চাকচিক্যময় শহরে প্রতিদিন আমাদের সম্মুখে কত শত জীবন্ত লাশ ঘুরেফিরে বেড়ায় কেউ তার খবর রাখে না। অথচ এরা হতে পারত হয়তো জগৎ সংসারের সবচেয়ে সুখী মানুষ। এদের কেউ হয়ত খুব তুচ্ছ কারণে অতি আবেগ প্রবণ হয়ে, ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদতে পারত। রাস্তার পাশে তুচ্ছ একটা ইতর প্রাণির মৃত্যু যে লোকটিকে ভাবিয়ে তুলত, মন খারাপ হত, মানসিকভাবে আহত করত, বেদনার্ত হৃদয় দিয়ে ক্ষুধার্ত প্রভুহীন পথের কুকুরের ক্ষুধাকে যে উপলব্ধি করার চেষ্টা করত, খেয়ালের বশে ব্যালকনিতে ছড়িয়ে রাখা শস্যদানাগুলো যখন পাখিরা খেয়ে তাদের উদরপূর্তি করত তখন আনমনে হেসে উঠা এই মানুষটি একসময় সমাজ ও রাষ্ট্রের নানা অসংগতি দেখে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করত পরিবর্তন করার, স্বপ্ন দেখত তার হাত দিয়েই সে তৈরি করবে নুতন স্বপ্নের পৃথিবী।
এই নব চেতনার, সহজভাবে চিন্তা করতে পারা মননশীল মানুষগুলো অকস্মাৎ একদিন হঠাৎ করেই মরে যায়। জীবন্ত লাশ হয়ে মানব সমাজে ঘুরে বেড়ায়। তখন সে আর আগের মত ভাবতে পারে না, তুচ্ছ কারণে অশ্রু ফেলা মানুষটির চোখের সামনে বৃষ্টির জলে রাস্তার জলাবদ্ধতার ওপর বিদ্যুৎ এর তার পরে জলজ্যান্ত মানবশিশু বৈদ্যুতিক শকে মারা যাওয়া দেখেও তার খারাপ লাগে না, আগুনে পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া মানুষ দেখেও সে নির্বিকার থাকে।
কারণ সমাজ তার আবেগকে মূল্যহীন মনে করে, ইতর প্রাণির মৃত্যুতে অশ্রুপাত করা, ক্ষুধার্তের পেটে খাদ্য নিশ্চিত করার স্বপ্নকে বিদ্রুপ করে, প্রকৃতির প্রতি ভালবাসাকে বোকামি মনে করে, কোমলতাকে সরলতা ভাবে, কঠোরতা ও রূঢ আচরণকে বলা হয় সাহসিকতা, সততাকে বলা হয় বোকামি, দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন ও সিন্ডিকেটকে চালাকি ও বুদ্ধিমান বলে অনবরত প্রশংসা করা হয়। স্বল্প মাইনে পাওয়া একটা সরকারি চাকুরে হলেই তাকে টাকা আয়ের খনি হিসেবে বিবেচনা করা হয় এই সমাজেই। পারিবারিক ও সামাজিক নানা অনুষ্ঠানে তাদের প্রতি প্রত্যাশা থাকে সীমাহীন, তখন তার সর্বোচ্চ আয় সীমা সম্পর্কে বিবেচনা করার বোধ এই সমাজের মানুষের থাকেনা। প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হলে কৃপণ অথবা নির্বোধ তকমা পেতে হয়। অমুকের ছেলে তমুক কোন সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে কতদ্রুত বাড়ি গাড়ি করেছে, সমাজের জন্য কী কী অবদান, পারিবারিক নানা আয়োজনে তার ভুমিকা কী রকমের ছিল তারই বন্দনা চলতে থাকে নির্বিচারে।
কেউবা সারাদিন কর্মক্লান্ত শরীর নিয়ে গৃহে ফিরে স্ত্রী সন্তানের শুকনো মুখ দেখতে পায়। চক্ষু শীতল না হয়ে উল্টো চক্ষু চড়কগাছ হয়ে যায়। থাকে রাজনৈতিক চাপ, অফিস রাজনীতি সহ আরো নানা ইস্যু।
এমনিভাবে অব্যাহত সামাজিক ও পারিবারিক চাপের মুখোমুখি হতে হতে একদিন টুস করে মরে যায় কেউ কেউ। অথচ তার চারপাশের কেউ বুঝতে পারেনা পৃথিবী থেকে একজন মানুষ বিদায় নিল। এই মৃত্যুকে ঠিকভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায় না। কারণ এটি কোন অপমৃত্যু নয়, নয় কোনো দুর্ঘটনা কিংবা রোগাক্রান্ত হয়ে ধুঁকে ধুঁকে শারিরীক কোনো মৃত্যু ঘটে না। এটি স্রেফ একজন মানুষকে মানসিক ভাবে হত্যা করা। ব্যক্তির মননশীল কাজ, সৃষ্টশীলতা, সততাসহ মানবিক গুণগুলোকে সুক্ষ্মভাবে হত্যা করে ফেলা হয়। এটি একটি সামাজিক অপরাধ। এই সামজিক অপরাধের দায় আসলে কার?
মোঃ রবিউল ইসলাম
৮ অক্টোবর, ২০২৩
আমাদের মতো মানুষদের না বলা কথা।