০৮ আগস্ট ২০২৪ তারিখে দৈনিক সমকালে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন শেখ রোকন ও ইফতেখারুল ইসলাম।
সমকাল: প্রবল পরাক্রমশালী শেখ হাসিনা সরকারের যে পতন হতে যাচ্ছে, সেটা কি ৫ আগস্টের আগে কোনোভাবে অনুমান করতে পেরেছিলেন?
আনু মুহাম্মদ: কোনো সরকারের পতন হচ্ছে কিনা, এর কিছু লক্ষণ রয়েছে। সবচেয়ে বড় লক্ষণ ছিল কোটা সংস্কার আন্দোলনে ব্যাপক জনসমর্থন। সরকার যত বল প্রয়োগ করেছে, আন্দোলনের কর্মসূচিতে জনসমাগম তত বাড়তে থাকে। আরেকটি লক্ষণ হলো, সমাজের বিভিন্ন অংশের সম্পৃক্ততা। আমরা দেখেছি, শিক্ষার্থীদের যখন দলে দলে হত্যা করা হচ্ছিল, তখন শিক্ষকরা, অভিভাবকরা, আইনজীবীরা, সাংবাদিকরা, শ্রমিকরা, শিল্পীরা, অভিনেতারা, ব্যাংকাররা দাঁড়াতে থাকল। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে, পেশাজীবী নির্বিশেষ সর্বস্তরের মানুষ যোগ দিচ্ছিল। পাবলিক ইউনিভার্সিটি, প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি একাকার হয়ে রাজপথে নেমে আসছিল। সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে যাদের সাধারণত প্রতিবাদের মধ্যে প্রত্যক্ষভাবে দেখা যায় না, তারাও যখন রাস্তায় নামা শুরু করল, তখন স্পষ্ট হয়ে গেল যে, এই আন্দোলন আর পেছনে ফেরানো যাবে না। তখনই বোঝা গেল, মানুষের মধ্যে ব্যাপক সংহতি এবং সরকারের বিরুদ্ধে চরম বিদ্রোহ তৈরি হয়েছে।
সমকাল: ক্ষমতাচ্যুতির আগে সরকার তো বিভিন্ন বাহিনীর শক্তি প্রয়োগও করেছে যথেষ্ট।
আনু মুহাম্মদ: পুলিশ ও বিজিবি দিয়েও কাজ হয়নি। ব্যাপক হতাহতের পরও মানুষ দমে যায়নি বা সরে যায়নি। তারপর সরকার চূড়ান্ত শক্তি প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নিল, কারফিউ দিল, সামরিক বাহিনীকে মাঠে নামিয়ে জরুরি অবস্থার মতো পরিস্থিতি তৈরি করল। কিন্তু মানুষ যখন কারফিউ ভেঙে রাস্তায় আসতে থাকল, তখন বোঝা গেল যে আর দমনপীড়ন করেও সরকারের পক্ষে পতন ঠেকানো সম্ভব হবে না। কারণ, সরকারের সর্বোচ্চ পদক্ষেপ ছিল কারফিউ দেওয়া, সেনাবাহিনী ডাকা। সেটা ব্যর্থ হওয়ার পর বিদায় ছাড়া তাদের আর কিছুই করার ছিল না। কারফিউ চলাকালেই আমরা বুঝতে পারি, শেখ হাসিনা আর থাকতে পারছেন না।
সমকাল: কারফিউ চলাকালেই ৪ আগস্ট প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষক নেটওয়ার্কের পক্ষ থেকে বাংলাদেশে বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক রূপান্তরের যাত্রার রূপরেখা দিয়েছিলেন আপনি। সেই রূপরেখা অনুযায়ী কি রূপান্তর প্রক্রিয়া চলছে?
আনু মুহাম্মদ: পরিস্থিতি এখন পর্যন্ত স্পষ্ট নয়। শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির পর রূপান্তর প্রক্রিয়ায় প্রথম বিচ্যুতি ঘটল সেনাপ্রধানের দায়িত্ব নেওয়া ও আলোচনায় বসার ঘোষণায়। তিনি যাদের সঙ্গে আলোচনায় বসলেন, দেখা গেল, যারা মূল আন্দোলনের মূল শক্তি কিংবা যাদের নেতৃত্বে গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হলো, তাদের কেউ নেই। বরং এমন সব লোককে আলোচনায় ডাকা হলো, আন্দোলনে যাদের কোনো ভূমিকা নেই। বরং এমন লোকজনও আছে, যাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনবিরোধী ভূমিকার অভিযোগ আছে। আন্দোলনের মূল শক্তি আলোচনার অংশীদার না থাকায় একটা শূন্যতা তৈরি হলো। সেনাপ্রধানের কথা থেকেও বোঝা গেল, তারাও এমন পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত নন; কোনো চিন্তাভাবনা করে আসেননি।
সমকাল: সেই শূন্যতা তো দ্রুতই পূরণ হয়েছিল।
আনু মুহাম্মদ: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের অনুপস্থিতিতে কয়েক ঘণ্টার শূন্যতার ওপর ভিত্তি করেই পরবর্তী সময়ে সারাদেশে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটতে থাকল। গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিটের বিরুদ্ধেই নানা তৎপরতা দেখা গেল। যেমন– সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ওপর আক্রমণ, ভাস্কর্য থেকে স্থাপনা ভাঙচুর, আগুন কিংবা নির্বিচারে মানুষের ওপর আক্রমণ। এগুলো ঘটতে থাকল, কারণ সেনাসদরের আলোচনায় ছাত্র নেতৃবৃন্দের শূন্যতা ও নির্দেশনার অভাব ছিল। এই সমস্যাটা তৈরি হলো। এখন অবশ্য বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নেতৃবৃন্দ দৃশ্যপটে চলে এসেছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের রূপরেখা দিচ্ছে। আর আমাদের রূপরেখাটি ছিল অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পরে সেই সরকারের করণীয় সম্পর্কে। সরকার গঠিত হওয়ার পর বোঝা যাবে, পরিস্থিতি কোনদিকে যাচ্ছে।
সমকাল: অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন প্রক্রিয়া আপনারা কীভাবে চেয়েছিলেন?
আনু মুহাম্মদ: আমরা পরিষ্কারভাবে বলেছিলাম, শিক্ষার্থী-জনতার অভ্যুত্থানের মূল শক্তিগুলোর সম্মতিক্রমে, নাগরিক ও রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মতামতের ভিত্তিতে শিক্ষক, বিচারপতি, আইনজীবী ও নাগরিক সমাজের অংশীজন নিয়ে জাতি-ধর্ম-লিঙ্গ-শ্রেণির অন্তর্ভুক্তিমূলক অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হবে। এই সরকারের সদস্য নির্বাচনে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা মুখ্য ভূমিকা পালন করবে।
সমকাল: আপনারা তো ছায়া সরকারের কথাও বলেছিলেন।
আনু মুহাম্মদ: ঠিক, আমরা লিখিতভাবেই বলেছিলাম, শিক্ষার্থী-জনতার অভ্যুত্থানের মূল শক্তিগুলোর অংশীজনের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠনগুলোর সমন্বয়ে সর্বদলীয় শিক্ষার্থী-শিক্ষকসহ নাগরিকদের নেতৃত্বে একটি ছায়া সরকার গঠিত হবে। তারা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জবাবদিহি এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করবে, যেন দেশে একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচনের উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত হয় এবং এই গণঅভ্যুত্থানের প্রকৃত দাবি ‘বৈষম্যহীন বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠার পথে যথেষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। এ ধরনের ছায়া সরকার নির্বাচিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়ও অব্যাহত থাকতে পারে।
সমকাল: যে প্রক্রিয়াতেই হোক, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হচ্ছে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সরকার শপথ নেবে। নতুন সরকারের প্রথম ও প্রধান করণীয় কী কী হওয়া উচিত?
আনু মুহাম্মদ: প্রথমত গত ১৫ বছরে জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো অকার্যকর হয়ে গেছে। যেমন নির্বাচন কমিশন পুরোপুরি অকার্যকর। দুর্নীতি দমন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, বিচার বিভাগ– এগুলো সরকারের আদেশক্রমে চলত। আদেশক্রমে চলা এসব প্রতিষ্ঠান স্বাধীন ও কার্যকর করতে হবে। তা না হলে গণতান্ত্রিক রূপান্তর সম্ভব নয়। এই প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিক করতে গেলে স্বচ্ছতা আনতে হবে, জনগণের কাছে দায়বদ্ধ প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড় করানোর জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার করতে হবে। একই সঙ্গে সংবিধান সংশোধনেও মনোযোগ দিতে হবে।
সমকাল: সংবিধান সংশোধন জরুরি কেন?
আনু মুহাম্মদ: কারণ, শুধু ক্ষমতাচ্যুত সরকার নয়; বহু বছর ধরে সংবিধানে যে সংশোধনগুলো হয়েছে, তাতে সংবিধানেই সাম্প্রদায়িক, অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরতান্ত্রিক উপাদান রেখে দেওয়া হয়েছে। সুতরাং, এই সংবিধান সংশোধন না করে যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক; ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন হবে, সম্পদের কেন্দ্রীভবন হবে। সাংবিধানিকভাবেই শ্রেণিগত বৈষম্য, লিঙ্গীয় বৈষম্য, জাতিগত ও ধর্মীয় বৈষম্য রয়ে যাবে।
সমকাল: সংবিধান সংশোধন তো অন্তর্বর্তীকালীন সরকার করতে পারবে না।
আনু মুহাম্মদ: অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংবিধান সংশোধন করতে পারবে না, কিন্তু সংশোধনের বুদ্ধিবৃত্তিক ভিত্তি তৈরি করা; নথিপত্র তৈরি করা, জনমত তৈরি করা, জনপরিসরে আলোচনার মধ্যে নিয়ে যাওয়া, রাজনৈতিক এজেন্ডা করার কাজগুলো করতে পারবে। সংবিধান সংশোধনের বিষয়টিকে এজেন্ডা হিসেবে সামনে আনতে হবে, যাতে পরবর্তী সময়ে নির্বাচিত সরকার সেটা করতে পারে।
সমকাল: তাহলে পরবর্তী নির্বাচনগুলো অবাধ ও সুষ্ঠু হওয়াই কি মূল এজেন্ডা হওয়া উচিত নয়? তাহলেই সংস্কারগুলো পরবর্তী সরকার করার ক্ষেত্রে জবাবদিহি নিশ্চিত হবে। কারণ পাঁচ বছর পর তাকে জনগণের কাছে ভোটের জন্য যেতে হবে।
আনু মুহাম্মদ: নির্বাচন সুষ্ঠু করার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার, আইনগত সংস্কার এবং সংবিধান সংস্কার নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে করার ব্যাকগ্রাউন্ড হিসেবে কাজ করবে। মানে পরিপ্রেক্ষিতটা তৈরি করার জন্য নিশ্চয়তা তৈরি করার কাজগুলো অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের করতে হবে।
সমকাল: এ কাজগুলো করতে হলে সময় লাগবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ নিয়ে ইতোমধ্যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে।
আনু মুহাম্মদ: না, দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন নেই। সব কাজ করে ফেলতে হবে না; ভিত্তিটা তৈরি করতে হবে। যেমন, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করতে আইনগত কিছু সংস্কার করতে হবে। ২০০৭-০৮ সালেও কিছু সংস্কার হয়েছিল, যেগুলো পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ সরকার নির্বাচিত হয়ে বাতিল করে দিয়েছিল। ওই সংস্কারগুলোকে নমুনা হিসেবে সামনে আনা যেতে পারে।
সমকাল: তার মানে, রক্ষাকবচ জরুরি। আওয়ামী লীগ এসে যেমন ওয়ান-ইলেভেন সরকারের সংস্কারগুলো পরিবর্তন করে দিয়েছিল, তেমন যেন না হয়। সংস্কারের রক্ষাকবচ কী?
আনু মুহাম্মদ: জনগণের অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে পরিবর্তন এসেছে, সেই শক্তিকে সক্রিয় রাখতে হবে। এটা ছাড়া রক্ষাকবচ দেখি না। আইনগত সংস্কার, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার যা-ই করা হোক না কেন; জনঅংশীদারিত্ব যদি না থাকে, জনগণ যদি সক্রিয় না থাকে, পরবর্তী সময়ে নির্বাচিত সরকার আবার আগের পথে যেতে পারে।
সমকাল: নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানও কিন্তু পরবর্তী সময়ে সক্রিয় থাকতে পারেনি।
আনু মুহাম্মদ: আগের যে কোনো গণঅভ্যুত্থানের সঙ্গে এবারের গণঅভ্যুত্থানের পার্থক্য আছে। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্বে ছিল রাজনৈতিক দল। তারা তিন জোটের রূপরেখা দিয়েছিল। কিন্তু তিন জোটের রূপরেখার অংশীদার সবাই পরবর্তী সময়ে ক্ষমতায় গিয়ে রূপরেখাবিরোধী কাজ করেছে। এবারের গণঅভ্যুত্থানে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছিল না। নেতৃত্ব দিয়েছে শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের সংগঠন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের রাজনৈতিক পরিচয় নেই; ঘোষিত কিছু আকাঙ্ক্ষা ও লক্ষ্য আছে। সেখানে বৈষম্যহীন, গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের কথা আছে। পাশাপাশি এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের পাশে অনেক শিক্ষক এসে দাঁড়িয়েছেন, যারা আগে কখনও দায় অনুভব করেননি। সাংবাদিকরা দাঁড়িয়েছেন, আইনজীবীরা দাঁড়িয়েছেন। আমি মনে করি, এটি তাৎপর্যপূর্ণ ও সুদূরপ্রসারী। গণঅভ্যুত্থানের এই চরিত্র প্রধান রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করবে বলে আমি মনে করি। যে কারণে আমরা ছায়া সরকারের ধারণা দিয়েছি। ছায়া সরকার মানে হলো, সমাজের শক্তিগুলোর মধ্য থেকে সরকারকে মনিটরিং করার শক্তি ও সক্ষমতা অর্জন করা।
সমকাল: অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ কী হতে পারে?
আনু মুহাম্মদ: গত কয়েক দশকে, গত ১৫ বছরে বাংলাদেশে একটি খুবই অতি ধনী ক্লাস তৈরি হয়েছে। মানে বিপুল সম্পদ কেন্দ্রীভূত হয়েছে যাদের হাতে এবং এরা স্বৈরতন্ত্রের সুবিধাভোগী। এরা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের জন্য বড় ধরনের হুমকি। পাশাপাশি সামরিক, বেসামরিক আমলাতন্ত্রকে যেভাবে সাজানো হয়েছে; দলের স্বার্থে কিংবা লুণ্ঠনজীবীদের স্বার্থে যেভাবে ব্যবহৃত হয়েছে; ক্রসফায়ার, গুম, খুন– এগুলো যেভাবে হয়েছে, তা গণতান্ত্রিক রূপান্তরের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর জন্য বড় ধরনের হুমকি। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন শক্তিও স্বৈরতন্ত্রের বিশেষ সুবিধাভোগী হয়। ধরেন, ভারতের আদানি ও আম্বানির বিশেষ সুবিধা হয় বাংলাদেশে স্বৈরতন্ত্র থাকলে। একই কথা যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়ার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আমি সবসময় বলেছি, বাংলাদেশে সরকারের মধ্যে বিভিন্ন লবি থাকে; মার্কিন লবি, চীন লবি, রাশিয়া লবি, ইন্ডিয়ান লবি তো খুবই শক্তিশালী। কিন্তু বাংলাদেশ লবিটাকে খুঁজে পাওয়া যায় না। এই আন্তর্জাতিক সুবিধাভোগী গোষ্ঠী কিংবা স্বার্থ গোষ্ঠী, তারাও গণতান্ত্রিক রূপান্তরে আমাদের জন্য বড় ধরনের হুমকি। তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থ, কৌশলগত স্বার্থ, এই অঞ্চলে আধিপত্য রাখার স্বার্থ বাস্তবায়ন করতে অগণতান্ত্রিক শক্তি প্রয়োজন হয়। এটা গণতান্ত্রিক রূপান্তরের ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি করে। তার মানে, গত কয়েক দশকে শক্তিশালী হয়ে ওঠা বিপুল ধনিক শ্রেণি, সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র, আন্তর্জাতিক লবি– এই তিন গোষ্ঠী সম্পর্কে সতর্ক না থাকলে কিংবা তাদের এজেন্ডার অধীন হয়ে গেলে গণতান্ত্রিক রূপান্তর বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যেতে পারে।
সমকাল: ক্ষমতাপ্রত্যাশী রাজনৈতিক দলগুলো কি গণতান্ত্রিক রূপান্তর প্রক্রিয়া মেনে নেবে?
আনু মুহাম্মদ: সে জন্য স্বচ্ছতার সঙ্গে জনগণকে যুক্ত করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সংস্কার কাজগুলো করতে হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যদি বিএনপি, জামায়াত কিংবা সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র কিংবা দূতাবাসনির্ভরশীল হয়, তাহলে গণতান্ত্রিক রূপান্তরের কাজটা করতে তারা ব্যর্থ হবে।
সমকাল: স্বচ্ছতার সঙ্গে মানে কী?
আনু মুহাম্মদ: সব অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করে কাজ করা। যেমন রাষ্ট্রপতি, সেনাপ্রধানের সঙ্গে অনেক রাজনৈতিক দলের বৈঠক হয়েছে। বাম সংগঠনগুলোকে কেন ডাকা হয়নি? তাদের সঙ্গেও কথা বলতে হবে ও মতামত নিতে হবে। তারা গণঅভ্যুত্থানে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছে। আমি বলব, তাদের যুক্ত করলে গণতান্ত্রিক রূপান্তরের কাজটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য আরও সহজ হবে। কারণ কয়েক দশক ধরে যারা চুরি, ডাকাতি, দখল, লুটপাট, ব্যাংক ফোকলা করেছে, তারাই তো বড় রাজনৈতিক দলগুলোর প্রধান পৃষ্ঠপোষক। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলে সেই দলগুলো থেকে আপত্তি আসতে পারে।
সমকাল: মুক্তির মন্দির সোপানতলে অনেক প্রাণ বলিদান হয়। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানে হারানো প্রাণের কি বিচার হয়েছে? এই জুলাই হত্যাকাণ্ডের কি বিচার হবে?
আনু মুহাম্মদ: না, একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে দেওয়া যাবে না। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর যে ধরনের প্রতারণা ও ভুল হয়েছে, সেটার পুনরাবৃত্তি হতে দেওয়া যাবে না। আওয়ামী লীগ শাসনামলে যে নিপীড়ন, দখল, দাপট আমরা দেখেছি, তার পুনরাবৃত্তি আর হতে দেওয়া যাবে না। সেটার অংশ হিসেবে জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার হবে একটা দৃষ্টান্ত। রাষ্ট্রের যে ধরনের বিধি জুলাই হত্যাকাণ্ডকে সহায়তা করেছে, যে ধরনের সংস্কৃতি ও মতাদর্শ এ ধরনের কাজকে বৈধতা দিয়েছে; এগুলোকে চ্যালেঞ্জ করে গণতান্ত্রিক রূপান্তরে দিকে এগিয়ে যেতে হবে। হত্যাকাণ্ড ধামাচাপা দিয়ে কোনো গণতান্ত্রিক রূপান্তর সম্ভব হবে না।
সমকাল: অস্থির সময়েও আমাদের সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
আনু মুহাম্মদ: আপনাদেরও ধন্যবাদ।
সংকলন: দৈনিক আলোকবর্তিকা।
Leave a Reply