'ইন্ডিয়া ইজ অন দা মুন' এই খবরটি আমরা সবাই জানি। যুগটাই এমন। খবরের কাছে যেতে হয়না, খবর নিজেই চলে আসে কানের কাছে। যেমন হিরো শাকিব আর বুবলি'র বিয়ে-লুকোচুরি'র খবর আমি জানতেই চাইনি। তবু কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান করে ওরা জানিয়ে দিয়েছে।
রাশিয়া, আমেরিকা ও চীনের পরে ভারত চতুর্থ দেশ হিসাবে চাঁদের মাটিতে তাদের স্পেস রোভার ল্যান্ডিং করিয়েছে এবং প্রথম দেশ হিসাবে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে ল্যান্ড করেছে। এটা এখন পুরানো খবর। মানুষ এখন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে স্পেস রোভার 'প্রজ্ঞান' কি তথ্য পাঠায় তা জানার জন্যে। ভারত মহাকাশ সংস্থা ISRO প্রথম যেবার চাঁদের সবচেয়ে কাছের অরবিটে স্পেসক্রাফট (চন্দ্রযান-১) পাঠিয়েছিলো, তাঁর মাধ্যমেই জানা গিয়েছিলো যে চাঁদে পানি থাকার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু ভারতের আগেই নাসা সেই তথ্য সম্বলিত পেপার পাবলিশ করে এই আবিষ্কারের ক্রেডিট নিয়ে নেয় কারন চন্দ্রযান-১ যে ইন্সট্রুমেন্টের (Moon Mineralogy Mapper or M3) মাধ্যমে চাঁদে পানির অবস্থান নির্ণয় করেছিলো সেটি ছিলো নাসার। এবার আর সেই সম্ভাবনা নেই। চন্দ্রযান-৩ এর সমস্ত প্রযুক্তি ও লোকবল শুধুই ভারতের।
চন্দ্রযান-৩ এর চাঁদে পৌঁছানোর প্রযুক্তিটি (Slingshot) আমার কাছে খুব ইন্টারেস্টিং মনে হয়েছে। এ যেন মাছের তেলে মাছ ভাজা। একটু বুঝিয়ে বলিঃ
আমরা যে কোন বস্তু উপরের দিকে ছুঁড়ে দিলে তা আবার পৃথিবীর ভূমিতে ফিরে আসে। বিজ্ঞানী নিউটনের সূত্রমতে এটি হয় পৃথিবীর অভিকর্ষ বলের কারনে। কিন্তু কোন বস্তু যদি সেকেন্ডে ৭ মাইল বেগে নিক্ষিপ্ত হয় তাহলে সেটি পৃথিবীর অভিকর্ষ বলকে ছাড়িয়ে মাহাশুন্যে চলে যাবে। এটিকে বলা হয় এস্কেইপ ভেলোসিটি। চন্দ্রযান-৩ স্পেসক্রাফটি নিক্ষিপ্ত হওয়ার পর পৃথিবীর কাছাকাছি একটি কক্ষপথে উপবৃত্তাকারে ঘুরতে শুরু করে। এই উপবৃত্তের পৃথিবীর সবচেয়ে কাছের বিন্দুকে পেরিজি বলে এবং দূরতম বিন্দুকে এপিজি বলে। ঘুরতে ঘুরতে স্পেসক্রাফটি যখন পৃথিবীর কাছের বিন্দুতে (পেরিজি) চলে আসে তখন স্পেসক্রাফটির গতি বাড়ানোর জন্যে ইঞ্জিন ফায়ার করা হয়। এতে গতি বেড়ে যায় এবং আরো একটু বড় পরিধিতে পৃথিবীর চারপাশে ঘুরতে থাকে। ঘুরতে থাকার সময় এর ইঞ্জিন অফ থাকে। যখন স্পেসক্রাফটি আবার পৃথিবীর কাছের সেই একই বিন্দুতে ফিরে আসে, তখন আবার ইঞ্জিন ফায়ার করে এর গতি বাড়িয়ে দেয়া হয় এবং এটি আরো বড় পরিধি নিয়ে ঘুরতে শুরু করে। এভাবে পাঁচবার পৃথিবীর চারদিকে ঘোরার পর এটি চাঁদের দিকে ছুটে যায়। প্রতি উপবৃত্তাকার ঘূর্ণনে পেরিজির অবস্থান একই থাকে শুধু এপিজি দূর থেকে দুরে যায়। এ যেন সবচেয়ে বামপাশ থেকে লেইন চেঞ্জ করে করে সবচেয়ে ডানের লেইনে যেয়ে হাইওয়ে থেকে একজিট নেয়া।
স্পেসক্রাফটি এবার চাঁদের বলয়ে যেয়ে চাঁদের কক্ষপথে উপবৃত্তাকারে ঘুরতে থাকে। এবার যেহেতু উদ্দেশ্য চাঁদের কাছাকাছি আসা তাই এবার উল্টো ঘটনা ঘটে অর্থাৎ স্পেসক্রাফটি ঘুরতে ঘুরতে যখন চাঁদের কাছে আসে তখন এর গতির বিপরীতে ইঞ্জিন ফায়ার করে এর গতি কমিয়ে আনা হয় ফলে এটি আগেরবারের চেয়ে ছোট পরিধি নিয়ে ঘুরতে থাকে। এভাবে পাঁচবার ক্রামগত কক্ষপথ ছোট করে করে চাঁদের সবচেয়ে কাছের কক্ষপথে চলে আসে। ইসরো'র দ্বিতীয় মিশন চন্দ্রযান-২ এরও উদ্দেশ্য ছিলো চাঁদে সফট ল্যান্ডিং করা কিন্তু সেটি সম্ভব হয়নি। যে ভুলের কারনে চন্দ্রযান-২ এর ল্যান্ডার চাঁদে ল্যান্ড করার সময় ধ্বংস হয়ে যায়, এবার সেই ভুলগুলো শুধরে চন্দ্রযান-৩ এর ল্যান্ডার চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে সফট ল্যান্ডিং করতে সফল হয়।
এভাবে চাঁদে পৌঁছাতে স্পেসশিপটির ৪০ দিন লাগলেও খরচ লেগেছে বিস্মিত হওয়ার মত কম। মাত্র ৭৫ মিলিয়ন ডলার যা কিনা সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত বলিউড মুভি 'অদিপুরুষ' এর বাজেটের চেয়েও কম। এবার বলি মাছের তেলে মাছ ভাজার কথাটা কেন বললাম। শুধু ইঞ্জিন ফায়ার করার সময় চন্দ্রযান এর জ্বালানী খরচ হয়েছে। আর পৃথিবী ও চাঁদকে ঘিরে চন্দ্রযানটি যে পাঁচবার করে ঘুরেছে তা ঘটেছে ওদের মহাকর্ষ বলের কারনে। এভাবে ঘুরে ঘুরে পৃথিবী ও চাঁদের মধ্যকার সরাসরি দূরত্ব কমিয়ে এনেছে।
দেখা যাক ভারতের চন্দ্রযান আগামী ১৪ দিন আমাদের জন্যে কি তথ্য নিয়ে আসে। এই ১৪ দিন অবশ্য পৃথিবীর জন্যে ১৪ দিন যা কিনা চাঁদের জন্যে ১ দিন যখন চাঁদের ঐপাশে সূর্যের আলো থাকবে। ১৪ দিন পর সূর্যহীন চাঁদের দক্ষিণ মেরু এতোটা শীতল (-২০০ ডিগ্রী সেলসিয়াস) হয়ে যাবে যে সৌরচালিত রোভারটি অকেজো হয়ে পড়বে।
আমি আদার ব্যাপারী, জাহাজের এত খবর নিয়ে আমার লাভ কি ! আমি ভাবছি প্রেমিক এবার তার প্রেমিকাকে কি বলবে ! চাঁদের ছবিতে যেরকম খানাখন্দ দেখা যাচ্ছে তাতে 'তুমি চাঁদের মত সুন্দর' আর ভালো শোনাবেনা। বরং কোন একদিন হয়তো কোন প্রেমিক চাঁদের পাহাড়ে হেলান দিয়ে চাঁদের আকাশে নীল পৃথিবীর দিকে আঙ্গুল তুলে তার প্রেমিকাকে বলবে তুমি ওই নীল পৃথিবীর মত সুন্দর...