পেশায় আমি শিক্ষক নাহলেও আমার রক্তে রয়েছে শিক্ষক সত্ত্বা। আমার মরহুম দাদা ছিলেন স্থানীয় মক্তবের মৌলবী শিক্ষক। তিনি মানুষের কাছে ছিলেন পরম সম্মানীয়। আমাদের গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক তালিকা বোর্ডে আমার দাদার নাম এখনো লেখা আছে। আমার মরহুম নানার একমাত্র পরিচয় বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ হিসেবে, তিনি ইংরেজি বিষয়ে পণ্ডিত ছিলেন। আমার নানার লেখা ইংরেজি গ্রামার বইটি একসময় দেশের বিভিন্ন বিদ্যালয়ে পাঠ্য বই হিসেবে বেশ প্রচলিত ছিলো। নানার জন্ম খুলনার ফুলতলার পায়গ্রাম কসবা গ্রামে হলেও তিনি নিজের জীবনের অধিকাংশ সময় শিক্ষার জন্য ব্যয় করেছেন ভিন্ন এলাকায়। তিনি পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠি উপজেলার মঠবাড়িয়াতে কেএম লতিফ ইনিস্টিটিউট এর প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক ছিলেন। বাবা ও মায়ের দুই পক্ষ থেকেই শিক্ষকদের উত্তরাধিকার প্রাপ্ত হলেও আমি পেশাগত জীবনে শিক্ষকতা করছি না বটে কিন্তু এমন গৌরবের রক্তের উত্তরাধিকার হিসেবে আমার ভিতরে শিক্ষক সমাজের প্রতি গভীর ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাবোধ চিরদিনের।
সেই ধারাবাহিকতায় মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী থাকাকালীন অসাধারণ কিছু শিক্ষকবৃন্দের সাহচর্য পাবার সুযোগ পেয়েছি। বিদ্যালয় ও শিক্ষার্থীদের কল্যানে নিজেদের সবটুকু নিংড়ে দিতে দেখেছি শ্রদ্ধেয় সেই শিক্ষকবৃন্দকে। ১৯৮৪ সালে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকে আমার মত অন্তর্মূখী চূড়ান্ত আনস্মার্ট আনকালচারড নিভৃত পল্লীতে বসবাস করা একজন শুয়োপোকা শিক্ষার্থীকে প্রজাপতির রঙিন ডানা দিয়ে আকাশে উড়তে শেখানো মানুষগুলো ছিলেন আমার সেই অজ পাড়া গাঁয়ের শ্রদ্ধেয় শিক্ষকবৃন্দ। তাঁদের অসংখ্য সীমাবদ্ধতা ছিলো, শুধুমাত্র চরম আন্তরিকতা, শিক্ষক হিসেবে অপরিসীম আত্মনিবেদন আর পেশার প্রতি সর্বোচ্চ দায়বদ্ধতা থেকে আমার মত হাজার হাজার শিক্ষার্থীদের গড়ে পিঠে তুলেছেন সমাজ ও দেশের উপযুক্ত নাগরিক হিসেবে।
আমার দৃড় বিশ্বাস মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত জীবনের যা কিছুই অর্জন করেছি পরবর্তী জীবনে উল্লেখযোগ্য আর কিছুই অর্জিত হয়নি। জ্ঞান থেকে শুরু করে আচার ব্যবহার আদব কায়দা চরিত্র মেধা, অংক বাংলা ইংরেজি, খেলাধুলা এমনকি প্রেম ভালোবাসার অনুভূতিসহ এই লেখালেখির অভ্যাস পর্যন্ত। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধুমাত্র বড় সিলেবাস নিয়ে চর্চাটি হয়েছে, অর্থাৎ আমার মত অধিকাংশ শিক্ষার্থীর জীবনে মাধ্যমিক স্তরটি জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। তাই মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অনেকটা সৃষ্টিকর্তার গুণাবলী থাকা অত্যাবশ্যক। কারন জন্মের পর আমরা কাদামাটির মিশ্রণ থাকি মাত্র, সেই কাদামাটিকে মানুষের রূপ দেয়ার শ্রেষ্ঠ্য রূপকার আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষকবৃন্দ।
সঙ্গত কারনে অধিকাংশ শিক্ষার্থীদের জীবনে নিজ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ব্যতীত অন্য বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাছ থেকে দেখার সুযোগ পায় না। বিরল ক্ষেত্রে বা সরকারি চাকুরীজীবীদের সন্তান হলে অভিভাবকদের বদলী জনিত কারনে অথবা অন্য বিদ্যালয়ের শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়ার ফলে বিভিন্ন বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সাহচর্য পাবার সুযোগ পেতে পারে কেউ কেউ। সে হিসেবে আমরা খুব স্বল্প সংখ্যক শিক্ষকদের কাছ থেকে শিক্ষা জীবনের জ্ঞান অর্জন সহ অন্যান্য ব্যবহারিক শিক্ষা অর্জন করার সুযোগ পাই। তবে পরবর্তী জীবনে আমার অসংখ্য বন্ধু পরিচিতদের কাছ থেকে তাদের বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গল্প শুনে এটুকু বুঝেছি অধিকাংশক্ষেত্রে শিক্ষকগণ শিক্ষার্থীবান্ধব ও আদর্শবান ছিলেন। সারা দেশের প্রেক্ষাপটেও আমরা ধরে নিতে পারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ এদেশের শিক্ষার মেরুদণ্ড হিসেবে সেবা দেন। শিক্ষা খাতের তথা সমাজের এমন মহাগুরুত্বপূর্ণ অঙ্গটি যদি সুস্থ স্বাভাবিক না হয় তা হতে পারে জাতির জন্য মহা বিপর্যয়কর!
আমি যদি আমার শৈশবের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বর্তমান শিক্ষকবৃন্দের উদাহরণ দিই তাহলে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে অবস্থিত বিদ্যালয়গুলোর সার্বিক চিত্র কিছুটা অনুমান করা যাবে। হাতে গোনা কয়েকজন সিনিয়র শিক্ষক ব্যতীত অধিকাংশ জুনিয়র শিক্ষক নিয়োগ পেয়েছেন মোটা অংকের ঘুষের বিনিময়ে। তাঁদের মধ্যে একজন শুধুমাত্র পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রী গ্রহণ করেছেন। অন্যান্য ২০ জন শিক্ষকের শিক্ষাগত যোগ্যতা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বা মাদ্রাসা থেকে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা। অর্থাৎ খুব পরিষ্কারভাবে ধারনা পাওয়া সম্ভব যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রীধারী অধিকতর মেধাবীরা খুব দায়ে না পড়লে অজপাড়া গাঁয়ের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন না। সব গ্রামীন বিদ্যালয়ের চিত্র হয়তো এক নয়, মেধাবীদের কেউ কেউ শিক্ষকতার প্রতি প্রকৃত ভালোবাসা থেকেও মহান পেশায় যোগ দেন। তবে নিঃসন্দেহে বলা যায় উপজেলা বা জেলা পর্যায়ের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে মেধাবী শিক্ষকদের পরিমাণ অনেক বেশি।
এমনতর পরিস্থিতিতে শিক্ষার সার্বিক মানের অবনয়নে আমাদের সময়ের সাধারণ এইচএসসি পাশ শিক্ষকগণও যেটুকু সুদক্ষ হতেন এখনকার স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা শিক্ষকও সেই দক্ষতার পঞ্চাশ ভাগ প্রকাশ করতে পারেন না মেধা, সততা, আন্তরিকতা ও পেশাদারিত্বের অভাবের কারনে। এখনকার শিক্ষকদের মধ্যে শিক্ষকতার মহান আদর্শ পুরোপুরিই বিলুপ্ত, অন্যান্য পেশার মতোই টাকা কামানো আর বস তোষণ করার মেরুদন্ডহীনতাই তাঁদের গ্রাস করে ফেলেছে। শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের চেয়ে অন্যান্য বিষয়ে শিক্ষকদের অধিকতর মনোযোগ, নিজেরা তো কেউ ক্লাসের প্রস্তুতির জন্য লেখাপড়া করেনই না তাই তাঁদের নিকট থেকে কোন নতুন বা উদ্ভাবনী শিক্ষা পায় না শিক্ষার্থীরা। আমাদের বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তো শ্রেণিকক্ষে পড়াতে গিয়ে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের আদিম রসাত্মক জোকস শুনিয়ে নিজেই আবার খ্যাক খ্যাক করে হাসেন বলে শুনেছি। এহেন চন্ডাল মার্কা শিক্ষকের নিকট থেকে কিইবা মহান শিক্ষা আমরা আশা করতে পারি?
চলবে ………………………………
পল্লব খন্দকার, ১১ অক্টোবর ২০২৩
mazhabkh93@gmail.com
Leave a Reply