“পাগল ছাড়া দুনিয়া চলে না”
শিরোনামের কথাটা একটা গান থেকে নেয়া। জগতে নানা রকমের পাগল আছে। মানুষের একেক রকম আচরণকে একেক রকমের পাগলামি বলে চিহ্নিত করা হয়। গানের লাইনে আছে ‘পাগল ছাড়া দুনিয়া চলে না’, তাহলে পাগলের সংখ্যা কি অনেক? সমীক্ষায় দেখা গেছে, আমাদের বাংলাদেশেই শুধু মানসিক রোগীর সংখ্যা সাড়ে তিন কোটির মতো। এরা কারা? সবাই কি বিবস্ত্র হয়ে রাস্তা দিয়ে ঘুরে বেড়ায়? উন্মাদনায় চারপাশ অস্থির করে তোলে? না। আসলে বাইরে থেকে খুব সুস্থ ও মসৃণ জীবন যাপনে অভ্যস্ত অসংখ্য মানুষ আছে সমাজে, যারা সত্যিকারের মানসিক রোগী। তাদের নানান আচরণে ভয়াবহ প্রভাব যাপিত জীবনে।
রাস্তায় বিবস্ত্র হয়ে থাকা পাগলে আর আমরা যারা ঘরে বাস করা পাগল আছি তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড়ো একটা পার্থক্য হলো ওরা যেটা মন চায় সেটা করতে পারে কিন্তু আমরা সমাজ, সংসার আর লোকলজ্জার ভয়ে সেটা করতে পারি না। এদিক থেকে ওদের বেশি স্বাধীন বলা যায়।
মানসিক রোগী থাকে ঘরের মধ্যেই। মানসিক রোগের লক্ষণ কী? স্বামী-স্ত্রী একত্রে বসবাস করে। স্বামী ব্যস্ত থাকে বাইরের কাজে। নিজের কাজে। সংসারেরই কাজে ব্যস্ত মানুষটা সময় দিতে পারে না তার স্ত্রীকে। স্ত্রীর মধ্যে যদি মাত্রাতিরিক্ত সন্দেহ বাতিকতা থাকে, তাহলে তার মানসিক রোগের দেখাটা পাওয়া যায় তার প্রাত্যহিক আচরণেই। স্বামীর বাইরে অবস্থান যদি যৌক্তিকও হয়, তবু স্ত্রী তাকে ভেবে নেয় অন্য কোনো সম্পর্কের প্রতি মনোযোগ মনে হয়, আবার স্বামীর উপার্জনের কত টাকা কোন খাতে ব্যয় হচ্ছে, তা নিয়েও প্রথমে সংশয় তারপর তা নিয়ে যুদ্ধ।
স্ত্রী মনে করে, তার স্বামী ঘরে টাকা না নিয়ে এসে বাইরে গচ্ছিত রাখছে। এসব থেকে প্রতিদিন কথা কাটাকাটি তারপর অনাকাঙ্ক্ষিত চিৎকার চেঁচামেচি চলে বিরামহীন। আবার যে স্ত্রী থাকে ঘরের মধ্যে, সারাদিন ব্যস্ত থাকে সংসারের কাজে অথবা যে স্ত্রী কর্মজীবী, তাকে নিয়ে স্বামীর যা তা রকমের সন্দেহ। ঘরে অবস্থানরত স্ত্রী ফোন ধরতে দেরি করছে কেন, কেন কর্মজীবী স্ত্রী দেরি করে ঘরে ফিরছে, এ নিয়ে চলে তুমুল অভিযোগ। পৃথক না হয়েও উভয়ে কাটায় ভিন্ন জীবন। এই দৃশ্য এখন প্রায় ঘরে ঘরেই।
মানসিক রোগের বড় প্রাদুর্ভাব দেখা যায় প্রেমিক প্রেমিকার মধ্যে। সন্দেহ নির্ভর ও অযৌক্তিক অভিযোগের ক্ষেত্রে দুজনে থাকে সমানে সমান। একজন যদি ফোনের ওয়েটিংয়ে থাকে বাকিজন তাৎক্ষণিক উন্মাদ হয়ে যায়, একজন যদি ফোন বন্ধ রাখে বাকিজন ভালোবাসার অস্থিরতার চেয়ে অভিযোগের পাল্লা ভারী করে আরেকজনের বাড়ির দিকে রওনা হয়। ইদানীং ফেসবুকের কল্যাণে আমাদের সামনে মানসিক রোগের ছড়াছড়ি।
প্রেমিক কোন সুন্দরী মেয়ের ছবিতে লাইক দিয়েছে, প্রেমিকা কার ম্যাসেঞ্জারের কালার চেঞ্জ করে নীলের বদলে সবুজ করেছে, এইসব নিয়েও দুজনের মধ্যে চলে তুমুল বাকবিতণ্ডা আর সেই তর্কযুদ্ধের পর দুজনে থাকে দুজন থেকে বিচ্ছিন্ন, পরে জোড়া লাগে আবারও, কিন্তু যে সময় চলে যায়, তা আর ফেরে না। দুজনের মধ্যে সন্দেহবাতিকতা অথবা অকারণ ঝগড়ায় যে ক্ষতিটা হয়, তার মূলে থাকে ওই মানসিক রোগ। মানসিকভাবে সুস্থ থাকলে কারো মধ্যে এ রকম কিছু দেখা যায় না।
কর্মক্ষেত্রেও আমরা মানসিক রোগী দেখতে পাই। অফিসের কর্তাব্যক্তির মধ্যে যদি মানসিক সুস্থতা না থাকে, তিনি তার কর্মচারীদের সাথে অকারণেই খারাপ আচরণ করে। একটা গ্লাস হাত থেকে পড়ে গেলে গোটা অফিস ভাঙার মতো অভিযোগ এনে কর্মচারীকে শাস্তি দিয়ে থাকে। আবার অনেক কর্মচারী আছে, নিজের আলস্যের দায় বা দক্ষতাহীনতার দায় চাপায় উপরের কাউকে। নিজে কাজ পারে না, ভুল হলে কেউ যদি কিছু বলে বসে সে ভেতরে ভেতরে অভিমানী হয়, তার কাজের গতি আরো কমে যায়, ফলে অনিশ্চয়তায় ঢুকে যায় নিজের কেরিয়ারটাই। অনেক অফিসে দেখা যায়, পান থেকে চুন খসতেই কর্তাব্যক্তি তার কর্মচারীদের ঢালাও ছাটাই করছেন, আবার অনেক কর্মচারী নিজের দক্ষতার দিকে না তাকিয়ে অভিমান করে দুদিন বাদে বাদে অব্যাহতির খেলা খেলে। এইসব আচরণের মধ্যে যদি মানসিক স্থিতি থাকতো, তবে পরিবেশও হতো অনেক স্বস্তির।
ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে আমরা সবক্ষেত্রেই মানসিক রোগের আচরণ করে থাকি, এই সংখ্যাটা একেবারেই কম না। সারাদেশে যদি সত্যিই সাড়ে তিন কোটি মানসিক রোগী থাকে, তা ভয়ংকর অবশ্যই। মানসিক রোগের চিকিৎসার জন্য যতই মনোবিজ্ঞানীর কাছে যাওয়া হোক, তাতে আসলে লাভ কতটুকু? প্রথমে প্রয়োজন একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, নিজের প্রতি নিজের আচরণের সচেতনতা। এই শিক্ষাটা আসে পরিবার থেকে। পরিবারের মধ্যে মা-বাবার কেউ মানসিক রোগীর আচরণ করলে সন্তানের ওপর নিশ্চিত প্রভাব পড়ে। সন্তানের বেড়ে ওঠার আগেভাগে যদি নিজের বা নিজেদের আচরণের প্রতি সচেতন না হওয়া যায়, সারাদেশে মানসিক রোগীর সংখ্যা বাড়বেই। পৃথিবীর শান্তির জন্য শুরুতে নিজের শান্ত আচরণ অনেক বেশিই জরুরি।
বনানী ঘোষ, খুলনা থেকে।
খুব ভালো লাগলো ফিচারটা ।
খুব ভাল লাগলো, ধন্যবাদ