সকল মেরুদণ্ডী প্রানীর রক্ত যেমন লাল তেমন প্রতিটি মেরুদণ্ডী প্রজাতির আভ্যন্তরীণ দেহ কাঠামো প্রায় সমরূপ। সামান্য এদিক ওদিক থাকলেও আমরা যদি মানুষকে মাংস ও চর্মহীন হিসেবে কল্পনা করি তাহলে মাথা থেকে পা পর্যন্ত আমাদের যে কঙ্কাল আছে তার মধ্যে পুরোপুরিই সাদৃশ্য বিদ্যমান। তাই নাম বা আইডি নাম্বার না লেখা থাকলে আপনার বা আমার মুখমণ্ডলের এক্স-রে দেখে কোনভাবেই সনাক্ত করা সম্ভব নয় এইটি কার বা ওইটি কার? এমনকি মাথা বিহীন দেহের বাকী অংশটুকুও কিন্তু একজনের থেকে আর একজনকে আলাদা করা দুরূহ। একমাত্র আপনাতে আমাতে পার্থক্য করার সহজ উপায় হলো মুখের চেহারার ভিন্নতা। সেক্ষেত্রে যমজ হলে মুখের চেহারায় আলাদা করাটাও আমাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়, শুধুমাত্র যমজদের আপনজনেরা বিশেষ কোন বৈশিষ্ট্য বুঝে তাদের সনাক্ত করতে পারে।
তাহলে ব্যাপারটা কি দাঁড়াচ্ছে? আমরা দেখি একমাত্র মানুষ প্রজাতি ছাড়া প্রাণীকূলের আর সকল প্রজাতির মুখের চেহারা একই! দুটি বাঘ অথবা একশটি বাঘ সবার চেহারাই একই, একটি পিঁপড়া অথবা এক লক্ষ পিঁপড়া সব দেখতে একই রকম। একই প্রজাতির সব পাখিগুলো অথবা শুঁয়ো পোকাদেরও চেহারায় কোন ভিন্নতা নেই। শুনেছি ডাইনোসর বিলুপ্ত হয় গেছে কিন্তু তেলাপোকা টিকে আছে, সেই একই প্রজাতির তেলাপোকাদের সবার চেহারাই একই। কেমন যেন তালগোল পাঁকিয়ে ফেলি এই মানুষে মানুষে চেহারায় ভিন্নতার ব্যাপারটি ভাবতেই! আহারে আমাদের নিকটতম প্রজাতি বানর হনুমানের মতোই তো আমাদেরও সবার চেহারায় সাদৃশ্য থাকতে পারতো? শুধুই কি প্রত্যেকের জীনের আলাদা আলাদা সংকেতের ব্যখ্যা দিয়ে এই চেহারার ভিন্নতার ব্যাখ্যার সমাধানে মন ভরে? কি যেন একটা গোপনীয় জ্ঞান লুকিয়ে আছে এই ভিন্ন ভিন্ন চেহারার মানুষের আড়ালে!
আপনার মুখের উপর মাংসপেশী ও চামড়ার প্রলেপের কারনেই আপনি আমার থেকে চেহারায় ভিন্ন। অনেকটা শিল্পীর ছবি আকার মতো, শিল্পী তুলির আঁচড়ে এদিক সেদিক করেই ভিন্ন ভিন্ন চেহারার ছবি আঁকতে পারে। আমাদের এই মুখমন্ডলের চেহারা এঁকেছেন বোধহয় সেই সুমহান শিল্পী, তাঁকে কেউ আমরা সৃষ্টিকর্তা বলে জানি কেউ আবার বলি প্রকৃতি! যে যাই বিশ্বাস করি ক্ষতি নেই কিন্তু মাংসপেশি আর চর্মহীন অংশের নাম যে বিজ্ঞানীরা দিয়েছেন মেমব্রেনাস ভিসেরোক্রেনিয়াম। আশা করি এই বিষয়ে কেউ বিতর্ক করতে আসবেন না, কারন মুখমণ্ডলের এই হাড়গুলো মুখের কাঠামো ধরে রাখে এবং মস্তিষ্কের জন্য একটি গহ্বর তৈরি করে। অন্যান্য মেরুদণ্ডী প্রাণীর খুলির মত এটিও মস্তিষ্ককে বাইরের আঘাত থেকে রক্ষা করে।
মেমব্রেনাস ভিসেরোক্রেনিয়াম এ দুই ধরনের হাড় থাকে, জোড় হাড় হাড় আর একক হাড়। জোড় হাড়্গুলোর মধ্যে রয়েছে- ল্যাক্রিমাল হাড়, নাসাল হাড়, জাইগোমেটিক হাড়, প্যালাটাইন হাড়, ম্যাক্সিলা, ইনফেরিওর নাসাল কোন্সা। আর একক হাড় দুটি হলো- ভোমার ও ম্যন্ডিবল। এই হাড়্গুলোর প্রত্যেকটির আলাদা আলাদা কর্ম সম্পাদনের দায়িত্ব রয়েছে, এই হাড়্গুলোই সম্মিলিতভাবে আমাদের প্রিয় মুখমণ্ডল গড়ে তোলে, এই হাড়গুলোর কম্বিনেশন পারমিউটেশনের জেরে আমাদের চেহারায় ভিন্নতা আসে। কার নাক খাড়া হবে আর কার বোঁচা তা কিছুটা নির্ভর করে নাসাল হাড়, ভোমার এবং ইনফেরিওর নাসাল কোন্সা'র অবস্থান ও আকৃতির উপর। অনেক সময় আমরা বলে থাকি এক ঘুষি মেরে মুখের মানচিত্র বদলে দেবো, আসলে এই হাড়গুলোর দফা রফা করতে পারলে আপনাআপনি মুখের মানচিত্র তথা চেহারা সত্যিই বদলে দেয়া যেতেই পারে!
মেমব্রেনাস ভিসেরোক্রেনিয়াম এ অবস্থিত ম্যাক্সিলার কাজগুলো সবচেয়ে বিস্তৃত, বলা যায় আমাদের বাহ্যিক চেহারার ধরন কেমন হবে এই অংশটি তার ভিত হিসেবে কাজ করে। আসুন বিস্তারিতভাবে দেখে নিই ম্যাক্সিলার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাগুলো কি কি?
উপরের উল্লেখিত সম্মিলিত কাজগুলো সম্পন্ন করার মাধ্যমে ম্যাক্সিলা মুখের বহিরাবরণ, দাঁতের বিন্যাসের জন্য কাঠামো সহযোগিতা এবং মুখ ও নাকের গহ্বরের কাজগুলোকে সহায়তা দিয়ে থাকে।
তাই আমাদের সকলের শরীরের আভ্যন্তরীণ কাঠামো যেখানে সমরূপ সেখানে বাহ্যিক চেহারার গুরুত্ব দেয়াটা খুবই অসমীচীন। দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য আমরা মানুষ তাবৎ পৃথিবীতে লক্ষ কোটি প্রজাতির চেহারার সাদৃশ্য দেখেও কিছুই শিখি না। আমরা বাহ্যিক চেহারা, রূপ ও দেহের রঙ নিয়ে গর্ব করি অথবা কাউকে হেয় করি অপ্রচলিত চেহারার ধরনের কারনে। অথচ মানুষের চেহারার ভিন্নতার জন্য আমাদের কারো হাত নেই যেমন দুইটি বিড়ালের একই চেহারায় তাদেরও কোন হাত নেই। আমরা ইচ্ছে করলেই ত্বকের প্রাকৃতিক রঙ বদলে ফেলতে পারি না, আমরা আফ্রিকান বংশোতভূত কালো নাকি ইউরোপিয়ান সাদা চামড়ার সেই বিভেদ সত্যিই খুবই হতাশার। এই সাদা-কালোর বিভেদ, জাতি-বর্ণের বিভেদ, দেশ-ধর্মের বিভেদ করে পৃথিবীতে চিরটাকাল শুধুই অশান্তির ইতিহাস রচিত হয়েছে। আমরা আভ্যন্তরীণ অবকাঠামোতে একই রূপের হলেও বাহ্যিক চেহারার পার্থক্যকেই প্রাধান্য দিয়ে যুগে যুগে শ্রেণী শোষণ ও বৈষম্যকে লালন করে চলেছি।
(চলবে———————————-)
দৈনিক আলোকবর্তিকা।
mazhabkh93@gmail.com