শুধুই কি আমি বিচলিত হই এই সর্বহারাদের রাস্তায় বা ফুটপাতে ঘুমাতে দেখে! আমি কিছুতেই নিতে পারি না এই বেওয়ারিশ হয়ে যাওয়া ভাসমান মানুষগুলোর রাস্তার কুকুরের চেয়ে অধম জীবনযাপন! কেউ কি ভাববার নেই, কারো কি কিছুই করার নেই? কত লক্ষ লক্ষ ভিনদেশী জনগোষ্ঠীর দায়িত্ব নিয়েছে রাষ্ট্র, জাতিসংঘ, পূনর্বাসনে কাজ করছে দেশি-বিদেশি কত শত বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। এই রাস্তায় পড়ে থাকা মানুষগুলোকে নিয়ে কারো কি এতটুকু দয়া জন্মে না, কারো কি একবার মনে হয় না এদেরও পূনর্বাসনের জন্য মানবিক উদ্যোগ নেয়া অতীব জরুরী? পুঁজিবাদী গণতন্ত্র, শ্রেণিবৈষম্যহীন সমাজতন্ত্র, উদারপন্থা তথা মানবতন্ত্র অথবা ধর্মীয় দর্শনের কোন একটি মতবাদও কি এই মানবতার চরম অপমানভূক্ত সমস্যাটির সমাধানের একটি সূত্র দিতেও ব্যর্থ? এই ভাসমান রাস্তার মানুষদেরকে কি তাহলে এখন হতদরিদ্র যাদুঘরের চলমান প্রদর্শনী সামগ্রী হিসেবে সাজিয়ে রাখতে হবে?
যখন কোথাও আগুন লাগে, প্রাকৃতিক দূর্যোগ আঘাত হানে অথবা ঘটে যায় মর্মান্তিক সড়ক দূর্ঘটনা তখন তো রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় দূর্ঘটনা প্রতিরোধের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। চলে ত্রাণ ও পূনর্বাসন, ব্যক্তি উদ্যোগেও চলে নানারকম মানবিক সহযোগিতা কার্যক্রম। কে কাকে হুমকি কিম্বা গালি দিয়েছেন তা নিয়েও হাইকোর্টে রিট হতে দেখি, হাইকোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুল জারিও করে থাকেন অনেক রাষ্ট্রীয় বা প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির অনাচারের বিরুদ্ধে। তাহলে আমরা রাস্তার ভাসমান মানুষদের অবর্ণনীয় দূর্দশা দেখেও কিভাবে পাশ কাঁটিয়ে চলে যাই? তাদের মৌলিক চাহিদার একটিও পূরণের যদি আমাদের সামর্থ্য না থাকে তাহলে কি আর আমাদের পবিত্র সংবিধান অক্ষত থাকে? রাস্তায় ঘুমানো ভাসমান মানুষের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা আমরা কোনটা নিশ্চিত করতে পারছি সেই সুক্ষ চিন্তাটি কি একবারও আমাদের স্থুল দৃষ্টিসীমার মধ্যে আসতে পারে না?
আসুন একটু ফিরে তাকাই রাজপথে বা ফুটপাতে ঘুমানো ভাসমান মানুষদের দিকে। আমরা যদি তাদের মানুষই বলতে চাই তাহলে নিজেরা যেনো লজ্জিত হই এইরকম পাঁচটি মৌলিক অধিকার হারানো মানুষদের রাস্তায় রেখে নিজেরা আলীশান রাজপ্রাসাদে ঘুমাতে যেতে! শুধুই কিছু সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন, সরকারি অথবা বেসরকারি যেকোন উন্নয়ন সংস্থা দায়িত্ব নিয়েই এলাকা ভিত্তিক ভাসমান মানুষদের জরীপ করে ইমার্জেন্সি রেসপন্স টিম এর মাধ্যমে পূনর্বাসন সহ অন্যান্য মৌলিক চাহিদা পূরণের নূন্যতম কার্যক্রম পরিচালনা করা খুবই সহজ। তাদের ক্ষেত্রে প্রথম প্রয়োজন পরিচয় ও স্থায়ী ঠিকানা সংগ্রহ, ভাসমান হবার কারনসমূহ চিহ্নিতকরণ, দ্রুত প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদান ও অস্থায়ী রাত্রিযাপন কেন্দ্রে স্থানান্তর। ভাসমান মানুষদের নিয়মিত খাদ্য যোগান ও পয়োঃনিষ্কাসনের সুব্যবস্থা নিশ্চিত করার পরবর্তীতে মানসিক কাউন্সেলিং করে আত্মনির্ভরশীল কর্মকান্ডে যুক্ত করার উদ্যোগ নেয়া এবং দীর্ঘমেয়াদী মানসিক বা শারীরিক চিকিৎসার প্রয়োজন হলে তার ব্যবস্থা করা।
আমরা কিন্তু উদ্যোগ নিলেই পারি। যে জাতি একজন নেতার ডাকে বুকের রক্ত দিয়ে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করতে পারে সে জাতি পুঁজিবাদী সমাজের নৃশংস আমিত্ব ব্যাধিতে আকস্মিক বোধহীন হয়ে পড়লেও যেকোন সময় ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির মতো জেগে উঠে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে মানবতার উজ্জ্বল মশাল জ্বালিয়ে সব অন্ধকার দূর করতে। সেই আলোকবর্তিকা, সেই সুবিবেচনার মশাল, সেই দ্যুতিময় আলো জ্বলে উঠুক সকলের অন্তরে।
পল্লব খন্দকার, ০৯ জুলাই ২০২৩
mazhabkh93@gmail.com