বর্ষাকালে স্বাভাবিকভাবেই আমরা পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত আশা করে থাকি, কৃষি ভিত্তিক প্রতিটি অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে বৃষ্টির পানি আমাদের কৃষি উৎপাদন ও মৎস্যচাষের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে উজানের দেশ হিসেবে সীমান্তের ওপারের বাঁধগুলো খুলে দিলে ভারতের সাথে অভিন্ন নদীগুলো বেয়ে, পাহাড়ি ঢলে আমরা প্রায় প্রত্যেক বছরই প্লাবিত হই। ভারত চিরদিনই সুপ্রতিবেশী হিসেবে তাদের দেশের অতিরিক্ত পানি বন্যা নিয়ন্ত্রণের নামে আমাদেরকে উপহার দিয়ে থাকে! তাই আমাদের চরাঞ্চল, হাওড়, বাওড়, বিল ও নদী বিধৌত এলাকায় প্রতি বছর বন্যা আসে নিয়ম করেই। কোন বছর কয়েকদিন থেকে কয়েক সপ্তাহ আবার কোন বছর কয়েকমাস পানিতে ভাসিয়ে, ক্ষুধায় কাঁদিয়ে মানবেতর জীবন পার করি লক্ষ লক্ষ মানুষ। বন্যা ও জলাবদ্ধতা আমাদের জীবনে চক্রাকারে আসে, দূর্দশাগ্রস্থ করে, সাময়িক আশ্রয় কেন্দ্রে অথবা উন্মুক্ত আকাশের নীচে ভীষণ কষ্টে দিনরাত কাঁটাতে হয় শিশু ও বৃদ্ধদের। থাকে না নূন্যতম কোন মানবিক সুবিধা, প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছাতে পারে না প্রয়োজনীয় ত্রান-সাহায্য, ভেঙ্গে পড়ে যাবতীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। চরম অসহায়ত্ব আর অনিশ্চয়তার মধ্যে দিনাতিপাত করতে বাধ্য হন অধিকাংশ বন্যা দূর্গত আবাল বৃদ্ধ বণিতা। তারা ফসল হারান, সম্পদ হারান, রোগশোকে স্বাস্থ্য হারান, কখনোবা হারান পরিবারের সদস্যদের। এমন সর্বশান্ত হবার পরও কিসের শক্তিতে যেনো বন্যার পানি নেমে গেলে আবার শুরু করেন নতুন জীবন। বিশেষ করে নিয়মিত নদী ভাংগনে বাড়িঘর হারানো চরাঞ্চল ও নদী পাড়ের মানুষগুলোর সাহস দেখলে বিস্ময় জাগে! কিভাবে তারা পারেন?
যতোই দিন গড়াবে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় আমাদের দেশে প্রাকৃতিক দূর্যোগের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকবে, যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারলে দূর্যোগের ভয়াবহতা আরো বেশি বাড়বে। এটাই যেনো নিয়তি এদেশের সাধারণ মানুষের, এর থেকে মুক্তি কিভাবে মিলবে সেই টেকসই মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করতে আমরা বারংবার ব্যর্থ হয়ে চলেছি। দূর্যোগ প্রশমনে যা-কিছু পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে তা কোনভাবেই দীর্ঘমেয়াদি ফলাফল বয়ে আনতে পারছে না। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ, নদীর তলদেশে মাটি খননের মাধ্যমে নাব্যতা বৃদ্ধির চেষ্টা, কিছু পাকা রাস্তা অথবা আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করে সাধারণত আমরা বন্যার প্রকোপ থেকে প্রতিকার পাবার চেষ্টা করছি। এমন কোন টেকসই ব্যবস্থা আমরা এখনো বাস্তবায়ন করতে পারিনি যার কল্যাণে ফি বছর বসত ভিটা ডুবে যাবে না অথবা বন্যার পানি বৃদ্ধি পেলেও মানুষ থাকতে পারবে নিরাপদে। স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনার পরিবর্তে দীর্ঘমেয়াদি বাস্তব কর্মসূচী গ্রহণ করে এমন কোন স্থায়ী ব্যবস্থার আবিষ্কার করতে হবে যাতে বন্যাকে আমরা ধরে নেবো আমাদের কৃষি ভিত্তিক অর্থনীতির উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে। বন্যার পানি মানুষের জন্য দূর্দশা সৃষ্টির পরিবর্তে সমগ্র দেশের সম্পদ হিসেবে ব্যবহৃত হবে। বন্যায় মানুষ আর ভাসবে না, মানুষের পূর্ব প্রস্তুতি থাকবে বন্যা মোকাবিলা করার, মানুষ সাদরে গ্রহণ করবে দুর্যোগের এই নিয়মিত আঘাত!
শুনেছি জাপানের ভূমিকম্পন প্রবণ অঞ্চলের ঘরবাড়িগুলো বিশেষ নকশায় নির্মিত হয়ে থাকে, ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনা এবং দ্রুত পূনর্বাসনের সুবিধা বিবেচনা করেই সেগুলো তৈরি করা হয়। আমাদের চরাঞ্চলের বা নদী ভাঙ্গন কবলিত এলাকার মানুষ কাঠের ও টিনের ঘরবাড়ি এমনভাবে তৈরি করেন যে ভাঙ্গন আরম্ভ হলে যেনো দ্রুত খুলে ফেলে নদীর পানিতেই ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় ঘরবাড়ির মূল কাঠামো সমূহ। নদী ভাঙ্গনের বিষয়ে এমন পূর্ব প্রস্তুতি থাকায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কম হয়, মানুষের সাময়িক দূর্ভোগ হলেও দীর্ঘমেয়াদি কষ্ট থেকে রক্ষা পায়। আমার মনে হয় আবহঅমানকাল ধরে বন্যা দূর্গত অঞ্চল হিসেবে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতার ধারেকাছে আর কোন দেশের মানুষকে খুঁজে পাবো না। তাই এখানে গবেষকদের অসংখ্য কাজ রয়েছে বন্যা মোকাবিলায় টেকসই সমাধানের বিষয়কে উপজীব্য করে। সহজেই গবেষকগণের সেইসব সুপারিশসমূহ বিবেচনা করে সরকার ও বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে জাতীয় বন্যা মোকাবিলা মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করা যেতে পারে। প্রতি বছর বন্যা হবেই ধরে নিয়ে প্রতিরোধের চিন্তা না করে বন্যা সহনশীল অবকাঠামো নির্মান করা এবং মানুষকে বন্যা মোকাবিলায় পূর্ব প্রস্তুতি গ্রহণে সক্ষমতা অর্জনে সহায়তা করার দীর্ঘমেয়াদি কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। বন্যা দূর্গত এলাকার মানুষকে নানামুখী বিকল্প কর্মসূচীর আওতায় বন্যা মোকাবিলায় সক্ষমতা অর্জন শীর্ষক প্রশিক্ষণ প্রদান, ক্লাস্টার ভিত্তিক সমন্বিত ও টেকসই সমাধান গ্রহণে উদ্বুদ্ধকরণ সহ বন্যাবান্ধব বসতবাড়ির অবকাঠামো উন্নয়নে কারিগরি ও আর্থিক সহযোগিতা করতে হবে।
আমরা তো ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মানের লক্ষ্যে কাজ করছি, তাহলে বন্যার কাছে এভাবে আমাদের অসহায়ত্ব কি সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নে বড় বাঁধা হয়ে দাড়াচ্ছে না? এমন দিন আসুক যেদিন মানুষ বন্যাকে সাদরে গ্রহণ করতে শিখে যাবে, স্মার্ট টেকনোলজির কল্যাণে আগেই জানতে পারবে বন্যার পূর্বাভাস। প্রয়োজনীয় খাদ্য, সুপেয় পানি, পর্যাপ্ত পয়োঃনিষ্কাসন ব্যবস্থা নিয়ে পূর্ব প্রস্তুতি থাকায় বন্যা নিয়ে থাকবে না কোন অযাচিত আতংক। আকস্মিক বন্যা দূর্গত হয়ে পড়লে হতে হবে না চেয়ারম্যান-মেম্বারদের দ্বারস্থ, কারো করুনা ছাড়াই নিজেই করতে পারবে বন্যায় টিকে থাকার সমাধান। আসলে প্রতি বছর বন্যার অবর্ননীয় দূর্ভোগের একই চিত্র দেখতে আর ভালো লাগে না, আমরা যদি জানিই যে বন্যা আমাদের ভাসাবে, পানি বন্দী করে ঘরবাড়ি ডুবিয়ে দেবে তাহলে কেনো শুধুই দূর্বল মাটির বাঁধ নির্মান, ত্রাণ আর পূনর্বাসনের পুরাতন পদ্ধতিতেই আটকে থাকবো? এই ভূখণ্ডে বন্যা নিয়ে আমাদের আছে শত বছরের অভিজ্ঞতা, পর্যাপ্ত পরিসংখ্যান, যথেষ্ট তথ্য ও প্রযুক্তি রয়েছে বন্যাকে টেকসই মোকাবিলা করার। তাই অনেক এলাকাতেই বন্যা দূর্গত মানুষ এখন দাবী করেন “ত্রাণ সহায়তা চাই না, চাই বন্যা মোকাবিলায় স্থায়ী সমাধান”।
পল্লব খন্দকার, ১০ জুলাই ২০২৩।
mazhabkh93@gmail.com
অন্যের সাথে সুর মিলিয়ে বলতেই হয় ভাইয়ের লেখনিতে ধার আছে। সেই ধার যেন ভার হয়ে বন্যা নামের আমাদের সেই আতংক কাটিয়ে ওঠার টেকসই সমাধান এনে দেয়। সেই সুদিনের প্রত্যাশায়….
পল্লব ভাইকে অনেক অনেক অভিনন্দন।
অনেক ধন্যবাদ ভাই। সবার সচেতনতা ও উদ্যোগের মাধ্যমে বন্যার আতংক থেকে মুক্ত হতে চাই।