সম্প্রতি শিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি আত্মপরিচয় প্রদান করেছেন। এটি স্বৈরাচারী পতিত আওয়ামীলীগের গালে সর্বশেষ চপেটাঘাত। কোটা আন্দোলন দমনের জন্য যখন আওয়ামীলীগ সরকার নির্বাহী আদেশে বাংলাদেশ জামাতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল তখন জনগণ ভেবেছিল সরকার জনগণের মনোযোগ ভিন্ন দিকে ফেরাতে অসময়ে এই উদ্যোগ নিয়েছে। সরকারও তড়িঘড়ি করে কেন এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে বিষয়ে কোন সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা জনগণের সামনে তুলে ধরতে পারিনি। সেদিন যদি এই পরিচয় সরকারের কাছে থাকতো তাহলে আন্দোলনের গতিপথ পরিবর্তন হয়ে যেত। সরকারের কোন গোয়েন্দা বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিবিরের সভাপতির এই পরিচয় ঘুণাক্ষরেও জানতে পারিনি। এখন প্রশ্ন আসতে পারে কেন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির এই ছদ্মবেশী রাজনীতির পথ বেছে নিল? আর এই ছদ্মবেশী রাজনীতির ফলে কার কতটুকু লাভ বা ক্ষতি হলো? ছদ্মবেশী রাজনীতিতে জাতীয় জীবনে কিরূপ প্রভাব পড়ে বা পড়তে পারে?
প্রথম প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমরা দেখতে পাই যে, আওয়ামীলীগের শিবির ট্যাগিং এর রাজনীতির চর্চা। অর্থাৎ একজন মানুষ শিবির করে এটাই তার সবচেয়ে বড় অপরাধ। যে ছেলেটা শিবির করে তাকে অত্যাচার করা যাবে, নির্যাতন করা যাবে, যেকোনো সময় বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেপ্তার করা যাবে, তাকে দিনের পর দিন আদালতের মাধ্যমে রিমান্ডে নেয়া যাবে, পুলিশী নির্যাতন করা যাবে, ক্রসফায়ার দেয়া যাবে, কাছ থেকে পায়ে গুলি করে আজীবনের জন্য পঙ্গু করে দেয়া যাবে। অর্থাৎ রাষ্ট্রযন্ত্র এবং এর বাইরে রাজনৈতিকভাবে, সামাজিকভাবে এমন একটি বয়ান তৈরি করার চেষ্টা করা হলো যেখানে শিবির করা একটা ছেলে দেশের এবং জাতির শত্রু। এই অবস্থা থেকে বাঁচার জন্য শিবির তখন আত্মগোপনে চলে গিয়ে ছদ্মবেশী রাজনীতি শুরু করল। শিবির তখন ছাত্রলীগ সাজলো, শিবির তখন বামপন্থী সাজলো, কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে শিবির রয়ে গেল।
ফলে ক্ষমতাসীন দলের ভেতরে শিবির ঢুকে ঘুনপোকার মত ভেতর থেকে নষ্ট করে দিতে চেষ্টা করল এবং সেই জায়গায় কিন্তু শিবির সফলও হয়েছে। যে কারণে জুলাইয়ের সমন্বয়ক রাজনৈতিক খেলায় আওয়ামীলীগ হেরেছে। কারণ ছাত্রলীগ নিজের সংগঠনকে শক্তিশালী না করে যখন পুলিশের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ল তখন ছদ্মবেশী শিবির তাদেরকে সহজেই ধ্বংস করে দিতে সক্ষম হল। এমনকি গোয়েন্দা সংস্থার চোখ ফাঁকি দিয়ে সমন্বয় করে ৯ দফা দিয়ে, আন্দোলন ও আল্টিমেটাম সময়ের তাগিদে একদিন এগিয়ে এনে রাজপথে থাকতে সক্ষম হল। এখানে অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যাপক অবদান ছিল কিন্তু এই লেখার আলোচ্য বিষয়ঃ ছদ্মবেশী রাজনীতির ফলাফল অতএব প্রাসঙ্গিক কথা বলার উদ্দেশ্য এটা নয় যে, আন্দোলনের সমস্ত ক্রেডিট শিবিরের কাঁধে তুলে দেয়া।
সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আবার শিবির তখনই তাদের পরিচয় দিয়ে মাঠে সরব হয়েছে। কিন্তু ছদ্মাবরণের রাজনীতি করতে পারলে আড়ালে রাজনীতি করার পথ তৈরি হলে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে শিবির। কারণ বাংলাদেশের অন্য সব বড় দলগুলোর ক্ষেত্রে কিছুদিন দলীয় মিছিল মিটিংয়ে গেলে, নেতাদের সাথে লিয়াজোঁ করলে মোটামুটি একটা পরিচয় পাওয়া যায় যে, সে অমুক দলের কর্মী। সেক্ষেত্রে শিবিরের সাংগঠনিক কাঠামো সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির এবং দুদিনের পরিচয়ে তাদের দলে চট করে ঢুকে পড়ার কোনো সুযোগ নেই। কারণ তাদের সুনির্দিষ্ট কিছু পথ এবং পদ্ধতি পেরিয়ে নিজের শিবির পরিচয় নিশ্চিত করতে হয়। সেক্ষেত্রে তাদের এই পরিচয় লুকিয়ে রাজনীতি করার সুবিধা পাশে রেখে কেন নিজেদের আত্মপরিচয় প্রকাশ করার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠল? তার একমাত্র কারণ হলো রাজনীতিতে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকার চেষ্টা এবং জনগণের কাছে তাদের শক্তি সামর্থ্য সম্পর্কে জানান দেয়া, জনগণের কাছে জনপ্রিয়তা অর্জন করা।
অতএব আমরা কি দেখতে পেলাম? নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পথ যখন বন্ধ হয়ে যায় তখন সেই আদর্শের মানুষেরা আত্মগোপনে চলে গিয়ে বিপ্লবী হয়ে ওঠে, ফলে দেশ ও জাতির ভেতরে সংশ্লিষ্ট দলগুলো আইন অমান্য, রাষ্ট্রযন্ত্রকে ফাংশনিং করার ক্ষমতাকে দুর্বল করে দেয়ার জন্য তৎপর হয়। অতএব রাজনীতি বন্ধের আলাপ একটি জাতিকে দীর্ঘ মেয়াদে অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে ফেলে দেয়ারই শামিল।
সুতরাং বিএনপির মহাসচিব লেজুড়বৃত্তিক রাজনৈতিক চর্চা বন্ধের ব্যবস্থা করার যে প্রস্তাবনা দিয়েছেন সেটির দিকে নজর দিয়ে কাজ করাটা সবচেয়ে বেশি জরুরী। নচেৎ বলপূর্বক রাজনীতি বন্ধের ঘোষণা অবশ্যই অসুখকর। কারণ তখন প্রতিটি রাজনৈতিক দল বিপ্লবী ও প্রতিবিপ্লবী হয়ে রাষ্ট্র ও প্রশাসনের অগোচরে মাঠে কাজ করবে। সুতরাং আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনীতি নিষিদ্ধের হঠকারী সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে চিন্তা করতে হবে কিভাবে ছাত্রনেতার শত কোটি টাকার মালিক হওয়ার পথ রুদ্ধ করা যায়? কিভাবে লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি বন্ধ করা যায়। তাহলেই রাজনীতি করে স্বার্থ হাসিল করা দুর্জনেরা এমনিতেই রাজনৈতিক পথ থেকে ছিটকে পড়বে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রকৃত নেতারাই আগামীর জাতি গঠনের জন্য বেরিয়ে আসবে।
লেখা: মোঃ রবিউল ইসলাম।
সংকলন: দৈনিক আলোকবর্তিকা।