এ যুগের ছেলেমেয়েদের হাতে হাতে স্মার্ট ফোন ও ইন্টারনেট সংযোগ থাকে। তাদের হাতের মুঠোয় থাকে বিনোদনের পূর্নাংগ প্যাকেজ, যখন খুশি তারা এক লহমায় ঘুরে আসতে পারে বিনোদনের সব মাধ্যমে। এফএম রেডিও থেকে শুরু করে হলিউড-বলিউড-টালিউড-ঢালিউড থেকে সর্বশেষ মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমাটিও তারা দেখতে পারে অনায়াসে।
“আমাদের যুগে আমরা যখন করেছি পুতুল খেলা
তোমরা এ যুগে সেই বয়সেই লেখাপড়া করো মেলা
আমরা যখন আকাশের তলে ওড়ায়েছি শুধু ঘুড়ি
তোমরা এখন কলের জাহাজ চালাও গগন জুড়ি।”
বেগম সুফিয়া কামাল ছড়াটি লিখছিলেন যে বাস্তবতায় এখন দেখছি প্রযুক্তি ছাড়িয়ে গেছে কল্পনার চেয়ে দ্রুত গতিতে। আমরা কোনদিনই এমন হাতের মুঠোয় পুরো একটি সিনেমা হল পাবার স্বপ্ন দেখিনি! আমরা বাংলাদেশ বেতারে নাটক শোনা প্রজন্ম, পাশের বাড়ির অভিজাত পরিবারের টিএন্ডটি ফোনটিতে শুধুমাত্র জরুরী ফোন কল এটেন্ড করার সুযোগ পেতাম। আমার জীবনে রঙ্গিন টেলিভিশন দেখার প্রথম সুযোগ পেয়েছি ১৯৮৯ সালের মার্চ মাসে উপজেলা সেন্টারে এসএসসি পরীক্ষা দিতে গিয়ে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ম্যানেজার সাহেবের বাসায় অবস্থান করার সুবাদে। তখন রঙ্গিন টেলিভিশনের নেশায় এতোটাই মুগ্ধ হয়েছিলাম যে, গৃহকর্তা ও গৃহকতৃ বাসার বাইরে বেড়াতে বের হলেই পরীক্ষার প্রস্তুতি বাদ দিয়ে চুরি করে বিটিভির শুক্রবারের সিনেমা মুগ্ধ হয়ে দেখতাম। আমাদের সেই সময়ের গল্প শুনলে আজকালকার ছেলেমেয়েরা তাচ্ছিল্যের সাথে ঠোঁট উল্টে একটা অবিশ্বাসী দৃষ্টি হেনে বলবে- ওসব রূপকথার গল্প ছাড়ুন। তবে আমি নিশ্চিত ওটিটি (ওভার দ্য টপ) প্লাটফরমে সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা দেখা প্রজন্ম আমাদের আশি নব্বই দশকের সিনেমা প্রেমের কাছে হেরে যাবে।
সম্প্রতি অভিনেতা ও বিজ্ঞাপন নির্মাতা আফজাল হোসেন নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পোস্টে মজার অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন যা আমাদের সময়ের অনেকের সিনেমা দেখা সংক্রান্ত অভিজ্ঞতার সাথে মিলে যায়। আসুন দেখে নিই জনাব আফজাল হোসেনের পোস্টের কিছু অংশ-
“সিনেমার পোকা”
“আমি ছিলাম সিনেমার পোকা। সত্তুর সালে ঢাকায় পা দিয়ে প্রথম রাতেই বলাকা সিনেমা হলে দেখি, রাজ্জাক কবরী অভিনীত দর্পচূর্ণ।
স্কুলে থাকতে সিনেমার নায়ক নায়িকাদের ছবি কেটে কুটে এ্যালবাম বানিয়েছিলাম। রাজ্জাক কবরী, আজিম সুজাতা, নাদিম শাবানা, শবনম, সুচন্দা, নাসিমা খান, রাণী, জেবা, ওয়াহিদ মুরাদ, মোহাম্মদ আলী এমনকি উল্টোরথের পাতা থেকে উত্তম সুচিত্রা, দিলীপ কুমার, রাজ কাপুর, দেবানন্দ, বৈজয়ন্তিমালা, মধুবালাদের ছবিও সে এ্যালবামের সম্পদ ছিল। কম বয়সে সিনেমা দেখা, গল্পের বই পড়া খারাপ কাজ বলে বিবেচনা করা হতো। আব্বা আমাদেরকে সঙ্গে নিয়ে একটাই ছবি দেখিয়েছিলেন- নবাব সিরাজউদ্দৌলা। দেখানোর কারণ তা থেকে ইতিহাস জানা, শেখা হবে- সেটা ঐতিহাসিক ছবি। আমার নানাবাড়ি পশ্চিমবঙ্গে। সীমান্তের এপার ওপারের মানুষদের ধ্যান ধারণায় পার্থক্য অনেক। ছোট একটা লাইব্রেরী ছিল নানা বাড়ির দোতলার চিলেকোঠায়। সেখানে গল্প উপন্যাস- সিনেমা, সাহিত্য পত্রিকা সবই ছিল। নানাবাড়ির দেয়ালে মহাত্মা গান্ধী, পন্ডিত নেহেরু, নেতাজী সুভাষ, স্বামী বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকান্ত ভট্টাচার্যের বাঁধানো ছবি ঝোলানো থাকতে দেখেছি। সে বাড়িতে সিনেমা দেখা, গল্প উপন্যাস পড়া অত খারাপ কাজ বলে মনে করা হতোনা।
ঢাকায় এসে আমার কপাল খুলে গেলো। তখন এই শহরে ইংরেজি বাংলা আর উর্দূ ভাষার সিনেমা চলে। ফাঁক পেলেই এ হল ও হলে ঘুরে বেড়াতাম। সেকালে মন মজানো সৌরভে ম ম করতো হলগুলো। আসিতেছে চলিতেছে লেখা বাক্সের মধ্যে কোন ছবি আসবে আর চলছে যে ছবি উভয়ের স্থিরচিত্র প্রদর্শনের জন্য সাজিয়ে রাখা হতো। দর্শক কাঁচ লাগানো বাক্সের সামনে ভিড় করে ছবির বিত্তান্ত উপভোগ করতেন। তখন সপ্তাহে কমপক্ষে তিনটি সিনেমা না দেখলে পেটের ভাত হজম হতোনা। দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আমি। থাকতাম বাংলা মোটর (তখন পাক মোটর) জহুরা মার্কেটের পিছনে সাতক্ষীরা মেসে। রোজ বিকালে আর্ট কলেজ থেকে ফিরে হাত মুখ ধুয়ে সামনের ইউসুফ কনফেকশনারী থেকে কিছু একটা খাবার কিনে নিয়ে পূর্বদিকের ঢাল বেয়ে নেমে হাঁটতে হাঁটতে চলে যেতাম এফ ডি সির দিকে। তখন সেই গেটের সামনে দেখতাম উপচে পড়া মানুষের ভীড়। ভীড় করে থাকা সব মানুষের মনে একটাই আশা, আহা যদি একবার ভিতরে ঢোকা যেতো! সবার কাছে সেটা ছিল স্বপ্নপুরী। সিনেমার স্বপ্ন তৈরির সাধ্য ছিল বলে মানুষের মনে তা নিয়ে আগ্রহ, কৌতুহল ছিলো বিশেষ। একসময় কেমন ছিল সিনেমা- বোঝাতে এতো বিস্তারিত বলা। সিনেমার জন্য মানুষের টান, উন্মাদনা কতটা ছিলো সচক্ষে সবই দেখা। আবার উন্মাদনা, আকর্ষণ নানা কারণে কমতে কমতে শূন্যের কোঠায় ঠেকতেও দেখেছি। আকাশ থেকে পাতালে ছিটকে পড়ার মতো বেদনাদায়ক ঘটনা।”
ঢাকাই সিনেমা নিয়ে আফজাল হোসেনের উপরোক্ত স্মৃতিচারণ আমাদের সাথে কমবেশি মিল কি খুঁজে পান কেউ কেউ? আমার তো মনে আছে একেকটা সিনেমা দেখে মনের ভিতর প্রায় একমাস ধরে চলতো তার ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া, নায়ক-নায়িকার জন্য আবেগে ভাসতাম, কাঁদতাম, হাসতাম। মায়ের সাথে “ছুটির ঘন্টা” ছবিটি দেখে সিনেমা হলে বসেই হাপুস নয়নে কেঁদেছিলাম। পরবর্তীতে বিটিভির সাপ্তাহিক সিনেমা দেখার জন্য সাদাকালো টেলিভিশনের সামনেও কতো আনন্দ বেদনার স্মৃতি জমা হয়ে আছে, যতো কাজই থাকুক বিটিভিতে প্রচারিত শুক্রবারের সিনেমা কিছুতেই বাদ দিতাম না। সেইসব অল্পতে তুষ্ট হবার দিনের সাথে আজকের কোন তুলনাই চলতে পারে না। বায়স্কোপের চলমান স্থির ছবি ম্যাগনিফাই করে দেখার সুখ, ছারপোকার কামড় খেয়ে সিনেমা হলে বাংলা চলচিত্র উপভোগ করার গভীর আনন্দের সাথে আজকের আধুনিক সিনেপ্লেক্সের কোন তুলনা করার সুযোগ নেই।
যুগের চাহিদার সাথে দর্শকের রুচিগত উন্নয়নের ফলাফল হিসেবে এখনকার দর্শকগণ মনোরম পরিবেশে চলচিত্র উপভোগ করতে পারছেন। তবুও কোথায় যেনো একটা বৈষম্য চোখে পড়ছে, আমাদের যুগে সব শ্রেনী পেশার মানুষ এক কাতারে একই পরিবেশে বসে সিনেমা দেখতেন। আজকালকার সিনেপ্লেক্সগুলোর উপচে পড়া ভিড়েও কিন্তু সেই সাধারণ মানুষদের আর চোখে পড়ে না। এর অন্যতম কারন সম্ভবত টিকেটের উচ্চ মূল্য, আশা করি চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট মানুষেরা আবার সেই বাংলা সিনেমার ষাট থেকে নব্বুই দশকের মতো সব শ্রেনী পেশার মানুষকে একই কাতারে বসে সিনেমা উপভোগ করার সুযোগ করে দিতে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণে সমর্থ হবেন।
সংকলনঃ পল্লব খন্দকার, ১১ জুলাই ২০২৩।
mazhabkh93@gmail.com
Leave a Reply