৭ই আগস্ট ১৯৪১ সালে ২২ শ্রাবণ ১৩৪৮ বঙ্গাব্দে ৮০ বছর বয়সে জোড়াসাঁকোর বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বাংলা সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী আমাদের বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি কলকাতার এক ধনাঢ্য ও সাংস্কৃতিবান ব্রাহ্ম পিরালী ব্রাহ্মণ পরিবারে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন ( ২৫ শে বৈশাখ ১২৬৮ বঙ্গাব্দ, ৭ ই মে ১৮৬১ খ্রিঃ)।
পারিবারিক সুদীর্ঘ ঐতিহ্য রক্তে প্রবাহিত ছিলো তাঁর, পাশাপাশি জমিদারী দেখাশুনা, পড়াশুনার জন্য ইউরোপ গমন, খ্যাতি অর্জনের পর রাশিয়া ও জাপান ভ্রমণের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়ে বাংলা ভাষার সব শাখায় লেখালেখির ক্ষেত্রে তিনি হয়ে ওঠেন একমাত্র ও অনন্য। তাই রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু আমাদের কাছে এক মহা প্রয়াণ হিসেবেই যুগেযুগে শোক ও শক্তির উৎস হিসেবে অম্লান রয়ে যাবে। প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তিনি তা অর্জন করতে না পারলেও আপন প্রতিভার দিগন্ত বিস্তৃত আলোয় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে যে উচ্চতায় অধিষ্ঠিত করেছেন সেই বিপুল বিশালতা তাঁকে বাংলাভাষভাষীদের মাঝে এনে দিয়েছে চির অমরত্ব। তাই আজ তাঁর মৃত্যুর আট দশক পেরিয়েও তিনি আমাদের হৃদয়ে করে চলেছেন একচ্ছত্র আধিপত্য, ছিলেন উচ্চ বংশীয় জমিদারদের প্রতিনিধি কিন্তু এখনো শাসন করে চলেছেন বাংলা সাহিত্য ও বাঙ্গালীর মনোজগতের অলিগলি।
আমার মতো বহু পাঠকের সাহিত্য জগতে অনুপ্রবেশ ঘটেছে রবীন্দ্রনাথের হাত ধরেই, স্কুলের পাঠ্যবইয়ে শিশুকাল থেকে আরম্ভ করে হাজারো গল্প উপন্যাস গান কবিতায় শুধু বিস্ময় আর বিস্ময়! তাঁর লেখা কয়েক হাজারের বেশি কবিতা, ছোট গল্প, সাহিত্য, উপন্যাস আমাদের পাওয়া পরমানন্দের এক মহাসমূদ্রের সাহিত্য স্বাদ। “ভিখারিণী” গল্পটি বাংলা সাহিত্যের প্রথম ছোট গল্প। তিনিই ছন্দে ছন্দে প্রথম সংজ্ঞায়িত করেন ছোট গল্পকেঃ
রবীন্দ্রনাথের সৃষ্ট অনন্য প্রতিষ্ঠান শান্তিনিকেতন পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার বোলপুর শহরের নিকট অবস্থিত একটি আশ্রম ও শিক্ষাকেন্দ্র। ১৮৬৩ খ্রিষ্টাব্দে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর নিভৃতে ঈশ্বরচিন্তা ও ধর্মালোচনার উদ্দেশ্যে বোলপুর শহরের উত্তর-পশ্চিমাংশে এই আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯০১ সালে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন, যা কালক্রমে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ নেয়। ১৯১৮ সালের ২৩ ডিসেম্বর বিশ্বভারতীর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। এরপর ১৯২১ সালের ২৩ ডিসেম্বর, (১৩২৮ বঙ্গাব্দের ৮ পৌষ) রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতিতে আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল বিশ্বভারতীর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন এখানে।
রবীন্দ্রনাথ তার জীবনের দ্বিতীয়ার্ধের অধিকাংশ সময় শান্তিনিকেতন আশ্রমে অতিবাহিত করেছিলেন। তার সাহিত্য ও সৃষ্টিকর্মে এই আশ্রম ও আশ্রম-সংলগ্ন প্রাকৃতিক পরিবেশের উপস্থিতি সমুজ্জ্বল। শান্তিনিকেতন চত্বরে নিজের ও অন্যান্য আশ্রমনিবাসীদের জন্য রবীন্দ্রনাথ অনিন্দ্য স্থাপত্যসৌকর্যমণ্ডিত একাধিক ভবন নির্মাণ করিয়েছিলেন যা পরবর্তীকালে আশ্রমনিবাসী বিভিন্ন শিল্পী ও ভাস্করের সৃষ্টিকর্মে সজ্জিত হয়ে এই আশ্রম একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যটনস্থল হয়ে ওঠে। ১৯৫১ সালে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ভারতের কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা লাভ করে। কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য। দেশবিদেশ থেকে প্রচুর ছাত্রছাত্রী এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে আসেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন, অস্কারবিজয়ী চিত্র-পরিচালক সত্যজিৎ রায়, জয়পুরের রানী তথা কোচবিহারের রাজকন্যা গায়েত্রী দেবী, ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী প্রমুখ।
রবীন্দ্রনাথের শ্বশুর বাড়ী আমাদের বাংলাদেশেই, বর্তমানে খুলনা জেলার ফুলতলা উপজেলার দক্ষিনডিহি গ্রামে। ১৮৮৩ সালের ৯ই ডিসেম্বর (২৪ শে অগ্রহায়ণ, ১২৯০ বঙ্গাব্দে) ঠাকুরবাড়ির অধস্তন কর্মচারী বেণীমাধব রায়চৌধুরির কন্যা ভবতারিণীর সঙ্গে তার বিবাহ সম্পন্ন হয়। বিবাহিত জীবনে ভবতারিণীর নামকরণ হয়েছিল মৃণালিনী দেবী। রবীন্দ্রনাথ ও মৃণালিনী দেবীর পাঁচ সন্তান – মাধুরিলতা, রথীন্দ্রনাথ, রেণুকা, মীরা, শমীন্দ্রনাথ। এদের মধ্যে অতি অল্প বয়সেই রেণুকা ও শমীন্দ্রনাথের মৃত্যু ঘটে।
বাল্যকালে প্রথাগত বিদ্যালয় শিক্ষা তিনি গ্রহণ করেননি। শৈশবে রবীন্দ্রনাথ কলকাতার ওরিয়েন্টাল সেমিনার, নর্ম্যাল স্কুলে কিছুদিন পড়াশোনা করেন। কিন্তু এই চার দেওয়ালের মধ্যে থেকে শিক্ষাগ্রহণে অনাগ্রহী হওয়ায় গৃহশিক্ষক রেখে বাড়িতেই তার শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ছোটবেলায় জোড়াসাঁকোর বাড়িতে কিংবা বোলপুর ও পানিহাটির বাগানবাড়িতে প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে ঘুরে বেড়াতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন রবীন্দ্রনাথ। মাত্র আট বছর বয়সে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন।
১৮৭৪ সালের তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় তার ‘অভিলাষ’ কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয়। এটিই ছিল তার প্রথম প্রকাশিত রচনা। ১৮৭৮ সালে ব্যারিস্টারি পড়ার উদ্দেশ্যে ইংল্যান্ডে যান রবীন্দ্রনাথ। প্রথমে তিনি বাইনের একটি পাবলিক স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন। ১৮৭৯ সালে ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনে আইন বিদ্যা নিয়ে পড়া শুরু করেন। কিন্তু সাহিত্যে চর্চার আকর্ষণে সেই পড়াশোনা তিনি সমাপ্ত করতে পারেন নি। ইংল্যান্ডে থাকাকালীন শেক্সপিয়র ও অন্যান্য ইংরেজ সাহিত্যিকদের রচনার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় ঘটে। এই সময় তিনি বিশেষ মনোযোগ সহকারে পাঠ করেন রিলিজ ও মেদেচি, কোরিওলেনাস এবং অ্যান্টনি অ্যান্ড ক্লিওপেট্রার। এই সময় তার ইংল্যান্ডে বাসের অভিজ্ঞতার কথা ‘ভারতী’ পত্রিকায় পত্রাকারে পাঠাতেন রবীন্দ্রনাথ।
জীবনের কোন ক্ষণেই রবীন্দ্রনাথের গানের সুরের সাথে সুর মেলাননি এমন বাঙ্গালী পাওয়া অসম্ভব! অন্তত বাংলাদেশীদের জাতীয় সঙ্গীত গাইতে গাইতে একদিনের জন্য হলেও সেই সুর ও লয়ে মুগ্ধ হতে হয়েছে মানুষের। তিনি বাংলা সাহিত্যকে গণমানুষের জন্য সহজপাচ্য ও হৃদয়গ্রাহী করে সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন বলে তাঁর মৃত্যু আমাদের এখনো ভাবায়, এখনো প্রতিটি গান শুনে হৃদয়ের একুল-ওকুল দুকুল ভেসে যায়।
লেখার সূত্র ধারঃ
সংকলনঃ পল্লব খন্দকার, ২২ শ্রাবণ ।
Leave a Reply