ঘুম ভেঙ্গে দেখি আমি রাস্তার পাশে ফুটপাতে পড়ে আছি! চুলগুলো জট পাকানো ধুলোয় কাদায় আদ্র হয়ে চটচটে অনুভূতি। ঘুমের ঘোর কেটে গেছে মনে হচ্ছে কিন্তু নিজের হাত-পা, পোশাক-পরিচ্ছদ সবকিছুই অচেনা লাগছে, বহু পুরাতন ঘামের আর মাটির বমি আসা আমসিটে গন্ধওয়ালা ছেড়া জিন্সের প্যান্টের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে কিছু ভাবার চেষ্টা করি। কিন্তু চিন্তার গভীরতায় ডুবে যাবার সময় মাথার ভিতর ঘুরে ওঠে, সামলে নিয়ে আশেপাশে তাকাই, হাত দশেক দূরে ঠিকঠাক পোশাকেই এক বৃদ্ধ বসে আছেন হাত পেতে। হাত পেতে কেনো আছেন বুঝতে চেষ্টা করতে করতেই একজন পথচারী ব্যস্ত ভঙ্গিতে তাকে পকেট থেকে বের করে কিছু একটা দিয়ে আমার পাশ দিয়ে পার হতে হতেই ঘুরে কিছু ফেলে গেলেন। আমি চিনতে পারলাম সেটা ১০ টাকা, চিনতে পেরে একধরনের স্বস্তি বোধ করলাম, বুঝলাম দুরের বৃদ্ধটি একজন ভিক্ষুক, কিন্তু আমি তো হাত পাতিনি? আবার নিজের হাত-পা ভালোভাবে দেখলাম, কোথাও কি ভুল হচ্ছে? আমার নাম, ঠিকানা মনে করার চেষ্টা করেও বেশিক্ষণ পারলাম না, গা গুলাতে লাগলো, বমি বমি ভাব হচ্ছে দেখে টের পেলাম ক্ষুধার অনুভব। বুঝলাম আমি তো ঠিকই আছি, তাহলে এভাবে, এখানে, কিন্তু আমি কে?
রাজধানীর রাস্তার পাশের ফুটপাতে, রেল ষ্টেশনে, ডিভাইডারের উপরে শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষায় ভাসমান অসংখ্য মানুষের দেখা মেলে যত্রতত্র। আমাদের কাছে তারা পরিচয়হীন, ঠিকানাহীন মানুষ নামক প্রানী বটে, তাদের পাশাপাশি রাস্তার বেনামী কুকুরগুলোও ঘুমিয়ে থাকে, একসাথে খাবারও ভাগাভাগি করে খায়। ইচ্ছে করলে প্রত্যেক দিনই এমন ছবি ফোনের ক্যামেরায় বন্দী করা যায়। কিন্তু অসম্ভব এক লজ্জায় তা করতে পারি না, আমার দৈনন্দিন মর্নিং ওয়াক এর আসা-যাওয়ার পথে যে ফুট ওভার ব্রিজটি ব্যবহার করি সেখানে কেউ কেউ দিনের পর দিন আবার কেউ কেউ অস্থায়ীভাবে অবস্থান করেন! প্রথম প্রথম এগুলো দেখেও তেমন করে ভাবতাম না, কতো মানুষেরই তো ঘর বাড়ি নেই এই দেশে, এ আর এমনকি? এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই যে গ্রীষ্ম, বর্ষা, ঝড়, কঠিন শীতকাল উপেক্ষা করে মানুষ নামের প্রাণীগণ দিনের পর দিন ফুট ওভার ব্রিজ এর উপর জীবন-যাপন অব্যাহত রেখেছেন এই বিষয়টি আমার মাঝে একসময় কিছু সুক্ষ সুক্ষ যন্ত্রণা তৈরি করতে থাকে। এই যে মানুষগুলো এরা কেউই আকাশ থেকে মাটিতে এসে পড়েনি, তাদের প্রত্যেকেরই নিশ্চিত শিকড় আছে বা ছিলো। এদের মা, বাবা, পরিবার, আত্মীয়-পরিজন নিশ্চিত আছেন বা ছিলো। আপনার আমার মতোই তাদের জীবনেও অনেক অনেক গল্প আছে বা ছিলো, হাজারো সেই জীবন কাহিনীর শেষ দৃশ্যে আজ মানবতার চরম পরাজয় দেখেও কি আমরা নীরব থাকবো এভাবেই?
অসংখ্য এই ভাসমান মানুষের পরিচয় কি, এদের জাতীয় পরিচয় পত্র আছে কিনা, এরা কি ভোটার? এরা কি কেউ কেউ নিজের ইচ্ছেতেই রাস্তায় ঘুমায়? কিভাবে এদের ঘুম আসে? আসলেই কি ঘুমাতে পারেন তাঁরা? আমি তো অসংখ্য গাড়ি-বাড়ি-ফ্লাটের মালিক কোটিপতি মানুষকে চিনি যাদের ঘুমের ঔষধ ব্যতিত ঘুম আসে না। রাস্তায় যারা গাড়ির তীব্র শব্দ উপেক্ষা করে বেঘোরে ঘুমাতে পারেন তাঁরা আসলে কি কোন সুপার পাওয়ারের অধিকারী? আমিও কি পারি ওভাবে রাস্তায় কাথা-বালিশ বিছানা ছাড়া ঘুমাতে? একবার কি ভাবতেও পারি অমন পরিবেশে ঘুমানোর? আমি শুনেছি জেলখানায় তৃতীয় শ্রেনীর কয়েদীদের নাকি বালিশ ছাড়া ঘুমাতে দেয়া হয়, এটা তাদের কৃত অন্যায়ের শাস্তি দেয়ার যুক্তিতে হয়তোবা ঠিক আছে ধরে নেয়া যায়। কিন্তু এই যে রাস্তায় বসবাস করা ভাসমান মানুষদের শাস্তি পাবার কারনটা কি? জেলখানায় তবুও চার দেয়াল, মাথার উপর ছাঁদ থাকে, ঝড়বৃষ্টি থেকে বাঁচা তো যায় অন্তত। এদের তো সেইটুকু থেকে রক্ষা পাবারও উপায় থাকে না, এরা কি রাষ্ট্রহীন, এরা কি নাগরিক নন? অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান এর মৌলিক চাহিদা কি এদের জন্য প্রযোজ্য নয়?
আমরা রাজধানীর অভিজাত এলাকা ও ফ্লাটবাসীবৃন্দ প্রতিনিয়তই ভাসমান মানুষদের মুখোমুখি হই। এসব আমাদের গা সওয়া ব্যাপার বা আদৌ কোন চিন্তার খোরাক আমাদেরকে নাড়া দেয় না। আমি জানি না সরকারি বা বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ভাসমান মানুষদের জন্য ঠিক কি পরিমান রাত্রিযাপন কেন্দ্র আছে? সেখানে কিভাবে রাত্রিযাপনের যোগ্য হতে হয় সে সম্পর্কেও আমার কোন ধারনা নেই। কি পরিমান মানুষ ঢাকা শহরে রাস্তায় রাত্রিযাপন করেন তারও কোন পরিসংখ্যান আছে কি না আমি জানি না। ভাসমান মানুষদের নিয়ে কোন দেশীয় বা আন্তর্জাতিক সংস্থা উন্নয়ন প্রকল্প পরিচালনা করে কিনা সেটাও জানা নেই। ভাসমান মানুষদের অজানা পরিচয়ের মতোই বাকী সব তথ্যই আমাদের অজানা। মানুষ নামের এসকল ভাসমান প্রাণীকুলের প্রতি আমাদের দায়িত্বও কি অজানা? ভিক্ষা ছুড়ে দিয়ে চোখ বুজে থাকাটাই কি আমাদের কাছে একমাত্র সমাধান? রাজপ্রাসাদে যারা সুখের মহাসমূদ্রে অবগাহন করেও ঘুমাতে পারেন না তারা কি একদিন ফুটপাতে ঘুমানোর চেষ্টা করে দেখবেন? ঘুম আসতেও পারে, হঠাৎ করে তুরষ্কের ভূমিকম্পে আমরা কোটিপতিদেরও রাস্তায় এক টুকরো রুটির জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি কিন্তু জনাব!
পল্লব খন্দকার
১৮ জুন ২০২৩।
Leave a Reply