প্রিয় পাঠক,
প্রতি শুক্রবার সাহিত্য পাতায় শাইনি শিফার ধারাবাহিকটি প্রকাশ করার ঘোষণা থাকা সত্ত্বেও অনিবার্য কারনবসতঃ যথাসময়ে প্রকাশ না করতে পারায় লেখক ও পাঠকগণের কাছে আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ করছি।
-দৈনিক আলোকবর্তিকা সাহিত্য ডেস্ক।
একটা ছোট্ট উকুন আনতে গিয়ে মাথায় জোরে একটা চিমটি কাটে শায়লা। রুবি ‘উফ, মা গো’ বলে ওঠে।
“এত জোরে খামচা দিলা ক্যান, ভাবী? তুমি জানো না আমার মাতা ব্যাথার ব্যারাম আছে? তুমি মইধ্যে মইধ্যে ইতা করো ক্যারে আমার লগে?”
শায়লা রুবির চুল ঠিক করতে করতেই বলে, “এই জীবন আর বালা লাগে না রে, বইন। আমার ভাইয়ের শালাডা বিদেশ গ্যাছে। সৌদি। কত্ত কিছু
” তোমার ভাইরে না, কও যে তার বইনরে নিবো। লগে তার ভাই যাইবো। ”
” ঐ হইলো, একই তো কথা। তুই অমন চ্যাং চ্যাং কইরা কথা কস ক্যারে রে? হেইর লাইগ্গা মাঝে মাঝে তোর লগে কথা কইবার মন চায় না। ”
কথাগুলো বলে শায়লা রুবির মাথাটা ধাক্কা দিয়া সরায়ে নিজের ঘরে চলে যায়।
‘তয় কি ভাবীও যাইবা গা? ভাবীর ভাই গেলে তো কয়দিন পরে ভাবীরেও লয়া যাইবার পারবো। তহন তো ভাবীরও মাডিতে পাও পইড়বো না। তহন কি রুবি এইহানে বইয়া বইয়া চুলা ঠেলবো নাকি? কলস কলস পানি আনবো নাকি? কুপি জালাইয়া মশার কামড় খাইয়া পাখা দিয়া বাতাস কইরা শাশুড়িরে ভাত বাইড়া দিবো নাকি?
কিছুতেই না।
এইডা হইতে দেওন যাইবো না।
কিছুতেই না। ‘
রুবী মনে মনে কত কি যে ভেবে যায়!
পরের কয়েকদিন রুবি এমনি এমনিই শায়লার গা ঘেঁসে চলে। খাওয়ার সময় মুখ বাড়ায়ে দিয়ে কয়, “বুজি আমারে একমুঠ ভাত মুহে তুইল্লা দাও দিহিনি। ”
শায়লার মন এমনিতেই খুব নরম। রুবির এমন করা দেখে তারও খুব ভালো লাগে। ভাবে, রুবিডা তো বহুত বালা হইয়া গ্যাছে৷ কেমন আপনা আপনা ছুডো বুইনের মতন লাগে। বালা হইলেই বালা। রুবিডা কত্ত ছোডো থাকতে আইছে! সারাদিন শায়লার পোলা রাজুরে কোলে কইরা রাখতো। এই চার বছরেই মাইয়াডা কেমন যেন গায়ে গতরেও বড় হইয়া উঠছে। মুখটা অক্করে পূর্নিমার চান্দের লাহান দ্যাহা যায়।
তারও কিছুদিন পর, রুবি একদিন রাজুর হাত ধইরা পাশের দোকানে যায় বিস্কুট কেনার জন্য। দোকানে আরো লোকজনও বসা ছিল। রুবিরে ঘোমটা মাথায় দিয়া দেখে দোকানের একজন বলে ওঠে,
“কি গো আলমের বউ, তুমরাও কি নজরুলের মতন বিদ্যাশ যাইতাছো নি? সবতে মিল্লা বিদ্যাস গেলে তোমার হউড়িরে দ্যাখবো কিডা? বইনডারেও তো ছুডো থাকতেই বিয়া দিয়া ফালাইছো।”
কথাটা শুনে রুবি হতভম্ভ হয়ে যায়। বুজিরা চইলে যাইচ্ছে? তারে একবার বইল্লোও নাহ!! এইডা কেমনে চাইপা রাখলো বুজি? তলে তলে বিদ্যাশ যাওয়ার সব ধান্ধা সাইরা ফালাইছে? এতডি ট্যাহাই বা পাইলো কোথায়? নজরুল ভাইও তো আলমরে কিছু কইলো না। দুইডাই মাত্র ভাই। মাঝে মাঝে ইতা করে দেইখ্যাই তো বালা লাগে না। আমাগো জানাইলে কি হইতো? আমরা কি হ্যাগো যাওন বন্ধ কইরা দিতাম!
রুবি গজ গজ করতে করতে রাজুর হাত ছাইরা দেয়। এই যে রাজুরে সে নিজের পুতের মতন কইরা ভালোবাসে। এই রাজুও যাইবো গা!
রাজু থাকবো না, বুজি থাকবো না। তাইলে হে নিজে থাকবো কেমনে? রুবি রাগে দুঃখে ফুলতে থাকে।
বাড়ির ভিতরে এসেই শুরু করে,
“বুজি, ও বুজি, তুমরা নাকি সৌদি যাইতাছো গা? একবার একটু আমাগো জানাইলাও নাহ! জানাইলে কি আমরা তোমার লগে যাইতে চাইতাম নাকি তোমাগো যাওন বন্ধ কইরা দিতাম?”
“শোন, রুবি। ম্যালা প্যাক প্যাক করিস না। যাওনের অহনও কিছুই হয় নাই। ভিসাও পাই নাই, টিকিটও পাই নাই। হইলে তো কইতামই। তরে কমু না, তো কারে কমু ক’। তর ভাই খালি কয়ডা কাগজপত্র ঠিক করছে। তাতেই কি যাওয়া হইয়া গেল নাকি? ”
“হ, অহন তো কত কথাই হুনাইবা! তোমরা সব সমেত যাইবা গা — এইডা আমার বাইরের মাইনষের কাছ থন হুনোন লাগে। যাও যাও। সবডি মিল্লা যাও গা। আমরা একলাই থাকুম। আমি একলাই থাকুম। আমার কারো লাগবো না। তুমারেও লাগবো না, রাজুরেও লাগবো না। ”
কথাগুলো বলার সময রুবির গলা ধরে আসে। শায়লারও গলা বন্ধ হয়ে আসে। রুবিটা যেমনই একটু মেজাজী হোক না কেন, একসাথে তো ভালোই ছিল।
শায়লা মনে মনে বলে, আগে যাইয়া লই, তারপর তোগোরেও লওনের ব্যাবস্থা করুম। আমি কি আর তরে থুইয়া ঐহানে একলা গিয়া শান্তিতে থাকবার পারমু রে পাগলী?
তারপর শায়লারা আসে সৌদিতে।
শায়লারাই আবার সব ব্যাবস্থা করে দেয়াতে বছর দুই পরে রুবিরাও এসে পরে সৌদিতে ।
শায়লারা এসে একটা দুই বেডরুমের বাসায় ওঠে। নজরুল বিল্ডিং বানানোর কাজে ব্যাস্ত থাকে সারাদিন। সৌদিতে একজন ক্ষুদে দিনমজুরকেও মাথায় হেলমেট, পায়ে ইয়া বড় বড় বুট পড়ে কাজ করতে হয় সারাক্ষণ। আগে সেই সব ছবিগুলো রুবিকে পাঠাতো মাঝে মাঝে। আর রুবি মনে করতো, সৌদিতে না জানি কতকিছু করে ফেলতেছে ওরা! শায়লার এখানে ওখানে ঘোরাঘুরির ছবি দেখে রুবির চোখ কপালে উঠে যেত। শায়লাকে হাতে পায়ে ধরে বলতো, বুজি আমারে নিয়া যাও। তোমারে ছাড়া রাজুরে ছাড়া আমার এইহানে বালা লাগে না। ‘
সব কাগজপত্র আর জমি জিরাতের ব্যাবস্থা করে রুবিরাও চলে আসে ক’দিন পরেই।
কিন্তু আসার কিছুদিনের মধ্যেই শায়লা বুঝতে পারে যে, রুবির চাওয়াগুলো একেবারে আকাশচুম্বী। রুবি টিভি কিনবে ৫৪ ইঞ্চি। এত ছোট বাসায় এত বড় টিভি দিয়ে সে কি করবে? মানুষ তো মাত্র দুইজন। এখনো বাচ্চা হয় নি ওদের।
বাসায় উঠেই শুরু করেছে তার ওভেন লাগবে, রাইস কুকার লাগবে, মপিং মেশিন লাগবে, ফ্রায়ার লাগবে। এমন ছোট্ট বাসায় এতকিছু রাখবেই বা কোথায়! আলম বেশি কিছু বলতে গেলেই জোরে জোরে চিল্লাচিল্লি শুরু করে দেয় রুবি। শায়লা মাঝে মাঝে রুবিকে বোঝায়। বোঝাতে গেলে রুবি ইদানিং আরো মেজাজ দেখায়।
এই তো সেদিনের কথা। রুবি সেদিন ঘরে রান্না করে নাই। তার নাকি মাথা ব্যাথা করতেছিল। আলমরে বলেছিল খাবছা কিনে আনার জন্য। আলমের বাসায় আসার সময় সেটা মনে ছিল না।
সেটা নিয়ে কি যে বাড়াবাড়ি করলো রুবি! শায়লা তাকে বোঝানোর জন্য গেছিল। রুবির কথায় সে খুব মনোকষ্ট পেয়েছে।
“বুজি, এইডা আমাগো ব্যাপার, আমাগো সংসার। আমাগো সংসারের সব ব্যাপারে তুমি নাক গলাবার আসপা না তো। এইডা তুমার গিরামের বাড়ি না। আমার জামাইরে আমি খাবার আনতে বলছি। এইহানে তুমি আইসে তার পক্ষ নিয়া কথা বইলতিছো ক্যান? ”
” শোন, বুন্ডি, আলম সারাদিন কাজ-বাজ কইরে মনেকয় ভুইলে গেছে। তাছাড়া আমার ঘরে তো ভাত আছেই, আমি দিচ্ছি। তরা খায়ে ল’। কাইলকে কিনে দিবিনি তোর খাবছা। জামাইরা কাম থিকা ফিরলি এমুন করবার নাই রে, রুবী।”
“তুমি আমারে জ্ঞান দিও না তো, বুজি। আমাগো সব ব্যাপারেই তুমার মাথা খান গলানো লাগবি ক্যা? তোমাগো কারনে এহানে আসপার পারছি বইলে কি আমাগো মাথা কিন্না নিছো না কি? তুমি তুমার মত সংসার চালাও। তুমার মতন অমন চাইল-ডাইলের খিচুরীর সংসার আমার চাই না। ”
এরপর আর কথা বাড়ায় না শায়লা। ওখান থেকে চলে আসে। নিজের খাটের উপর বসে থাকে ঝুম মেরে। রুবি এখানে এসে এমন করে পাল্টে যাবে — বোঝে নাই সে। রুবির সাথে ইদানিং কথাই বলা যায় না। কিছু বললেই ঝ্যাং ঝ্যাং করে ওঠে। একটা বিকেলও তারা একসাথে গল্প করে কাটায় না। রাজু তার চাচীর বাড়ির বড় টিভিটা দেখার জন্য অস্থির হয়ে ওঠে বিকেল হলেই। রাজুকে বাঁধা দেয় না শায়লা। আর যাই করুক, রুবি এই রাজুরে খুব ভালোবাসে। নিজের পোলার মত কইরা ভালোবাসে।
কিন্তু রুবি কখনো শায়লাকে ডেকে পাঠায় না। মাঝে মাঝে অবশ্য এটা সেটা, ফলমূল রাজুর হাতে দিয়ে পাঠায়। রাজু আনে, রাজুই খায়। শায়লার আর ওগুলো খেতে ইচ্ছা করে না। ভালোবেসে কেউ বিষ দিলেও সেটা খেতে ভালো লাগে।
রুবি নাকি ওর বাপের বাড়ির সম্পত্তির ভাগ পেয়েছে। আলম বলেছে নজরুলকে। সেটা বিক্রি করে তারা এখানে ফ্ল্যাট কিনবে। কিনুক। রুবিরা ভালো থাকুক। আলমরা ভালো থাকুক। শায়লা একটা কাজ খুঁজতেছে। বাসা বাড়ি থেকে কাজের মানুষ চায় এখানে। ঘর পরিষ্কার করার কাজ। কিন্তু শায়লা খবর নিয়েছে, এখানের প্রায় প্রত্যেক ঘরে ঘরেই কাজের মেয়েরা সৌদি ছেলেদের কর্তৃক হয়রানি হয়। এরা ঘরের কাজের চেয়ে শরীরের কাজটাকেই আগে ভোগ করে নিতে চায়। অবশ্য তাতে নাকি ম্যালা টাকাও অফার করে। শায়লা এসব নোংরামির মধ্যে যেতে চায় না। নজরুল যা আনে — তাতেই খুশি সে। রুবির মত বড় টিভি, দুই পাল্লার ফ্রিজ, লেদারের সোফা, হাতভর্তি সোনার বালা— দরকার নাই তার।
ইদানিং রুবির টাকার ঝনঝনানি যত বাড়ছে, মুখের ঝনঝনানি তার চেয়েও বেশি বাড়ছে। শায়লার সাথে ঝগড়া লাগলেই সে তুই তোকারি করে কথা বলে। শায়লার খুব খারাপ লাগে। রুবি এমন করে পাল্টে গেল!! টাকা মানুষকে এতকিছু দিতে পারে? এত অহংকার, এত তাচ্ছিল্য, এত কদর্যতা!!
সেদিন রুবি ৫ টা দামী চকচকে কাজকরা শাড়ি এনে শায়লাকে দেখিয়েছে। শাড়িগুলো খুব সুন্দর। শায়লা কতক্ষণ শাড়িগুলো হাত দিয়ে দিয়ে দেখলো। তার বাংলাদেশ থেকে আনা জর্জেট বা সিল্ক শাড়িগুলো এইসব বুননের চেয়ে অনেক বেশি মায়া আর আবেগ দিয়ে বোনা। শায়লাকে শাড়িগুলো টানলো না একটুও।
বললো,” বুজি, আল্লায় তরে দিছে, তুই পইড়া ল’। জামাইরে লোনে রাইখা বা অবৈধ কোনো কামে দিয়া এইসব শাড়ি আমি পড়লে আমার শরীর চুলকাইবো রে। ”
এসব কথা শুনে রুবি তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে।
“আলম কিছু করতে পারতেছে — এইডা তোগো সহ্য হয় না, নাহ? ছুডোলোক ছুডোলোকের মতই থাকবি। জীবনেও বড়লোক হইতে পরবি না। এগুলা দেখলে তর চোখ টাটায়, নাহ? আমি বুঝি তো। তর হিংসা লাগে, হিংসা। তুই আমার শাড়িতে নিঃশ্বাস লাগাইস না। ”
” রুবি রে, তর ভালোর জন্যই কইলাম। এমুন ট্যাহা কামাইয়ের লাইগ্গা তর জামাইরেও কইস না, তুইও করিস না। রাইতের ঘুম হারাম হইয়া যাইবো, দেহিস। ট্যাহা আর শান্তি একলগে বসত করে না রে।”
রুবি শাড়িগুলা উঠায়ে নিয়ে গজগজ করতে করতে চলে যায়।
(রুবি ও শায়লার পরবর্তী গল্প পড়তে পর্ব-৩ এ চোখ রাখুন আগামী শুক্রবার)
শাইনি শিফা, আবৃত্তিকার, বাংলাদেশ বেতার ও লেখিকা।
Leave a Reply