলভ কোন বৈশিষ্ট্যই অবিশিষ্ট থাকে না। না থাকে পড়ানোর দক্ষতা, না থাকে শিক্ষার্থীদের প্রতি আত্মনিবেদন, শুধুই প্রাইভেট পড়ানো, ক্লাস ফাঁকি দেয়া, ক্লাসে মোবাইল ফোন ব্যবহার করা এসব নিয়েই তাঁরা মত্ত থাকেন। আর শিক্ষার্থীদের পড়ানোর জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে যে লাইব্রেরিমুখি হতে হয় বা বই পড়ার অভ্যাস থাকতে হয় সে ব্যাপারে তাঁদের সীমাহীন অনীহা দেখে আশ্চর্য হয়ে যাই! যেখানে নিজেরাই লেখাপড়া করতে যারা চান না তাঁরা আবার নিজ নিজ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কি আর লেখাপড়া করাবেন? এ যুগের ঘুষ দিয়ে চাকুরী নেয়া সুযোগ্য শিক্ষকবৃন্দের নিকট থেকে তাই শিক্ষকসুলভ আদর্শ আচরণ বা গুণাবলী আশা করাই বাতুলতা।
চলবে ………………………………
পল্লব খন্দকার, ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩
mazhabkh93@gmail.com
Leave a Reply