আমি মোটর বাইক চালাতে গিয়ে বেশ কয়েকবার দূর্ঘটনার কবলে পড়েছি একসময়। মোটর বাইক দূর্ঘটনায় খুব সাধারণ ক্ষত হিসেবে হাটু ও হাতের কনুইয়ের চামড়া বা ত্বক উঠে গিয়ে শরীরের মাংস একটু উঁকি দেয়। এছাড়া গরু, ছাগল, হাঁস বা মুরগীর চামড়া তুলে প্রক্রিয়াজাত করার দৃশ্যের সাথে আমরা সকলেই পরিচিত। কেউ যদি সহজে কোন কথায় কর্ণপাত না করে বা কোন দাবীর ব্যাপারে সাড়া না দেয় অথবা গালিগালাজ শুনেও কোন প্রতিক্রিয়া প্রকাশ না করে তখন আমরা বলি- লোকটার বুঝি গন্ডারের চামড়া! তো আসুন আমরা যদি আমাদের শরীরকে ত্বক শূন্য কল্পনা করি তাহলে তা দেখতে কেমন লাগবে? আমার ধারনা সেক্ষেত্রে চামড়া ছোলা গরু বা মুরগীর শরীরের চেয়েও ভয়ঙ্কর দর্শন হবে দেখতে। তাই মানুষের শরীরের প্রতিটি অংশ ত্বকের দ্বারা সুরক্ষা দিয়ে বহু যত্নে সৃষ্টি করেছেন মহান সৃষ্টিকর্তা একথা নির্ভাবনায় বলা যায়। তবে আপনি সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসী না হলেও মানতে বাধ্য হবেন মানুষের বা অন্যান্য প্রাণীদের শরীরকে আবৃত রাখতে ত্বকের অপরিসীম গুরুত্ব রয়েছে।
আসুন ত্বকের প্রচলিত সংজ্ঞা জেনে নিই, “ত্বক হচ্ছে মেরুদন্ডী প্রাণীর বহিরাঙ্গিক একটি অংশ যা প্রকৃতপক্ষে একটি নরম আবরণ এবং দেহকে আবৃত করে রাখে। এটি প্রাণীদের ভিতরের অংশগুলোকে রক্ষা করে। এটি মানবদেহের সবচেয়ে বড় অঙ্গ।”
ত্বকের সাধারণ কাজ কি কি?
ত্বক পারিপার্শ্বিক পরিবেশের সাথে সংযোগ স্থাপন করে এবং বাহ্যিক প্রভাবের বিরুদ্ধে এটি দেহের প্রাথমিক রক্ষক। রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুর বিরুদ্ধে ও শরীর থেকে অতিরিক্ত জল অপসারণ প্রতিরোধে ত্বক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ত্বকের সাথে থাকা স্নায়ু প্রাথমিকভাবে পরিবেশের ঠান্ডা বা গরমের অনুভূতি বুঝতে সহায়তা করে। এছাড়া অন্তরক, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রক, ইন্দ্রিয় ও ভিটামিন ডি উৎপাদক হিসেবে ত্বক কাজ করে। ত্বক শরীরকে সূর্যের অতি বেগুনী রশ্মি বা আলট্রা ভায়োলেট রে থেকেও রক্ষা করে।
ত্বকের কয়টি স্তর? তাদের কাজই বা কি কি?
মোটা দাগে ত্বকের তিনটি স্তর- এপিডার্মিস (বহিঃত্বক), ডার্মিস (মধ্যত্বক) এবং হাইপোডার্মিস (অন্তঃত্বক)। অর্থাৎ কারো চামড়া ছুলে কেটে লবন লাগিয়ে দিতে চাইলে এই তিনটি স্তর আগে পেরুতে হবে আপনাকে! প্রতিটি স্তরের রয়েছে নিজ নিজ কাজ। এপিডার্মিস (বহিঃত্বক) সাহেবকে আপনি নিজেই ছুঁয়ে দেখার সুযোগ পেয়ে থাকেন বা আপনাকে কেউ ছুঁয়ে দিলে শুধু এপিডার্মিস পর্যন্ত পৌঁছানো সম্ভব। এখানে কেরাটিন নামক এক ধরনের আমিষ অন্যান্য আমিষের সমন্বয়ে ত্বকের কোষ ও এই স্তরটি তৈরিতে ভূমিকা রাখে। আশ্চর্য হবার মত তথ্য হলো এই এপিডার্মিস প্রতিনিয়ত আমাদের দেহে নতুন ত্বক উৎপাদন করে চলে। এই কর্মকান্ডের ফলে ত্বকের পুরানো কোষ নতুন কোষের দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয় এবং আপনার অজান্তেই প্রতিমাসে আপনি নতুন ত্বক পেয়ে যান। তবে ইনি কিন্তু মেলানিন নামক রঞ্জক পদার্থ ধারণ করেন এবং আপনার ত্বকের রঙের জন্য ইনিই দায়ী! এপিডার্মিসে যত বেশি মেলানিনের উপস্থিতি আপনার ত্বক ততোই কালো বর্ণ ধারণ করবে। তাহলে কি কালো রঙের ত্বকের অধিকারীগণ এই স্তরটি রেগেমেগে ঘষে তুলে ফেলবেন? ভুলেও তা করতে যাবেন না, কেননা আপনার দেহের প্রধান প্রতিরক্ষা প্রহরী হিসেবে এই স্তরটিই প্রধান ভূমিকা পালন করে থাকে।
এখন প্রশ্ন হলো যে বা যারা মানুষের ত্বকের রঙ নিয়ে বিরূপ ধারণা পোষণ করেন বা কেউ কাউকে কালো রঙের বলে কটাক্ষ করেন সেটি করার কোন বৈধ ভিত্তি কি কারো আছে? মেলানিন কম থাকলেই বরং মানুষের দেহের রঙকে আমাদের অপছন্দ করা উচিত, কারন যেকোন জিনিষের ঘাটতিকে আমরা ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখি না। কিন্তু আমাদের মনুষ্য সমাজে এই একটি ব্যাপারে উল্টো নিয়ম চলে। যার ত্বকের এপিডার্মিসে মেলানিনের ঘাটতি আছে তাদের আমরা ফর্সা বা সুন্দরের তকমা দিয়ে থাকি। এটা পুরোপুরি সৃষ্টি ও সৃষ্টিকর্তার সাথে বেয়াদবি করার শামিল বলে আমার মনে হয়। এই মেলানিন কম বা বেশী হওয়ার উপর কারোরই নিয়ন্ত্রণ নেই, এটি জীনগত ঐতিহ্য এবং বৈশ্বিক তথা ভৌগলিক অবস্থানগত কারণে নির্ধারিত হয়ে থাকে। আফ্রিকার আদিবাসীরা কুচকুচে কালো সেও ঐ মেলানিনের অতিরিক্ত পরিমাণে উপস্থিতির প্রভাবে। আবার আমাদের পাহাড়ি আদিবাসীদের ত্বকের রঙ ফেড বা হলদে বা ফর্সা সেটিও মেলানিনের কম উপস্থিতিজনিত কারণে হয়। অন্যদিকে শীত প্রধান দেশের মানুষের ত্বকে মেলানিনের উপস্থিতি এতোই কম যে তাদের ত্বকের রঙ কটকটে সাদা, অনেকটা শ্বেতী রোগে আক্রান্তদের মতো।
তাই সৃষ্টির গূড় তত্ত্বকে উল্টে দেবার মতো বোকামি আমাদের করা উচিত নয়। ভেবে দেখুন কোন কারণে যদি আমাদের দেহের উপরের এই আবরণ হিসেবে ত্বকের উপস্থিতি না থাকতো তাহলে কি সবার বহিরাঙ্গের রঙ একই রকম হতো না? আসুন সেভাবেই না হয় চিন্তা ভাবনার জায়গাটিকে আমরা প্রসস্থ করে নিই, অকারণে সৃষ্টির রহস্য ও তত্ত্বের সাথে সাংঘর্ষিক ভাবনায় থাকার প্রয়োজন কি? আসলে তো কালো আর সাদা বাহিরে কেবল, ভিতরে সবার সমান রাঙা। কবি তো আর সাধে একথা বলেননি, অনেক গভীরভাবে চিন্তা করেই তিনি বিজ্ঞানের রহস্যের ব্যাপারটি বুঝেই বলেছেন এ কথা। আমাদেরও উচিত দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন, অনেকেই গায়ের রঙ কালো দেখে নাক সিটকান বা নিজের সাদা রঙ নিয়ে গর্ব দেখান। আসলে তত্ত্বগতভাবে ত্বকের রঙ নিয়ে তারতম্যের বিষয়ে কথা বলাটা একটা মূর্খামি অথবা অসভ্যতা। কারন বিজ্ঞানের এতো এতো উন্নয়নের যুগে এসেও কিন্তু মেলানিন হ্রাস বৃদ্ধি করিয়ে কাউকে জন্ম দেয়ানোর উপায় এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। তাই সৃষ্টির প্রাকৃতিক উপায়ে পাওয়া ত্বকের রঙ নিয়ে রঙ্গ তামাশায় মেতে না ওঠাই শ্রেয়।
(চলবে———————————-)
দৈনিক আলোকবর্তিকা।
Leave a Reply