যদি প্রশ্ন করি পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে নাকি সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে তাহলে প্রশ্নটাই বোকা বোকা শোনাবে। প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে এই সাতশো বছর আগে পর্যন্ত মানুষের ধারনা ছিলো আমাদের পৃথিবী এই মহাবিশ্বের কেন্দ্র আর চাঁদ সূর্যসহ সব গ্রহ নক্ষত্র পৃথিবীর চারদিকে আবর্তন করে। কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তি ও তথ্যপ্রবাহের এই যুগে যে বাচ্চাটি এখনও স্কুলে যাওয়া শুরু করেনি সেও জানে যে শুধু পৃথিবী নয়, পৃথিবী সহ সৌরমণ্ডলের আরো আটটি গ্রহ সূর্যের চারদিকে ঘোরে। কিন্তু অবিশ্বাস্য শোনালেও এটাই সত্যি যে সূর্য বা পৃথিবী কেউ কাউকে কেন্দ্র করে ঘোরেনা, বরং দুজনেই তাদের মাঝের কমন একটা বিন্দুকে কেন্দ্র করে ঘোরে, বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলা হয় বেরিসেন্টার (Barycenter)। একটু সহজ করে বলি-
আমাদের ছোটবেলায় আমরা প্রায় সবাই এরকম একটা খেলা খেলেছি, একটা লাঠিকে আড়াআড়ি করে একটি আঙ্গুলের উপর ব্যাল্যান্স করে ধরে রাখা। আমাদের কেউ বলে দেয়নি কিন্তু আমরা বুঝতাম লাঠিটির কোন জায়গাটা আঙ্গুলের উপর রাখলে এটি পড়ে যাবেনা। বই এর ভাষায় সেটা হলো ঐ বস্তুর ভরকেন্দ্র, যেখানে বস্তুটির সব ভর কেন্দ্রিভুত থাকে। যেমন একটা লাঠির ভরকেন্দ্র এর মাঝামাঝি কোন জায়গায়, আবার হাতুড়ীর বেলায় যেদিকে ধারতবখণ্ড থাকে সেই দিকে। এবার পৃথিবী ও সূর্যের মাঝখানের দূরত্বকে আমরা যদি একটা কাল্পনিক রেখা দ্বারা যুক্ত করি এবং একটি লাঠির দুইপাশে দুইটি গোলক আছে এরকম একটি বস্তু কল্পনা করি তবে এর ভরকেন্দ্র হবে ভারী গোলকের দিকে। ভরকেন্দ্র কতোটা ভারী বস্তুর দিকে হবে সেটা নির্ভর করে ভারী গোলকটি অন্যপাশের গোলকের তুলনায় কতোটা ভারী। সূর্য পৃথিবীর তুলনায় এত বড় যে সূর্যের ভেতর ১৩ লক্ষ পৃথিবীর জায়গা হবে। তাই পৃথিবী ও সূর্যের ভরকেন্দ্র হবে সূর্যের কেন্দ্রের খুব কাছে। পৃথিবী সূর্যের নয়, বরং সেই ভরকেন্দ্র বা বেরিসেন্টারকে কেন্দ্র করে বৃত্তাকারে ঘোরে। সূর্যও নিজ কেন্দ্রের কাছাকাছি সেই বেরিসেন্টারকে কেন্দ্র করে ঘোরে। অনেকটা ব্যালে ড্যান্সারের এক পায়ের আঙ্গুলে ভর করে ঘোরার মত। কিন্তু আপাত দৃষ্টিতে মনে হবে সূর্য স্থির, এবং পৃথিবী সূর্যকে কেন্দ্র করে একাই ঘুরছে।
এই বেরিসেন্টারকে কেন্দ্র করে আবর্তন খুব সহজে ধরা পড়ে সূর্য ও বৃহস্পতি গ্রহের বেলায়। আমরা সবাই জানি বৃহস্পতি আমাদের সৌরমণ্ডলের সবচেয়ে বড় গ্রহ। মাত্র ১০০০ টি বৃহস্পতি গ্রহের জায়গা হবে সূর্যের ভেতর। তাই সূর্য ও বৃহস্পতি গ্রহের বেরিসেন্টার হবে সূর্যের পরিধির বাইরে। বৃহস্পতি গ্রহ সূর্য নয় বরং ওই বেরিসেন্টার কে কেন্দ্র করে ঘোরে এবং সূর্যও ঐ একই বেরিসেন্টারকে কেন্দ্র করে ঘোরে।
কিন্তু সৌরমণ্ডলে তো বিভিন্ন সাইজের আরো গ্রহ আছে। তাহলে এক সূর্য কয়টা বেরিসেন্টারকে কেন্দ্র করে ঘুরবে? সবার মন রক্ষা করতে গিয়ে ওরতো মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার কথা। সমাধানটি হলো গ্রহরা তাদের নিজস্ব বেরিসেন্টারে ঘুরলেও সূর্য একটি বেরিসেন্টারকে কেন্দ্র করেই ঘোরে আর সেটা হলো পুরো সৌরমণ্ডলকে একটা বস্তু ধরলে যে এভারেজ বেরিসেন্টার তৈরী হয়, সেটা। তবে যেহেতু গ্রহগুলো স্থির নয়, সূর্যের বেরিসেন্টারও একটি নির্দিষ্ট স্থানে থাকেনা। প্রতিবছর সূর্যের বেরিসেন্টার পরিবর্তন হয়। সে পরিবর্তন মাথা ঘুরে যাওয়ার মত।
সৌরমণ্ডলে যা ঘটে ঘটুক আমি ভাবছি অন্য কথা। আমার ভর আমার বউ এর চেয়ে মাত্র ১০ পাউন্ড বেশী। নিয়ম অনুযায়ী আমাদের দুজনেরই মাঝামাঝি কোন বিন্দুকে কেন্দ্র করে ঘোরা উচিত? কিন্তু তা কি হচ্ছে? সে স্থির হয়ে আছে আর আমাকেই তার চারপাশে ঘুরতে হচ্ছে।
সংসার পদার্থ বিজ্ঞানের নিয়মে চলেনা...
ইঞ্জিনিয়ার রেজা শামীম, কবি ও লেখক
লস এঞ্জেলস, ইউএসএ থেকে।