মাথার চুল ও মানুষের শরীরের বহিরাবরণ ত্বক নিয়ে গত চারটি পর্বে আলোচনা তথা আমার সীমিত জ্ঞানের কিঞ্চিৎ ঝালাই করার পর মানব শরীরের হেড অফিস বলে খ্যাত মাথা নিয়ে এবারের পর্বগুলো সাজাবো। আমি আগেই বলেছি মানব শরীরের রহস্যময় গঠন ও কার্যক্রম আমাকে শুধুই বিস্মিত করে! তাই বিস্ময়ের ঘোর কাঁটাতে কিছুটা শরীর বিজ্ঞানের আংশিক জ্ঞান আহরণের পাশাপাশি পাঠকদের সাথে ভাগাভাগি করে নেয়ার চেষ্টা করছি।
মাথার খুলির গঠন নিয়ে আলোচনার আগে আমার বিস্ময়ের বিষয়গুলো নিয়ে একটু ভাবনার জগতে প্রবেশ করে দেখি কি রহস্য লুকিয়ে আছে সেখানে। একটা কম্পিউটারের সিপিইউ এর মতো মাথায় থাকা ঘিলু বা মস্তিস্ক আমাদের শরীরের যাবতীয় ডাটা প্রসেসিং এর কাজ করে। খুব সাধারণভাবে যদি বলি আমাকে আঘাত করলে ব্যাথার অনুভূতি তখুনি অনুভব করবো যখন মস্তিস্ক আমাকে জানান দেয়ার ব্যবস্থা করবে। যেমন অপারেশনের সময় শরীরের অংশ কেটে ফেলা হলে আমরা ব্যাথা অনুভব করি না কারন এনেস্থেসিয়া করে মাথার সাথে যুক্ত স্নায়ুগুলোকে সাময়িক সময়ের জন্য অকেজো করে রাখেন ডাক্তার সাহেবগণ। তাই কোনভাবে যদি আমাদের মস্তিস্ককে অকেজো করে দেয়া যায় তাহলে আপনাকে দিয়ে যা খুশি করানো সহজ হয়ে যাবে। আজকাল শোনা যায় ডেভিল ব্রেথ নামক একটি রাসায়নিক ব্যবহার করে নাকি কিছু সময়ের জন্য মানুষের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে ছিনতাই, চুরি, ডাকাতির মতো দূর্ঘটনাগুলো ঘটায় দূর্বৃত্তরা।
মস্তিস্ক বিকৃতি ঘটে স্বাভাবিক মানুষের জীবনে কতটা দূর্ভোগ নেমে আসতে পারে তা আমরা আমাদের চারপাশে চোখ রাখলেই দেখতে পাই। সেই ব্রেইন বা ঘিলু সুরক্ষার জন্য সৃষ্টির অন্যতম প্রধান সতর্কতা অবলম্বন করে মাথার খুলিকে তৈরি করা হয়েছে। এছাড়া মাথার খুলির সাথে মানুষের মুখাবয়াব এমনভাবে সংযুক্ত করে রাখা অনেকটা ভিত্তি ছাড়া উন্মুক্ত কলামের মতো। আমি মোটর সাইকেলের চাকার সাথে উপরি কাঠামোর সংযুক্ত করার সাধারণ প্রযুক্তি দেখেই হা হয়ে যাই। আর এইভাবে জীবন্ত মানুষের মাথার খুলি ও চোয়ালের অংশের নিখুঁত সংযোগ কিভাবে সম্ভব? হাসন রাজার গানের সুরে বলতে হয় “লোকে বলে বলেরে ঘর-বাড়ি ভালা নাই আমার, কি ঘর বানাইমু আমি শূণ্যের মাঝার।” এবার আসুন দেখি মাথার খুলি কিভাবে গঠিত হয়।
মানুষের খুলি একটি অস্থিনির্মিত কাঠামো, যা মানব-কঙ্কালের মস্তক গঠন করে। এটি মুখের কাঠামো ধরে রাখে এবং মস্তিষ্কের জন্য একটি গহ্বর তৈরি করে। অন্যান্য মেরুদণ্ডী প্রাণীর খুলির মত এটিও মস্তিষ্ককে বাইরের আঘাত থেকে রক্ষা করে।
মানুষের খুলির তিনটি পৃথক অংশ আছে, যেগুলোর ভ্রূণগত উৎপত্তিও ভিন্ন ভিন্ন- নিউরোক্রেনিয়াম, সুচার এবং মুখমণ্ডলীয় অস্থিকাঠামো (বা মেমব্রেনাস ভিসেরোক্রেনিয়াম)। নিউরোক্রেনিয়াম (বা মস্তিষ্কের বাক্স), মস্তিষ্ক ও ব্রেইনস্টেম কে আবৃত ও সুরক্ষিত করার জন্য সুরক্ষা গহবর তৈরি করে। খুলির উপরিভাগের হাঁড়গুলো একসাথে ক্যালভেরিয়া (বা খুলির টুপি) তৈরি করে। মেমব্রেনাস ভিসেরোক্রেনিয়াম এ ম্যান্ডিবল হাঁড়টিও অন্তর্ভুক্ত। সুচার হল নিউরোক্রেনিয়াম এর হাঁড়গুলোর মধ্যকার দৃঢ় সংযোগস্থল। মুখমণ্ডলীয় অস্থিকাঠামো তৈরি হয় মুখমণ্ডল গঠনকারী হাঁড়সমূহ দ্বারা।
এই যে নিউরোক্রেনিয়াম যেটিকে ঘিলুর বাক্স বলা হয়, এটি শরীরের সর্বোচ্চ উপরে থাকে এবং মস্তিস্ককে চারিদিক দিয়ে ঘিরে রাখে। একবার ভেবে দেখি আমাদের মাথার খুলির এই অংশটি যদি কিছুটা নরম হাড়ের দ্বারা তৈরি করা হতো অথবা শরীরের অন্যান্য অংশের মতো শুধুমাত্র ত্বক দিয়ে আবৃত হতো কি বিপদটাই না ঘটতে থাকতো প্রতিনিয়ত? সামান্য এদিক ওদিক হলেই ব্রেইনের ইনজুরিতে পড়তাম আমরা, কেউ ইচ্ছে হলেই মাথায় একটা থাপ্পড় মেরে ভবলীলা সাঙ্গ করে দিতো নিমেষে। তাই সৃষ্টিকর্তা অথবা প্রকৃতির তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষনের আলোকে মানব দেহের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্রেইন বা ঘিলুকে সুরক্ষিত রাখতে এই আয়োজন। যদিও প্রচন্ড আঘাতে বা দূর্ঘটনায় মাথা ফেটে ঘিলু বের হয়ে যাবার মর্মান্তিক দৃশ্য আমাদের চোখে পড়ে।
মোট আটটি হাড়ের সংযোগে নিউরোক্রেনিয়াম গঠিত থাকে, সেই ৮টি হাঁড় হল- অক্সিপিটাল হাঁড়, একজোড়া টেম্পোরাল হাঁড়, একজোড়া প্যারাইটাল হাঁড়, স্ফেনয়েড হাঁড়, ইথময়েড হাঁড় ও ফ্রন্টাল হাঁড়। এরমধ্যে ফ্রন্টাল বোন কি তা একটু ইংরেজিতে দেখি-
(চলবে———————————-)
দৈনিক আলোকবর্তিকা।
mazhabkh93@gmail.com
Leave a Reply