গতকাল এক আত্মীয়ের মৃত্যু ঘটেছে, ক্যান্সার ধরা পড়ার দুই মাসের মধ্যে এবং প্রথম কেমোথেরাপির পর খুব স্বল্প সময়ের ব্যবধানে তিনি মৃত্যুবরণ করলেন। রাত দুইটায় হাসপাতালে উপস্থিত হয়ে দেখলাম এক বেডে একজন ঘুমিয়ে আছেন জড় পদার্থের আদলে আর বাকি আত্মীয় স্বজন ভীড় করে কেউ দাঁড়িয়ে বা কেউ বসে মৃতের বিষয়ে বিভিন্ন আলোচনা করছেন। পরিবেশ অনেকটা এমন যে সবাই যেনো প্রস্তুত ছিলেন এই মৃত্যু মেনে নিতে, ঘটনাটা আমাকে বেশ নাড়া দিয়ে গেলো! কারন জীবনের একটা সময় দেখেছি মৃত ব্যক্তির ঘনিষ্ঠজনেরা উচ্চস্বরে বিলাপ করতেন সদ্য মৃত ব্যক্তির মৃতদেহ জড়িয়ে ধরে, কেউ বা জ্ঞান হারাতেন তীব্র শোকে। আমার নিজের দাদার মৃত্যু আমি নিজের চোখের সামনেই দেখেছিলাম। সবাই খবর পেয়ে ছুটে এলেন, বাড়ি ভরে গেলো আত্মীয় স্বজনের উপস্থিতিতে, দাদার শোকে আমাদের অনেক দূর সম্পর্কের আত্মীয়দেরও সুর করে কান্নার চিত্র আমার চোখে ভেসে ওঠে আজো। অথচ আমার দাদাও দীর্ঘদিন অসুস্থ ছিলেন, বয়সও হয়েছিলো সত্তরোর্ধ, সবাই জানতেন তিনি মৃত্যুর প্রহর গুনছেন। তারপরও সেই সবদিনে মানুষের শোকের তীব্রতা আমাকে আপ্লূত করতো, কারো কারো কান্না খুবই কৃত্রিম মনে হতো, সুর করে কাঁদতেন তাঁরা। সেসব নিয়ে অনেক কৌতুকও প্রচলিত ছিলো যে কিছু মানুষের স্বভাবই নাকি এমন যে তাঁরা সকল মৃতের জন্যই মেকি কান্নার অভিনয় করতে পারঙ্গম ছিলেন।
তবে কি মৃতদের জন্য মানুষের শোকের মাত্রা এখন ক্রমহ্রাসমান? এখানেই আমার ভাবনার জগতে কিছু লেখার তাগিদ তৈরি করলো। নিজেকেই প্রশ্ন করলাম আমিও এখন কতোটা শোকাবিভূত হই ঘনিষ্ঠ স্বজন অথবা জানাশোনা কারো মৃত্যুতে? আমার ছেলেবেলার এক খেলার সাথীর কি এক অজানা কারনে যেনো মৃত্যু ঘটেছিলো, আমি এখনো তাঁকে মৃত হিসেবে ভাবতে পারি না। সমবয়সীদের মৃত্যু আমাকে এখনো স্তব্ধ করে দেয়, শিশুদের মৃত্যু কিছুতেই মানা যায় না, অকারন যুদ্ধে মৃত্যু, দূর্ঘটনায় মৃত্যু সবই শোকের কারন হয়ে আমাদের মনকে নাড়া দিয়ে যায়। জন্ম যেদিন ঘটবে সাথে সাথেই মৃত্যুর ক্ষণ গণনা করার অমোঘ সত্যকে মেনে নেয়ার কোন বিকল্প নেই। মৃত্যুকে ঠেকিয়ে রাখার কোন কৌশলই আমাদের জানা নেই, এমনকি কারো পক্ষে জানাও সম্ভব নয় একজনের মৃত্যু কখন, কিভাবে বা কোন স্থানে হবে। এসকল পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনা করে তাই কারো মৃত্যুতে আমরা যে গভীর শোকাকিভূত হয়ে পড়ি তা কিন্তু অভিপ্রেত নয়। একজনের জন্মের সময় আমরা যে আনন্দ অনুভব করি আসলে সবার অগোচরে সেখান থেকেই শুরু হয়ে যায় মানুষের মৃত্যুর প্রস্তুতি। আমরা যখন কারো মৃত্যুতে ভেঙ্গে পড়ি বা অতিমাত্রায় শোক প্রকাশ করি তা বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। নিজের মৃত্যুর জন্য যেমন, ঠিক তেমন করেই যতো প্রিয়জনই হোন না যে কেউ, সকলের মৃত্যুর জন্যই আমাদের আগাম মানসিক প্রস্তুতি থাকা আবশ্যক।
তবে সহজ সত্য সহজেই যদি মেনে নেয়া যেতো তাহলে পৃথিবীর সকল মানুষের সহস্র প্রকার আবেগ, প্রেম, ঘৃণা, উচ্ছ্বাস এতোসব উপসর্গ ও বিশেষণ অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়তো। লক্ষ কোটি বছরের মানবজন্ম ইতিহাস পেরিয়েও তাই মৃত্যুশোককে আমরা উপেক্ষা করতে পারি না। আমরা যদি সুক্ষভাবে দেখার চেষ্টা করি যে, আসলে আমার জীবন বা প্রত্যেকের জীবন একটা সর্বোচ্চ সীমা বা বৃত্তে আবদ্ধ। আমি আমার দাদাকে দেখেছি, আমার দাদার বাবাকে দেখিনি, খুব সৌভাগ্যবান মানুষেরা বড় জোর অল্প সময়ের জন্য হলেও নিজের জীবদ্দশায় বাবা, দাদা ও দাদার বাবাকে দেখার সুযোগ পান। সবকিছু মিলিয়েও যদি দেখি একজন মানুষ জ্ঞানত তার জীবনের ১০০ বছর সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা সম্পন্ন হতে পারেন। কারন জন্মের ৩-৪ বছর থেকে স্মৃতির শুরু হয় এবং সর্বোচ্চ ১০০ বছর বয়স পর্যন্ত মনে রাখার মতো অবস্থা কারো কারো থাকে। যদিও অধিকাংশ নব্বইর্ধো বয়ষ্ক মানুষের স্মৃতি বিভ্রাট ঘটে থাকে, তবুও যুক্তির খাতিরে আমরা মেনে নিলাম একজন মানুষের জীবদ্দশায় একশো বছরের ঘটনার বাইরে কিছু প্রত্যক্ষ করার সুযোগ থাকে না। তাই আমাদের অজানা চৌদ্দ পুরুষের কারো জন্য কখনো শোক অনুভব করি না।
যদিও ইতিহাসের লেখায় অনেক কীর্তিমান মানুষদের কর্মকান্ড লিপিবদ্ধ থাকে, আমরা তাদের অবদানের কথা স্মরণ করি ও শোক পালনও করি। সেই অর্থে আমরা জ্ঞান হবার পর হতেই আশেপাশের মানুষদের, আত্মীয় স্বজনদের ও জন্মদাতা পিতা মাতার মৃত্যু দেখতে দেখতে মৃত্যুর বিষয়ে একধরণের অভিযোজনের ভিতর দিয়ে নিজের মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে থাকি। বয়স যতো বাড়তে থাকে মৃত্যু নিয়ে আহাজারি শোকের পরিমাণ আনুপাতিক হারে তখন কমতে থাকে, এটাই বাস্তবতা, এটাই বুঝি সৃষ্টির অবিনাশী তত্ত্ব।
কিন্তু আমার মতো হাজারো কোটি আমজনতা, যারা পৃথিবীতে এসে শুধুই নিজের জীবিকা ও স্ত্রী সন্তানদের লালন পালনের দায়িত্ব পালন করেই একশত বছর পার করেছেন তাদের কথা দুইশত বছর পর আর কেউ মনে রাখেন না। অনন্ত পৃথিবীর চলমান ধারায় আমরা যে খুবই স্বল্প সময়ের অভিযাত্রী সেই নির্মম সত্যকে উপলব্ধি করতে পারলে ও মৃত মানুষের অন্তিম যাত্রার দৃশ্যগুলো মনে করলেই আমাদের ভিতর থেকে হিংসা, ঘৃণা, লোভ, লালসা, জিঘাংসা ইত্যাদি অনাকাঙ্ক্ষিত রিপুগুলোর অবসান ঘটতে পারতো। তবে বাস্তবতা হলো মানুষ মৃত্যু থেকে কোন শিক্ষা নেয় না, অতি আপনজনের জন্য শোকের আয়ুও দীর্ঘমেয়াদী হয় না। কেউ কেউ নিজ চোখে দেখা কোন কোন নির্মম মৃত্যুর স্বাক্ষী হয়েও সময়ের সাথে সাথে তা বিস্মৃত হয়ে যায়, মেতে ওঠে জীবনযাপনের নিত্যদিনের খেলায়। এই পঞ্চাশে দাঁড়িয়ে আমার উপলব্ধি হলো “জীবনটা খুবই সংক্ষিপ্ত”, জীবনকালে আমাদের যাবতীয় অর্জন যদি শুধু নিজের জন্যই হয় সে জীবন আসলে অর্থহীন জীবন। আমাদের জীবন আসলে হওয়া উচিত অপরের জন্য, কবির ভাষায় “এমন জীবন তুমি করিও গঠন মরিলে হাসিবে তুমি কাঁদিবে ভুবন।”
পল্লব খন্দকার, ২২ জুলাই ২০২৩
mazhabkh93@gmail.com
Leave a Reply