শরীরের সকল অঙ্গের উপরে থাকা চুল নিয়েই যদি আমরা গভীর বিশ্লেষণে যাই তাহলেও কোন কোন কূল কিনারা খুঁজে পাই না আমি। প্রথমতঃ মাথা ভর্তি চুলওয়ালা নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকলকেই সৌন্দর্যের একটি বড় দিক হিসেবে এক বাক্যে মেনে নিই। আর আমার মত পঞ্চাশের যুবকদের মাথা ফাঁকা হয়ে যাবার কষ্ট তারাই বুঝবেন যারা যৌবনের ঘন কালো চুল হারিয়ে চেহারায় বুড়িয়ে যাওয়ার ধাঁচ সহ্য করছেন। মাথা ভর্তি চুল থাকলে অনেক সময় ৮০ বছরের বৃদ্ধকেও যুবকদের মতোই দেখায়! মৃত কোষের তৈরি চুল মানুষের সৌন্দর্য্য বৃদ্ধিতে অন্যতম ভূমিকা পালন করে থাকে, এই অঙ্গটি ব্যতিত মানুষের গঠনে পরিপূর্ণতা আসতো না কিছুতেই।
আবার যদি দেখি চুলের রঙের খেলা। একই মানুষ, একই প্রজাতির অন্তর্গত মানুষের স্থান দেশকাল ভেদে ভিন্ন ভিন্ন রঙের হয়ে থাকে। পাশ্চাত্যের বা শীত প্রধান দেশে বসবাসকারী মানুষদের চুল হয় সোনালী বা বাদামী যাকে ব্লন্ড হেয়ার বলা হয়। চুলের রঙের এই পার্থ্যক্যের কারণ জীনগত, উত্তরাধিকার সূত্রে মানুষ চুলের বিভিন্ন রঙ প্রাপ্ত হয়ে থাকে। রঙের পার্থক্যের পাশাপাশি আছে বিভিন্ন রকমারি চুলের বাহার, কারো সোজা, কারো কোঁকড়ানো, কারো বা ঢেউ খেলানো, কারো রেশমি পাতলা, কারো ঘন মোটা, কারো শুষ্ক কারো তেলতেলে চুল। মেলানিন নামক রঞ্জক পদার্থের নিঃসরণের উপর নির্ভর করে চুলের রঙ নির্ধারিত হয় কিন্তু বাঁকানো বা সোজা চুলের রহস্য লুকিয়ে আছে সেই জীনের সংকেতের মধ্যেই।
চুল টেনে ধরলে বেশ ব্যথা অনুভূত হয় কিন্তু চুল কাঁটার সময় আমাদের কোন ব্যথা অনুভব হয় না। সৃষ্টির এমন নিখুঁত রহস্য দেখে শুধুই অবাক হতে হয়! চুলের গোড়ায় অনুভূতি আছে কিন্তু উপরের অংশে নাই? অনেকটা ভেল্কিবাজি যেনো। কেনো এমন অনুভূতির তফাৎ তার ব্যখ্যা বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন বটে কিন্তু এই নিখুঁত পরিকল্পিত সৃষ্টি শুধু বিস্মিতই করে আমাকে!
চুল সৌন্দর্য্য বিলানোর পাশাপাশি শরীরের তাপমাত্রা ধরে রাখতে সাহায্য করে। মানুষের জন্য এ কাজে চুলের গুরুত্ব যতোটা না অন্যান্য লোমযুক্ত প্রাণীদের জন্য এই তাপমাত্রা ধরে রাখা খুবই জরুরী। বিশেষ করে প্রাণীর শরীরকে অতিরিক্ত ঠান্ডা থেকে রক্ষা করতে চুল বা লোম খুবই কার্যকর। পুরুষদের চেয়ে নারীরা সৌন্দর্য্য সচেতন বিধায় এই চুল রক্ষায় তাঁদের যত্ন নেয়ার কোন কমতি নেই। বিভিন্ন রাসায়নিক ও হারবাল পণ্য ব্যবহার করে আমাদের দেশের নারীগণ ঘন কালো চুল পেতে চেষ্টা অব্যাহত রাখেন। বিয়ের বাজারে কোমর ছড়ানো চুলের মেয়েরও বেশ কদর আছে। অন্যদিকে পুরুষেরাও মাথায় টাক পড়ে গেলে বিভিন্ন ঔষধ ব্যবহার করেন, কেউ কেউ নকল চুল বা পরচুলা ব্যবহার করেন। আধুনিককালে একদম আসল চুলের মত করে হেয়ার প্লান্টেশনের ব্যবস্থাও উদ্ভাবিত হয়েছে। টাকাওয়ালা মানুষেরা টাক মাথায় চুল লাগিয়ে হারানো যৌবন পুনরোদ্ধার করেন!
চুল নিয়ে চুলোচুলিটা অবশ্য অধিক দেখা যায় নারী মহলের মধ্যে সংঘর্ষ তৈরি হলে অথবা শিক্ষক কখনো কখনো অমনযোগী শিক্ষার্থীকে চুল টেনে ধরে শাস্তি দিতেও পারেন। চুলের কলি ধরে টানলে সবচেয়ে বেশি ব্যথা অনুভূত হয়। মাথার ত্বকের ভিতরে থাকা চুলের গোড়ায় কিন্তু রক্ত নালী, তেলের গ্রন্থি, বিভিন্ন স্নায়ুর সংযোগ রয়েছে। তাই বিভিন্ন ধরনের প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহ করে চুলের স্বাস্থ্য ঠিক রাখে শরীরবৃত্তীয় অটোমেটিক প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়াও মস্তিষ্কের সিগন্যাল মেনে এটা সেটা উপাদান কমবেশি করে চুলকে দৌড়ের উপর রাখে। কারো চুল আশি বছর পর্যন্ত ঠিকঠাক থাকে কারোবা তিরিশেই ঝরা শুরু করে। তাই চুলের পুষ্টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ যত্ন ও রক্ষায়। কিন্তু জীনগত ইতিহাসের কারনে হাজার চেষ্টা করেও টাক পড়া বন্ধ করা যায় না, কারণ ঐ বংশের ধারাই টাকলা মার্কা!
আপনার চুলের মধ্যে বিলি কেটে দিলে আরামে ঘুমিয়ে পড়তে পারেন। এই যে সুখানুভূতি সেটা একজন টাক মাথার মানুষের পক্ষে অনুভব করার সুযোগ নেই। প্রেমিক অথবা প্রেমিকার আকর্ষনের কেন্দ্রে আছে একজনের কোলে অন্যজন মাথা রেখে চুলে হাত বুলিয়ে আদর দেবে! আর কবি মহল তো আছেই মেয়েদের লম্বা চুলের আকর্ষনে মহা রোমান্টিক কবিতা লিখে ফেলার জন্য। তবে চুলের কিছু বাড়াবাড়ি ব্যাপার অনেকসময় অনেককে বিব্রতবস্থায় ফেলে দিতে পারে। অনেকের শরীরের বিভিন্ন অংশে যেমন হাতে পায়ে বুকে বা পিঠে থাকে অতিরিক্ত ঘন চুল থাকে, খালি গায়ে তাদের দেখতে অন্যান্য লোমশ প্রাণী সদৃশ মনে হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে মেয়েদের শরীরে বা মুখে পরুষদের মত অতিরিক্ত চুল থাকলে তাদের চেহারায় নারী সূলভ কমনীয়তার অভাব দেখা দেয়, এতেও কেউ কেউ বিব্রত বোধ করতে পারে। অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তা বা প্রকৃতি সবকিছুই এমনভাবে সাজিয়ে রেখেছে মানুষের শরীরের প্রতিটি অংশে যার কম বা বেশি হলেই অস্বাভাবিক মনে হবে। এই পরিমিতিবোধ, এই যে সুবিন্যস্ত দেহ সৌষ্টব তার পিছনে লুকিয়ে আছে হাজারো রহস্য আর বিজ্ঞানের গবেষণা তথ্য। এসব নিয়ে ভাবতে গেলে, রহস্য উদ্ঘাটনে রাতের পর রাত পার করলেও সমাধান খুঁজে পাওয়া যাবে না। জানার তৃষ্ণা আরো বেড়ে যাবে, সেই রহস্য ভূবনে সাঁতরে কেউবা হয়ে উঠবেন সৃষ্টিকর্তার প্রতি মহা কৃতজ্ঞ কেউবা হবেন প্রকৃতির কাছে বিশাল ঋণী।
(চলবে…………………………………………)
দৈনিক আলোকবর্তিকা ডেস্ক।