আর জে কিবরিয়া অসাধারণভাবে খুবই বিশেষ বিশেষ মানুষদের জীবনের গল্প বলিয়ে থাকেন তাঁর ব্রান্ডিং বাংলাদেশ নামক একটি অনুষ্ঠানে। আপাত দৃষ্টিতে একেকজন সাধারণ মানুষের জীবনের অসাধারণ গল্পগুলো শুনতে শুনতে আবেগ ধরে রাখা যায় না, চোখ ভিজে ওঠে সেইসব অনন্যসাধারণ গল্পগুলো অনুষ্ঠানে আগত ব্যক্তিদের নিজ মুখেই শুনতে বা দেখতে। ব্রান্ডিং বাংলাদেশের এমনই একটি পর্বে (৫৩ নম্বর এপিসোড) আর জে কিবরিয়া গল্প বলিয়েছেন এমন একজন নারীর যিনি বাংলাদেশের এ্যাথলেটিক জগতের বিস্ময়কর প্রতিভা। তাঁর অনন্যসাধারণ প্রতিভার পিছনে অমানুষিক সংগ্রাম আর ত্যাগের গল্প শুনলে আপনার জীবনে অনুপ্রেরণার কোন অভাব কোনদিন থাকবে না।
নব্বই দশকে দেশের যে সব উইমেন অ্যাথলেট ট্র্যাক এন্ড ফিল্ড-এর লড়াইকে ভীষণ রকম রাঙিয়ে তুলতেন তাদের মধ্যে অন্যতম খুলনার লাভলী বেগম। পুরো নাম সুলতানা পারভীন লাভলী। ৯২ সালে সবাইকে চমকে খুলনার এই কিশোরী ১০০ মিটার স্প্রিন্টে প্রথমবারের মতো দেশসেরা হয়েছিলেন। এরপর আরো অনেক অনেকবার পরেছেন বিজয়ের মুকুট। দেশের সাবেক এই দ্রুততম মানবীর ভাষ্যমতে সাতবার তিনি দ্রুততম মানবীর পদক জয় করতে সক্ষম হয়েছেন। ৯২ থেকে টানা ২০০০ সাল পর্যন্ত ট্র্যাক এন্ড ফিল্ডে স্প্রিন্টারের লড়াই-এ লাভলী ছিলেন অনবদ্য অনন্য এক নাম। মিষ্টি চেহারার মেয়েটি লড়তেন বিজেএমসির পক্ষে। শেষ বিদায় নেন তিনি ২০০০ সালে ২৬তম জাতীয় অ্যাথলেটিক্সের আসর থেকে। বিদায় নেওয়ার পর অনেকটাই অন্তরালে চলে যান। নিরবে-নিভৃতে থাকার ইচ্ছেটাকেই বেশি প্রাধান্য দেন। মাঠের চেয়ে নিজের পেশাগত জায়গাতে একটু বড় বেশি মনোযোগী হন। নিঃসন্দেহে ১০০ মিটার স্প্রিন্টারের অনবদ্য লড়াই-এর আকর্ষণীয় ও আলোকিত এক নাম লাভলী। নব্বই-এর প্রারম্ভে একেবারে গাওগেরাম থেকে উঠে এসে তীব্র আঘাত হেনে তিনি অন্যদের পরাভূত করেছিলেন। কারো ভাবনাতেই ছিলোনা গ্রামীণ এমন এক মিষ্টি কিশোরী এসেই আচমকা ট্র্যাক এন্ড ফিল্ডের ১০০ মিটারে বাজিমাত করবেন।
সে সময় বিটিএমসির স্প্রিন্টার ফিরোজা খাতুন ভীষণ রকম অপ্রতিরোধ্য। কারো সাধ্য নেই যেনো তাকে ধরার। অ্যাথলেট নাজমা হায়দার রাফেজা, নিলুফার ইয়াসমিন, মাহবুবা বেলী, ফরহাদ জেসমিন লিটি শত চেষ্টা করেও ফিরোজাকে পেছনে ফেলতে একেবারেই ব্যর্থ। ফিরোজার তীব্রগতির কাছে সবাই অসহায়। স্প্রিন্টারের লড়াই-ই ফিরোজা যেনো ট্র্যাক এন্ড ফিল্ডের একচ্ছত্র রাণী। ৯১ সালেও তাই ১৯ তম জাতীয় অ্যাথলেটিক্সে বিটিএমসির ফিরোজা ১২.৫ সেকেন্ড সময় নিয়ে দ্রুততম মানবী হন। কিন্তু পরের বছরই জাতীয় অ্যাথলেটিক্স মিটে নবাগত এক কিশোরীর কাছে তাকে হারতে মানতে এটা বোধ হয় তার স্বপ্নেও ছিল না। ৯২ সালে ফিরোজাকে পরাজিত করে শীর্ষে উঠে আসেন নবাগত সুলতানা পারভীন লাভলী। সে সময় ক্লাস নাইনের ছাত্রী তিনি। ১২-১৪ ফেব্রুয়ারি এই তিনদিন জাতীয় অ্যাথলেটিক্সের বিশতম আসর বসে রাজধানীর আর্মি স্টেডিয়ামে। অভিজ্ঞদের সাথে বিজেএমসির হয়ে জাতীয় পর্যায়ের লড়াই-এ অংশ নিতে ট্র্যাকে নামেন কিশোরী লাভলী। ট্র্যাক এন্ড ফিল্ডের এমন লড়াই-এ লাভলী তখন একেবারেই আনকোড়া। ঢাকা শহরটাই যার কাছে স্বপ্নের মতো। কিন্তু প্রচন্ড আত্মবিশ্বাস নিয়ে ট্র্যাকে দাড়ান। ফায়ারের পর পরই রানিং ট্র্যাক থেকে ছিটকে বের হন তিনি। অপ্রতিরোধ্য, অভিজ্ঞ ফিরোজা, নিলুফারকে টপকে লাভলী ১৩.৪ সেকেন্ড সময় নিয়ে প্রথমবারের মতো দ্রুততম মানবী হন। পরের দিন দেশের সব পত্রিকার প্রথম পাতায় ছাপা হয় লাভলীর ছবি।
ক্রীড়াক্ষেত্রে অনন্য অবদানের জন্য সাবেক সেই দ্রুততম মানবী লাভলী সম্প্রতি জাতীয় পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ২০১৬ সালের জন্য যাদেরকে জাতীয় পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত করা হয়েছে সেই তালিকায় সবার আগে রয়েছে লাভলীর নাম। নিঃসন্দহে জীবনের আরেকটি আনন্দঘন দিন তার কাছে এসেছে। যদিও এমন দিনটি তার জীবনে আরও আগেই আসা উচিত ছিল বলে তিনি মনে করে। তবুও ভীষণ খুশি লাভলী- সেই আজন্ম লড়াকু মেয়েটি।
নব্বই দশকে ট্র্যাক এন্ড ফিল্ডের লড়াই-এ তার আসাটাও ছিল দীর্ঘ এক লড়াই। সেই লড়াই তার কখনই থামেনি, এখনও নয়। লাভলীর গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়াতে হলেও তার জন্ম হয় খুলনার তেরখাদা উপজেলার শেখপুরা নানাবাড়িতে। আর এ কারণেই শৈশব আর কৈশরের দিনগুলি কাটে খুলনাতে। আজগড়া বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিলেন। প্রাইমারিতে যখন পড়তেন তখনই তিনি যে কোনো ধরনের দৌড় প্রতিযোগিতায় প্রথম হতেন। হাইস্কুলে ওঠার পরও সেই দৃশ্য অটুট থাকে। স্কুলের কোনো প্রতিযোগিতায় লাভলী অপরাজেয় অপ্রতিরোধ্য। ৯১ সালে বিজেএমসির খুলনা জোনের আন্তমিলের মধ্যে অ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগতার আয়োজন করা হয়। লাভলীর এক ফুফাতো ভাই ঐ কম্পিটিশনের নিয়ে যান লাভলীকে। ফ্রক পরা নবাগত লাভলী ওখানে ১০০ মিটার স্প্রিন্টারে প্রথম হয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ঐসময় অ্যাথলেটিক্স সংশ্লিষ্টরাও বুঝতে পারেন মেয়েটির মধ্যে অনন্য প্রতিভা আছে। সঠিক প্রশিক্ষণ দিলে মেয়েটি জাতীয় পর্যায়ে বড় কিছু করতে পারবে। এসময় আরিফ নামে একজন অ্যাথলেট তৃণমূলের প্রতিভাদের প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেন। সেখানে তৃণমূল প্রতিভা লাভলীকেও যুক্ত করেন। কিন্তু লাভলীর জন্য ছিল এটি এক দূরহ অধ্যায়। সে সময় যোগাযোগ ব্যবস্থা এত উন্নত ছিল না। ফলে গ্রামের বাড়ি থেকে ৪৫ কিলোমিটার পথ অনেক কষ্ট করে পাড়ি দিয়ে তাকে শহরে আসতে হতো। অনুশীলনের দিনে রাত তিনটায় বাড়ি থেকে বের হতেন। ভ্যানে দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে এরপর আসতেন শহরে।
৯১ সালে প্রশিক্ষণের মধ্যে দিয়ে লাভলী নিজেকে বেশ তৈরি করেন। এরই ধারাবাহিকতায় একসময় খুলনার পিপলস জুট মিল তাকে নিয়োগ দেয়। এসময় বড় চমকটা দেন তিনি আন্তঃবিজেএমসির প্রতিযোগিতায়। ঘাসের মাঠে দৌড়িয়ে ১২.৫০ সেকেন্ড সময় নিয়ে প্রথম হন। বিজেএমসির তখন কোচ শাহআলম। তিনি বুঝতে পারেন-লাভলীর প্রতিভা এখন কেবলই উন্মোচনের পালা। লাভলীকে তাই বিজেএমসির ক্যাম্পে যোগ দিতে বলা হয়। শুরু হয় লাভলীর নতুন এক পথ চলা। অনেকটাই প্রাতিষ্ঠানিক কাঠমোর মধ্যে ঢুকে পড়েন তিনি। ৯২ সালে লাভলী ১০০ মিটারে শীর্ষস্থান দখল করেন। ৯২ সালে ২০ তম জাতীয় অ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতা হয় আর্মি স্টেডিয়ামে। এই প্রতিযোগিতাতে বিজেএমসির পক্ষে নামেন তিনি। প্রথমবারেই বাজিমাত । ১৩.৪০ সেকেন্ডে সময় নিয়ে দ্রুততম মানবী হন। বিজেএমসির নিলুফার এবং বিটিএমসির ফিরোজাকে পরাজিত করেন তিনি। এই বছরে লাভলী ২০০ মিটার স্প্রিন্টারে সাফল্য পেয়ে দ্বিতীয় হন। আবার রিলেতেও তিনি চমৎকার পারফরমেন্স করেন। নিলুফার, নাসিমা এবং লুবনাকে সাথে নিয়ে প্রথম হন।
জাতীয় অ্যাথলেটিক্সে ১০০ মিটারে লাভলীর সেরা টাইমিং ১২.২০ সেকেন্ড। ৯৯ সালে অনুষ্ঠিত ২৫ তম জাতীয় অ্যাথলেটিক্সে এই সময় নিয়ে তিনি প্রথম হন। দ্বিতীয় হন শাম্মী এবং তৃতীয় হন বিকেএসপির ফৌজিয়া হুদা জুই। আবার ৯৬ সালে অনুষ্ঠিত অ্যাথলেটিক্সের ২২ তম আসরে ১২.৯৪ সেকেন্ড সময় নিয়ে তিনি দ্রুততম মানবী হন। সে বছরে দ্বিতীয় হন ফিরোজা খাতুন (১৩.০০) এবং তৃতীয় হন মোল্লা সাবিরা (১৪.০২)। বাংলাদেশ অ্যামেচার অ্যাথলেটিক্স ফেডারেশন আয়োজিত ফিফথ সামার অ্যাথলেটি´ মিটে লাভলীর টাইমিং ছিল ১২.৫০ সেকেন্ড। অ্যাথলেট জীবনে লাভলী জাতীয় পর্যায়ের বাইরে অনেক আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতাতেও অংশ নেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য জুনিয়র ওয়ার্ল্ড অ্যাথলেটিক্স, উইমেন ইসলামিক গেমস, ওয়ার্ল্ড অ্যাথলেটিক্স চ্যাম্পিয়নশীপ, টোকিও এশিয়ান গেমস ইত্যাদি। জীবনের অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে এসেছেন লাভলী।
তবে ট্র্যাক এন্ড ফিল্ডের লড়াকু এই মেয়েটি কখনই হাল ছাড়েননি। সবসময় মাকে স্মরণে রাখেন। মনের আয়নায় মাকে দেখেন। লাভলীর মা মর্জিনা বেগম ২০১৯ সালে মারা যান। লাভলী মনে করেন তার জীবনের সব অর্জনে যিনি ছায়া হয়ে থেকেছেন তিনি তার মা। মায়ের উৎসাহ, অবদান আর ত্যাগের কথা তিনি ভুলতে পারেন না। আর তাই নিত্য মাকে স্মরণ করেন। লাভলী বলেন, ‘মায়ের ভালোবাসা আর উৎসাহ না পেলে আমি কিছুই করতে পারতাম না। মা-ই পথ দেখিয়ে দিয়েছিল। আজ মা বেচে থাকলে আমার জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্তিতে ভীষণ খুশি হতেন।’ মা চলে গেলেও লাভলীর বাবা হাবিবুর রহমান বেচে আছেন। অ্যাথলেটদের মধ্যে লাভলীর ভীষণ প্রিয় ছিল ৯৫ সালে দক্ষিণ এশীয় গেমসে ২০০ মিটার স্প্রিন্টারে স্বর্ণজয়ী অ্যাথলেট মোহাম্মদ মাহবুবুল আলম। লাভলী বলেন, ‘আমার সবসময় ভালো লাগতো মাহবুব ভাইকে। তার লড়াকু স্টাইলটা আমি মনে প্রাণে ধারণ করতাম। সবসময় তাঁকে ফলো করতাম। আর দেশের বাইরে স্প্রিন্টার ম্যারিয়ান জোন্সকে আমার অসম্ভব ভালো লাগতো। এখনও তাঁকে ভালোবাসি মনে প্রাণে।’
২০০২ সালে অনেকটা অভিমান নিয়েই ট্র্যাক এন্ড ফিল্ডের লড়াই থেকে বিদায় নেন লাভলী। আরও অনেকদিন ট্র্যাক এন্ড ফিল্ডের লড়াই-এ তিনি থাকতে পারতেন। লাভলীর ভাষায় ‘আসলে আমার লড়ার মতো আরও সময় ছিল। কিন্তু মন চাইলো না বলে আমি চিরবিদায় জানালাম ট্র্যাক এন্ড ফিল্ডকে। তবে পরবর্তীতে আমি কোচ হিসেবে কিছুদিন কাজ করেছি। ২০১৫ সালে বিজেএমসি থেকে আমাকে কোচিং প্রধান করে দায়িত্বও দেওয়া হয়। কাজও করি। অ্যাথলেট ইবাদ আলী, রকিবুল, নাদিম আমার হাতেই গড়া। ওদের সাফল্য দেখলে নিজেকে ধন্য মনে হয়। কিন্তু এখনতো আর কাজ করার সুযোগ নেই।’ অ্যাথলেটিক্সের এখনকার দুর্দিনে অন্যদের মতো লাভলীও হতাশ। লাভলী বলেন, ‘অ্যাথলেটিক্সের সেই বর্ণিল রঙ-রূপ নেই। আগে দ্রুততম মানব-মানবীর ছবি ছাপা হতো প্রথম পাতায়। আর এখন কেউ জানতেই পারে না। এই দুর্দিন থেকে অবশ্যই অ্যাথলেটিক্সের সেই সোনালী দিন ফিরিয়ে আনতে হবে।’
লেখা সংগ্রহ: চ্যানেল আই অনলাইন পত্রিকা।
Leave a Reply