আমরা অনেকেই ভাইরাস এর সংজ্ঞা জানি। ভাইরাস হল-নিউক্লিক এসিড ও প্রোটিন দ্বারা নির্মিত এমন একটি অকোষীয় সত্ত্বা যা অনুকূল পরিবেশে তার অসংখ্য প্রতিনিধি বা প্রতিলিপি তৈরি করতে পারে। অর্থাৎ এটি অনুকূল পরিবেশের বাইরে (খারাপ সময়ে) জড় বস্তুর মত আবার নিজের সুবিধাজনক অবস্থান পেলেই জীবের মত বংশবৃদ্ধি করতে পারে। আরো সহজ করে বলতে গেলে বলা যায়, ভাইরাস এমন এক বস্তু বা সত্ত্বা যা অন্য প্রাণীর (যাকে টিপিক্যালি পোষক বা হোস্ট বলে) কোষকে হাইজ্যাক করে সেখান থেকে শক্তি নিয়ে নিজে নিজের সংখ্যা/প্রতিলিপি বা প্রতিনিধি বৃদ্ধি করে। তাত্ত্বিকভাবে, একটি রাইনোভাইরাস/নাসাভাইরাস কে হাত দিয়ে ধরে যদি আপনার নাসারন্ধ্রের ভেতর ঢুকিয়ে দেয়া হয় তাহলে এক সপ্তাহের মধ্যে এই ভাইরাসটি একটি থেকে দুটি, দুটি থেকে চারটি, চারটি থেকে আটটি এভাবে Exponentially বৃদ্ধি করে কয়েক ট্রিলিয়ন আলাদা আলাদা প্রতিনিধি তৈরি করবে এবং আপনার সর্দি শুরু হবে। এই যে স্বেচ্ছায় নিজের প্রতিনিধি/প্রতিলিপি নিজেই তৈরি করার ঘটনা এটা সব জীবের জন্যও সত্য।
মানুষের ক্ষেত্রে দুটি ক্ষুদ্র হ্যাপ্লয়েড কোষ একত্রে মিলিত হয়ে একটি ডিপ্লয়েড কোষ তৈরি হয় এবং একইভাবে সেটি বার বার বিভাজিত হয়ে সংখ্যা বৃদ্ধি করতে করতেই মাত্র ৯-১০ মাসে একটা পূর্ণাঙ্গ মানব শিশুতে পরিণত হয়। একটা অকোষীয় জড় সম্বলিত পদার্থ যদি এরকম উপযুক্ত পরিবেশে কয়েক ট্রিলিয়ন হতে পারে মাত্র এক সপ্তাহে। এটাই হল নিজেকে পুনরুৎপাদন করার শক্তি, যা জীবনের ভিত্তি। আর নিজস্ব-প্রতিলিপি তৈরির (Self replication) এই রহস্য লুকিয়ে আছে ডিএনএ অণুর মধ্যে। দুইটি ক্ষমতা এই অলৌকিক ডিএনএ অণুটিকে অন্য সবকিছু থেকে আলাদা করে: প্রথমত, এতে প্রচুর পরিমাণে তথ্য থাকতে পারে এবং দ্বিতীয়ত, এটি বার বার বিভাজিত হয়ে পুনরুৎপাদন করতে পারে।
কিন্তু আমাদের মেশিনগুলিও কী কোনদিন এই বৈশিষ্ট্যগুলো অনুকরণ করে নিজে নিজেই নিজের মত আরেকটি মেশিন পুনরুৎপাদন করতে সক্ষম হবে? যদি হয় তাহলে তা আমাদের কী কাজে আসবে বা কী ক্ষতি হতে পারে তা নিয়ে আজকের আলোচনা। নিজস্ব প্রতিরূপ তৈরি করার ক্ষমতা সম্পন্ন মেশিনের ধারণাটি আসলে ডারউইনের বিবর্তনবাদ ধারণার মতই পুরানো। ডারউইন তার দ্য অরিজিন অব স্পেসিস প্রকাশ করার পরপরই স্যামুয়েল বাটলার “Darwin among the machine” তত্ত্ব হাজির করেন, যাতে তিনি অনুমান করেছিলেন যে, একদিন মেশিনগুলিও পুনরুৎপাদন করার সক্ষমতা অর্জন করবে। ডারউইনের তত্ত্বের সাথে সাথে এই তত্ত্বটিও বিকশিত হতে শুরু করে। জন ভন নিউম্যান, যিনি গেমিং সহ গণিতের বেশ কয়েকটি নতুন শাখার পথপ্রদর্শক ছিলেন। ১৯৪০ এবং ১৯৫০ এর দশকে তিনি স্বেচ্ছায় পুনরুৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন মেশিনের জন্য একটি গাণিতিক সমীকরণ তৈরি করার চেষ্টা করেছিলেন।
এজন্য তিনি একটি প্রশ্ন দিয়ে শুরু করেন, সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম পুনরুৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন মেশিন আসলে কি?” এই সমস্যাটিকে তিনি কয়েকটি ধাপে বিভক্ত করেন। মনে করুন, বাচ্চাদের খেলনা বিল্ডিং তৈরি করার জন্য এখানে একটি পাত্রে অনেকগুলো লেগো ব্লক রাখা আছে। পাত্র থেকে বেছে বেছে নির্দিষ্ট একটি লেগো ব্লকের সাথে অন্য একটি নির্দিষ্ট ব্লক জোড়া দিয়ে দিয়ে ক্রমান্বয়ে একটি খেলনা বিল্ডিং বানানো যায়। একইভাবে, পুনরুৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন মেশিন তৈরির প্রথম ধাপ হতে পারে মেশিনের বিভিন্ন অংশের ব্লক সম্বলিত একটি বড় পাত্র সংগ্রহ করা (বিভিন্ন প্রমিত আকারের লেগো ব্লকের একটি গাদা মনে করুন)। পরের ধাপে একটি অ্যাসেম্বলার তৈরি করতে হবে যা বাছাই করা দুটি ব্লক নিতে পারে এবং তাদের একসাথে যোগ দিতে পারে। তৃতীয়ত, আপনি একটি প্রোগ্রাম লিখবেন যা অ্যাসেম্বলারকে বলতে পারে কোন অংশে কোনটি জোড়া দিতে হবে এবং সেটা কোন ক্রমে। এই শেষ ধাপটি হবে গুরুত্বপূর্ণ। যারা লেগো ব্লক দিয়ে খেলনা বিল্ডিং তৈরি করেছেন তারা জানে যে, খুব কম অংশ দিয়ে সবচেয়ে বিস্তৃত এবং পরিশীলিত বিল্ডিং কাঠামো তৈরি করতে – ব্লকগুলি সঠিক ক্রমে একত্রিত করাটা জরুরি। ভন নিউম্যান সর্বনিম্ন সংখ্যক অপারেশনাল ধাপ নির্ধারণ করতে চেয়েছিলেন যার মাধ্যমে একজন অ্যাসেম্বলার নিজের একটি প্রতিলিপি তৈরি করতে পারবে।
ভন নিউম্যান শেষ পর্যন্ত এই বিশেষ প্রকল্পটি ছেড়ে দেন। কারণ এটি বিভিন্ন ধরনের অনুমানের উপর নির্ভর করতে হচ্ছিল, যেমন একটি মেশিন তৈরিতে কতগুলি ব্লক ব্যবহার করা হচ্ছে এবং তাদের আকারগুলি কী ছিল, কোন ক্রমে কোন্ কোন্ অংশ আগে জুড়তে হবে ইত্যাদি। তাই গাণিতিকভাবে এটি প্রকাশ করা কঠিন ছিল। মহাকাশে নিজস্ব প্রতিরূপ তৈরি করতে পারার ক্ষমতা সম্পন্ন রোবটের ব্যবহার কিভাবে এবং কেমন হবে নাসা কর্তৃক অ্যাডভান্সড অটোমেশন নামে একটি মহাকাশ গবেষণা প্রজেক্ট পরিচালনা করতে গিয়ে ১৯৮০ সালে নিজস্ব প্রতিরূপ তৈরির সক্ষমতা সম্পন্ন রোবটের তৈরির জন্য পরবর্তী ধাক্কাটি আসে। এই প্রকল্পের প্রতিবেদনে উপসংহারে বলা হয় যে, নিজস্ব-প্রতিরূপ তৈরি করার ক্ষমতা সম্পন্ন রোবট তৈরি করা গেলে তা চাঁদে বসতি নির্মাণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হবে। এজন্য কমপক্ষে তিন ধরণের নিজস্ব প্রতিলিপি তৈরি করার ক্ষমতা সম্পন্ন রোবট তৈরি করা প্রয়োজন হবে। ১. মাইনিং রোবট: এগুলি মৌলিক কাঁচামাল সংগ্রহ করবে, ২. নির্মাণ রোবট: এগুলি কাঁচামাল দ্রবীভূত করবে এবং উপকরণগুলিকে পরিমার্জিত করবে, নতুন অংশগুলি একত্র করবে এবং মেরামত করবে। রোবটগুলি মানুষের হস্তক্ষেপ ছাড়াই নিজেদের এবং তাদের সহকর্মীদের মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ করবে। প্রতিবেদনে রোবটগুলি কীভাবে স্বায়ত্তশাসিতভাবে কাজ করতে পারে তার একটি নমুনাও উপস্থাপন করা হয়েছে। এগুলো হবে আঁকড়ে ধরার হুক বা বুলডোজার ও বেলচা দিয়ে সজ্জিত বুদ্ধিমান গাড়ির মতো, রোবটগুলি যদি একাধিক রেলপথ ধরে ভ্রমণ করতে পারে, গ্রহ থেকে খনিজ দ্রব্য আহরণ ও পরিবহন করতে পারে এবং তাদের পছন্দমত সাইজে রূপ দিতে পারে।
(চলবে————————)
মূল: “The future of humanity” written by Michio Kaku তাত্ত্বিক পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক, নিউইয়র্ক সিটি বিশ্ববিদ্যালয়।
ভাবানুবাদ: মোঃ রবিউল ইসলাম, এমএসসি (কোস্টাল এ্যান্ড মেরিন সায়েন্স)।
দ্বিতীয় পর্বে থাকছে———
এই গবেষণা প্রজেক্টটির একটি দুর্দান্ত সুবিধা ছিল, এটি এমন এক সময়ে করা হয়েছিল যখন মহাকাশচারীরা কয়েকশ পাউন্ড ওজনের শিলাখন্ড চাঁদ থেকে পৃথিবীতে এনেছিল। এবং জানা গিয়েছিল যে এতে ধাতব, সিলিকন এবং অক্সিজেন উপাদান আছে অনেকটা পৃথিবীর শিলার গঠনের মতই । চাঁদের ভূত্বকের বেশিরভাগ অংশই রেগোলিথ দিয়ে তৈরি, যা সেখানের বেডরক, প্রাচীন লাভা প্রবাহ এবং উল্কার প্রভাব থেকে অবশিষ্ট ধ্বংসাবশেষের সংমিশ্রণ। এই তথ্যের সাহায্যে, NASA বিজ্ঞানীরা এখন চাঁদে কারখানার জন্য আরও ক্লিয়ারভাবে, বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা তৈরি করতে শুরু করতে পারে যা চাঁদের উপকরণ থেকেই নিজস্ব প্রতিলিপি তৈরিতে সক্ষম রোবট তৈরি করার চিন্তা করছে।
[…] […]