শিক্ষা এমন একটি জীবনব্যাপী পরিবর্তনের হাতিয়ার যা একটি বঞ্চিত পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী, সমাজ, দেশ ও পৃথিবী বদলে দিতে পারে। এমন একটি সার্বজনীন ও মানবিক বিশ্ব সমাজ গঠনের মূল অস্ত্রটিকে কোনভাবেই ভোঁতা হতে দেয়া যায় না। পৃথিবীর সকল জাতি নির্বিশেষে এটিকে অব্যাহতভাবে উন্নয়নের দিকে নিয়ে যেতে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়ে যায়। অথচ অন্যান্য সকল বিষয়ের মত শিক্ষা সেক্টরটিকেও আমরা অধঃপতনের শেষ সীমানায় নিয়ে গেছি। দখল ও হরিলুট সংষ্কৃতির লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে এখন বিসর্জনের জন্য উদ্দাম নৃত্য করছেন বলী দানে উদ্যত পুরুত ঠাকুরেরা। এসব দেখে চোখ বন্ধ করে থাকার কিন্তু সুযোগ নেই, এই একটি বিষয় নিয়ে কোন আপোষ করার সুযোগ নেই। ইতিমধ্যেই সংখ্যায় বেড়ে অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দেশের আনাচে কানাচে গড়ে উঠেছে কিন্তু মান রক্ষা বা নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে আমরা বরাবরই উদাসীন। সেই সুযোগে ভন্ড শিক্ষানুরাগীরা দখল করে নিয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালনার দায়িত্ব, গড়ে তুলেছে শিক্ষার বিনিময়ে অবৈধভাবে অর্থ কামানোর ঘৃণ্য সিন্ডিকেট।
সম্প্রতি আমরা সারা দেশের বেসরকারি শিক্ষক প্রতিনিধিদের ঢাকা প্রেস ক্লাবের সামনে প্রায় এক মাস ধরে অসীম কষ্ট করে অবস্থান কর্মসূচী পালন করতে দেখেছি। সরকারের প্রতি তাঁদের জোরালো দাবী দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান একশত ভাগ সরকারীকরণ করে নেয়ার। আমিও এ দাবী শতভাগ সমর্থন করি, তাঁদের দাবী ও আন্দোলনের ফলস্বরূপ ইতিপূর্বে বহু সংখ্যক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভূক্ত করেছে বিভিন্ন আমলের সরকার। আমাদের মত দূর্বল শিক্ষা কাঠামো সম্পন্ন দেশে কৃষি খাতকে যেমন ভর্তূকি দিয়ে এগিয়ে নিতে হয় শিক্ষা ও শিক্ষা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকেও সেভাবে সমর্থন করা উচিত। কিন্তু তার জন্য যে ধরনের দূরদর্শী শিক্ষা কাঠামো গড়ে তোলার প্রয়োজন, দীর্ঘমেয়াদী শিক্ষা সংষ্কারে শক্তিশালী শিক্ষা নীতিমালা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করা উচিত তার আসলে কিছুই করা হয় না। অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো উপযুক্ত পরিকল্পনা ছাড়াই গড়ে ওঠে কিছু বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তি ও শিক্ষা ব্যবসায়ে আগ্রহী ব্যক্তি উদ্যোগে। এরপর উদ্যোক্তাদের দৌড়ঝাঁপ চলতে থাকে কিভাবে কত দ্রুত নেতা মন্ত্রী ধরে, মন্ত্রনালয় বা অধিদপ্তরের দুর্নিতীবাজ কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে এমপিওভুক্ত করা যায়। সে সকল প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পরিষদ আবার কাড়ি কাড়ি টাকা উপহার নিয়ে শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগ দেন ইচ্ছে খুশি মত। যদিও সেসব নিয়োগ বোর্ডে সরকারী প্রতিনিধি থাকেন কিন্তু অদৃশ্য ইশারায় তাঁরা বিদ্যালয়ের পরিচালনা পরিষদের সভাপতির ইচ্ছাকেই মেনে নিয়ে নিয়োগগুলো হালাল করতে সহযোগিতা করে থাকেন। সরকারী কর্মকর্তাদের এই উদার সমর্থনের পিছনে পকেট ভারী করার তত্ত্ব ছাড়া আর কোন যাদুমন্ত্র নেই সে আমরা সকলেই জানি।
আমার শৈশবের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক কর্মচারি নিয়োগ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলা অনিয়মের ওপেন সিক্রেট বিষয়গুলো রীতিমত অবিশ্বাস্য! এই দেশের একটি প্রত্যন্ত গ্রামের বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণির আয়া বা দপ্তরী পদে চাকুরী পেতে নাকি চাকুরী প্রার্থীকে আট থেকে দশ লক্ষ টাকা উপহার দিতে হয় নিয়োগের সাথে যুক্ত কমিটিকে? তাহলে ভেবে দেখুন প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগ পেতে কি পরিমাণ উপহার দিতে হয় মহামান্য নিয়োগ কমিটির রাঘব বোয়ালদের? বিভিন্ন সরকারী দপ্তর, পুলিশ বা প্রশাসনের নিম্ন দিকের পদগুলোতে নিয়োগে এখনকার দিনের রেট হিসেবে নাকি পনেরো থেকে কুড়ি লক্ষ টাকা লেনদেন হয়। চূড়ান্তভাবে নিয়োগ পাওয়া কর্মীদের নিশ্চয়ই একটা ভরসা থাকে এই ঘুষের টাকা তারা কর্মস্থলের সিস্টেমের ভিতর থেকেই এক দুই বছরের মধ্যে উঠিয়ে আনতে পারবেন বেতনের উপরি আয় হিসেবে। কিন্তু আমার সহ অনেকের মাথাতেই ঢোকে না একটি গ্রামের বেসরকারি স্কুলের তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেনীর কর্মচারী কিভাবে কত দিনে প্রাপ্য বেতনের বাইরে চাকুরীতে প্রবেশের বিনিয়োগ উঠিয়ে আনবেন?
তবে সরকার বাহাদুর একটি দূরদর্শী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে সহকারী শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে। বর্তমানে জাতীয়ভাবে অনুষ্ঠিত নিবন্ধন পরীক্ষায় পাশকৃত ব্যতীত কাউকে নিয়োগ দেয়া হয় না এবং বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের এখন আর শিক্ষক নিয়োগ দেয়ার ক্ষমতা নেই। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ বানিজ্য ঠেকাতে সহকারী শিক্ষক পদের মত সকল পদের নিয়োগের ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিতে হবে তথাকথিত ম্যানেজিং কমিটির ধান্দাবাজদের। কারন যেকোন ধরনের অন্যায্য লেনদেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মত পবিত্র অঙ্গনে করা গর্হিত অপরাধ। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের মতোই পবিত্র রাখতে হবে বিদ্যাঙ্গন সমূহকে, এখানে কলুষিত হলে তার নেতিবাচক ফলাফল বহন করতে হবে আগামী দিনের শিক্ষার্থীদের। তারা যদি বিদ্যাঙ্গন থেকেই শুদ্ধতা, সততার পাঠ না পায় সে দায় আমাদেরই, তাই আর চোখ বন্ধ করে থাকার সুযোগ নেই। রাষ্ট্রের পাশাপাশি আমাদেরকেও মৃতপ্রায় শিক্ষাঙ্গন রক্ষার যুদ্ধে শামিল হতে হবে, সমাজের নষ্ট ভ্রষ্টদের কবল থেকে মুক্ত করতে হবে পরিচালনা পর্ষদের পদ পদবীগুলো।
এই পর্বে আমি বলতে চাচ্ছিলাম যে, পয়েন্ট অফ নো রিটার্নে আছি আমরা। এখান থেকে পেছানোর কোন সুযোগ নেই। আরো পিছিয়ে গেলে প্রিয় মাতৃভূমির আত্মার চির মৃত্যু ঘটবে, এইদেশে মানবিক সমাজ ব্যবস্থার কোন অস্তিত্ব টিকে থাকবে না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে অন্তত শিক্ষক নিয়োগ হতে হবে মেধাবী, শিক্ষক হিসেবে আত্মনিবেদনে যিনি আগ্রহী, নিজেও আজীবন লেখাপড়ার প্রতি অনুরক্ত হবেন এবং শিক্ষার্থীদেরও লেখাপড়ার প্রতি আসক্তি সৃষ্টি করতে ভূমিকা রাখার দক্ষতা সম্পন্ন হবেন। আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনার সাথে সচেতনভাবেই প্রকৃত শিক্ষানুরাগী, প্রাক্তন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অন্তর্ভূক্ত করতে উদ্যোগ নিতে হবে। শিক্ষা যে সর্বাধিক মূল্যবান পণ্য এই কথাটির সত্যতা আছে, কারন যথার্থ শিক্ষার আলোয় আলোকিত শিক্ষিত জাতিই গড়তে পারে একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশ। কিন্তু মহামূল্যবান এই পণ্যটি অযোগ্য মানুষদের হাতে পড়ে অবৈধ আয়ের উৎস্য হয়ে যাওয়াতেই অধঃপতনের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে আজ শিক্ষা সেক্টরটি। এভাবে চলবে না, এখুনি ঘুরে দাঁড়াতে হবে, রুখে দিতে হবে শিক্ষা নিয়ে ঘৃণ্য বানিজ্যে লিপ্তদের আগ্রাসী কর্মকান্ডে সৃষ্ট ধ্বংসযজ্ঞ।
চলবে ………………………………
পল্লব খন্দকার, ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩
mazhabkh93@gmail.com