আজকে একটা গাছের টব সরানো নিয়ে হারামিটা যা করলো! আজকে আলম আইসা নিক। আইজ ওর একদিন কি আমারই একদিন! ভাতের বদলে একদিন ইট্টু পোলাও খাওনের মুরাদ নাই -- আমার লগে লাগতে আহে।
আলম সেদিন বাইরে থেকে কেবলই কিছু ফল আর মাংস নিয়ে বাসায় ঢুকেছে। শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বাথরুমে ঢুকেছে। বাথরুমের দরজাটা আর আটকাতে দিলো না রুবি।
" তোর পেয়ারের মাগী আজকে আমারে চুল ধইরা মারছে। তারপর মাটিতে ফালাইয়া পাড়াইছে। তাও তো তুই কিছুই ক'বি না। তোর তো ভালোবাসার ভাবী লাগে। "
" তুই কি করছিলি হেইডা ক'।"
" আমি কিছুই করি নাই। আমার আরেকটা গাছের টব রাহনের লাইগ্গা হেইর জুতার বাক্সটা এট্টু সরায়ে রাখছিলাম। হারামির বাচ্চাডা এইডার লাইগ্গা আমার লগে কাইজ্জা শুরু করলো, তারপর চুলের মুঠি ধরলো। তারপর আমারে মাটিতে ফালাইয়া আমার মুখের মধ্যে এত্তগুলা থুতু মারলো। তুমি কি কিছু কইবা নাকি আমি মজা দেহামু??"
আলম ঘুরে তাকায় রুবির দিকে। রুবির চোখ বড় বড় হয়ে আছে। থুতু ছিটানোর কথা শুনে আলমের গা টা রি রি করে উঠলো।
এত্ত বড় সাহস!! আমার বউয়ের মুখের উপর থুতু মারে!!
আলম দরজা খুলে বের হয়ে পাশের বাসায় যায়। রাগ তার মাথায় উঠে গেছে। একই তলার পাশাপাশি দুই ফ্ল্যাটে তারা থাকে। মানে, আলমরা এসে নজরুলের বাসার পাশেই উঠেছে। তারপর থেকে অশান্তি চলছেই।
"ভাই, ভাই, আজকে তোমার সোহাগের বউ আমার রুবিরে চুলির মুঠি ধরে টানছে। তোমার বউ কি সেইটা তোমারে কইছে?"
" না তো। কি হইছে রে? আমি তো মাত্রই ঘরে ঢুকলাম। হেয় তো আমারে কিচ্ছু কইলো না। "
" তা কইবো ক্যা? দোষডা তো হেয় নিজে করছে। কইবো কোন মুখে? তুমি তো সুন্দর মত তোমার বউয়ের আঁচলের তলে যাইয়া হুইয়া থাকবা। ঘরের মধ্যে কি হইতাছে --- এগুলা তো দ্যাহো না কোনো সময়।"
নজরুল শায়লার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে--
" শায়লা, শায়লা। তুমি কি রুবির মুখে থুতু মারছো? রুবির চুল ধইরা টানছো? তোমরা ক্যান এগুলা করো? আমি তো বুইজ্জা পাই না। "
" আপনে হুনেন, আগে কি হইছে, হুনেন। তারপর বিচার করেন। রুবি আমার জুতার বাক্সটা ভাইঙ্গা ফেলছে। এমুন জোড়ে টান দিয়া সরাইছে।"
"তাই বইল্লা তুমি অরে মারবা? আর কি করার বাকি রাখতাছো তোমরা? তোমরা এমুন আছিলা না। হঠাৎ এগুলা শুরু করছো ক্যারে?"
আলম এগিয়ে আসে আরেকটু। রাগান্বিত স্বরে বলতে থাকে, " হইছে? তোমার বিচার শেষ, ভাই? এই তোমার বিচার? বিচার করো, ভাই। বউয়ের আঁচলের থিকা বাইর হইয়া এট্টু বিচার করো। আর এমুন কইরা কতদিন ভাবীর পাও চাটবা? "
" এইডা তুই কি কইলি, আলম? আমি তর ভাবীর পাও চাডি? পাও তো চাডোস তুই। বউরে দিয়া রাখছোছ বাজারে। বাজারী বউ নতুন নতুন গয়না গায়ে দিয়া হাডে আর তুই হেই বউয়ের পাও চাডোস।"
"কি কইলা? আমার বউ বাজারী?"
কথাটা বলেই টেবিলে রাখা খালি জগটা নিয়ে ভাইযের দিকে ছুঁড়ে মারে আলম। কানের পিছনে গিয়ে জগটা লেগে খান খান করে ভেঙ্গে যায়। লুটিয়ে পড়ে নজরুলও। চিৎকার করে ওঠে শায়লা।
" এইডা তুমি কি করলা, ভাই? তুমি তোমার বড় ভাইরে মারলা?"
ইতিমধ্যে আশেপাশের ফ্ল্যাটের আরো কয়েকজন জড়ো হয়েছে। কিন্তু এতক্ষণ তারা কিছুই বলে নি। তারা প্রতিনিয়তই দেখছে এরকম ঝগড়াঝাটি, এরকম মারামারি।
তবে নজরুল মাটিতে লুটিয়ে পড়ার পর আর কোনো শব্দ করে নি। আশেপাশের মানুষজন ধরাধরি করে নিয়ে যায় হসপিটালে। আইসিইউ থেকে ঘন্টা খানেক পরে খবর আসে, নজরুলের মাথায় বেকায়দায় জগের বাড়িটা লেগে ব্রেইন হেমারেজ হয়েছে এবং পথিমধ্যেই সে মারা গেছে।
নজরুলের ময়না তদন্ত, ফরেনসিক বিভাগের রিপোর্ট এবং লাশকে বাংলাদেশে পৌঁছানোর ব্যাবস্থা করতে করতে প্রায় মাসখানেক সময় লেগে যায়। নজরুলের লাশ যাবে বাংলাদেশে।
এদিকে সারা গ্রামে ঢি ঢি পড়ে গেছে।
বিদেশে বসে দুই বউয়ের মধ্যে ঝগড়াঝাটি নিয়ে ছোট ভাই আলম তার বড় ভাই নজরুলকে খুন করেছে।
গ্রামের কেউই যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। এটা কেমন করে সম্ভব? বড় ভাই ছোট ভাইকে ঐ দেশে নিয়ে গেল একটু ভালো থাকার জন্য। আর ছোট ভাই ই কি না বড় ভাইকে খুন করলো?
আলম - নজরুলের একটিমাত্র বোন ফাতেমা । পাশের গ্রামেই থাকতো। বড় ভাইয়ের মৃত্যুর খবরে সেও চলে আসে মায়ের কাছে।
মা আর মা নেই। পাথর হয়ে গেছে যেন। সারাদিন খায় না, ঘুমায় না। প্রথম চার/পাঁচদিন শুধু কেঁদেই গেছে। এখন যেন চোখের পানিও শুকিয়ে গেছে। সারাদিন দাওয়ায় বসে থাকে আর ' নজরুল, ও নজরুল...' বলে কুহল মেরে কেঁদে ওঠে।
ফাতেমা মাকে বোঝাতে যায়।
মা কিচ্ছু বুঝতে চায় না। শুধুই বলে, আমার নজরুল আইবো, আমার নজরুল। '
তখন ফাতেমাও মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। তার ভাই। বড় আদরের ভাই। ফাতেমাকে সবসময় মাথায় করে রাখতো। লুকিয়ে লুকিয়ে হাটের থিকা জিনিস আইনা খাওযাইতো। চুলের ফিতা, ক্লিপ, চুড়ি কিনে আনতো। বিয়ের পরেও দুইদিন পরপরই তিন ক্রোশ হেঁটে হেঁটে চলে যেত ফাতেমার শশুড়বাড়িতে, ফাতেমাকে একটু দেখার জন্য।
আহরে ভাই রে!
বোনের কাছে বড় ভাই যে কত বড় একটা আশ্রয় --- সেটা সে বিয়ের পরে বেশি বুঝতে পেরেছে। ফাতেমার যখন বাচ্চা পেটে আসে, তখন বড় ভাই নজরুল প্রায় প্রতিদিনই বোনের বাড়িতে যেত। হয় আচার, নাহয় মোয়া, নাহয় তেতুল নিয়ে পলায়ে পলায়ে দিয়ে আসতো। আর ফাতেমার বরের জন্যও লুঙ্গি, গামছা, গেঞ্জি এগুলাও নিয়ে যেত মাঝে মাঝে। মায়ার কাছে সামর্থটা হার মানতো সবসময়।
রাতের বেলায় মাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে ঘরে নিয়ে ঘুমের ওষুধ খাওয়ায়ে ঘুম পাড়ায়ে দেয় ফাতেমা।
কাল দুপুরে বড় ভাইয়ের লাশ আসবে।
কিভাবে সহ্য করবে সে?
কিভাবে সহ্য করবে তার মা?
এসব কথা মাথায় ঘুরতে ঘুরতেই ঘুমের কোলে ঢলে পড়ে ফাতেমা।
পরদিন আর ওদের খাওয়া হয় না কারোরই।
শুধুই লাশের জন্য অপেক্ষা।
নজরুলের জন্য অপেক্ষা।
দুপুরের রোদের তেজ আজকে অনেক বেশি। উঠোনটা ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করে রাখা হয়েছে। এখানেই লাশ নামবে। গনগনে সূর্যের তাপে আজ উঠোন থেকেও যেন ধোঁয়া বের হচ্ছে।
মা বসে আছে। চোখটা কেমন যেন ধোঁয়াটে লাগছে। সূর্যের তাপের চেয়ে আজ মাটির তাপটাই বেশি হচ্ছে।
' আশহাদু আল্লাহ ইলাহা ইল্লাল্লাহু... ' পড়তে পড়তে কয়েকজন ঢুকলো বাড়ির ভিতরে। তাদের কাঁধে খাটিয়া। মা নিস্তব্ধ, নিথর হয়ে বসে আছে। চোখে পানি নেই, চোখের পলক ফেলা নেই। খাটিয়াটা রাখা হলো ধবধবে সাদা উঠোনে।
মাকে কেউ একজন টেনে নিয়ে গেল খাটিয়ার কাছে। মা ধপ করে বসে পড়লেন। চোখে কোনো জিজ্ঞোসু দৃষ্টি নেই, কোনো কিছু দেখার আগ্রহ নেই।
পাশের একজন হুজুর টাইপের লোক লাশের মুখের বাঁধনটা খুলে মুখটা বের করে দিল। ঝাপসা চোখে মা লাশটা দেখে চিৎকার করে উঠলো। এটা তো নজরুল নয় ---- আলমের লাশ।
গলায় তার ফাঁসির দাগ ষ্পষ্ট।
(সমাপ্ত)
শাইনি শিফা, আবৃত্তিকার, বাংলাদেশ বেতার ও লেখিকা।
লেখিকার এমন চমক জাগানো লেখা চমৎকার সাতটি ছোট গল্প পাবেন "বাদল বেলার বেহাগ" গল্প সংকলনে। বইটি ফেব্রুয়ারি ২০২৩ বইমেলায় আগামী প্রকাশনী প্রকাশ করে।