আমাদের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্রেণি কক্ষে এমনভাবে পড়াতেন যে অধিকাংশ শিক্ষার্থীগণ শ্রেণি কক্ষেই মুখস্ত করে ফেলতে পারতো পাঠ্য বইয়ের নির্দিষ্ট অংশটুকু। শিক্ষক হিসেবে এমন বিরল প্রতিভার দুই চারজন প্রত্যেকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে থাকেন। তাঁরা হন সব শিক্ষার্থীর কাছে জনপ্রিয়। আমি বিশ্ববিদ্যালয়েও একই চিত্র দেখেছি, কয়েকজন শিক্ষকের পড়ানোর দক্ষতা রীতিমত বিস্ময়কর! তাঁদের ক্লাস করলে পরীক্ষার সময় অতবেশি প্রস্তুতি না নিলেও চলতো। যদিও এমন বিরল দক্ষতা অধিকাংশ শিক্ষকের মধ্যে দেখা যায় না। আমার কাছে এইরকম প্রতিভাকে সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত মনে হয়, ইচ্ছে করলেই একজন এমন প্রাকৃতিকভাবে ভালো বোঝানোর সক্ষমতা অর্জন করতে পারবেন না। কেউ হাজার মেধাবী হলেও এটা নিশ্চিত করা যাবে না যে তিনি শ্রেণি কক্ষে পাঠদানে জনপ্রিয় শিক্ষক হতে পারবেন।
আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে দেখা একজন গোল্ড মেডেলিস্ট শিক্ষকের কথা মনে পড়ে। তিনি শিক্ষক হিসেবে যোগদান করে আমাদের ক্লাসে কি যে পড়াতেন তার মাথামুন্ড ক্লাসের কেউই বুঝতে পারতাম না। ব্যাপারটা তৎকালীন বিভাগীয় প্রধান স্যারকে জানালে তিনি এক কথায় বললেন- অসম্ভব! আমাদের অভিযোগ যাচাইয়ে চুপিসারে সেই গোল্ড মেডেলিস্ট শিক্ষকের ক্লাসে ঢুকে দশ মিনিটেই যা বোঝার বুঝে গিয়ে আমাদের ক্লাস টিচার পরিবর্তন করে স্যার নিজেই আমাদের পড়াতেন এবং স্যারের ক্লাসের পর সহজেই আমরা আত্মস্থ করতাম জীনতত্ত্বের মতো কঠিন বিষয়। তাই সকল শিক্ষকের কাছে সহজাত ক্লাস নেবার সক্ষমতা আশা না করলেও কেউ যদি ক্লাসে ভালো শিক্ষক হবার ব্রত গ্রহণ করেন অবশ্যই তিনি তা অনেকটা করতে পারবেন।
দুঃখজনক হলো এখনকার শিক্ষকদের মধ্যে সেই ভালো শিক্ষক হবার তাড়নাটাই নেই, ব্রত তো অনেক পরে। অবশ্য অন্যান্য পেশার মতো কেউ যদি আবার টাকার বিনিময়ে নিয়োগ পেয়ে থাকেন তাহলে খুব স্বাভাবিক কারনেই তিনি ভালো নাকি ক্লাসে অজনপ্রিয় সেসব নিয়ে তাঁর কিচ্ছু যায় আসবে না। তিনি তো চাকুরী করতে এসেছেন, শিক্ষকতা করতে নয়, নয়টা পাঁচটা অফিস করবেন, চাপার জোরে হাতি মারবেন ঘোড়া মারবেন। তাঁর কিসের দায় ঠেকেছে শ্রেণি কক্ষে ভালো পড়ানোর? আর যদি ভাগ্যক্রমে ইংরেজি, গণিত বা বিজ্ঞান বিষয়ের শিক্ষক হন তাহলে তো কথাই নেই। প্রাইভেট বা কোচিং বানিজ্য খুলে দিব্যি টাকা কামাতে কোন অসুবিধা নাই। আমি শুনেছি সরকারের নিষেধাজ্ঞা থাকায় নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট পড়ানো যায় না। শিক্ষকদের মাঝে নাকি কেউ কেউ ওনার কাছে প্রাইভেট না পড়লে বিদ্যালয়ের মূল পরীক্ষায় কম নাম্বার দেন বা ফেল করিয়ে দেন! এমন হতচ্ছাড়া শিক্ষকদের কবল থেকে শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে আইনটি করা। মজার ব্যাপার এটা শুধু কিতাবী আইন, কিভাবে মনিটরিং করবেন এই কাজটি কেউ করলে?
যেহেতু আপনি শিক্ষক, আপনাকে নৈতিকতার ব্যাপারে সর্বোচ্চ অবস্থানে থাকতে হবেই। সমাজের সব প্রতিষ্ঠান নীতিহীন আদর্শহীন হয়ে গেলেও শিক্ষককে নীতি আদর্শে অটল থাকতে হবে। না খেয়ে থাকলেও আপনি যদি নিজেকে শিক্ষক হিসেবে মানেন তো নীতির বিসর্জন দিতে পারবেন না। যদিও সে আশা দূরাশা যদি শিক্ষক হিসেবে সঠিক ব্যক্তিটিকে আমরা নিয়োগ না দিতে পারি। একজন মেধাহীন ঘুষের বিনিময়ে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষক কখনোই আপনাকে কাংখিত ফলাফল দিতে পারবেন না। এটা তাঁর দোষ নয়, দোষ সেই নিয়োগ কমিটির, যারা শিক্ষার মতো পবিত্র অংগনকে ব্যবসার ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। এমন হীন চরিত্রের ম্যানেজিং বা নিয়োগ কমিটি প্রায় শতভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে গ্রাস করে ফেলেছে। আপনি একা এদের বিরুদ্ধে লড়তে পারবেন না, কারন এসব অবৈধ আয়ের অংশীদার রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদ পদবীর মানুষগুলোও।
তাহলে? আমরা কোথায় যাবো? আমাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে দেয়ালও ভেদ করে পিছিয়ে গেছি। আমাদের রক্ত মাংস শিরা উপশিরা পর্যন্ত দুর্নীতির কালো রক্তে পচে গলে গেছে, আমাদের শূন্য থেকে শুরু করতে হবে। সেজন্য কিছু মেধাবী শিক্ষক নিয়োগ, উপযুক্ত বেতন কাঠামো, যুগোপযোগী প্রশিক্ষণ ও যথাযথ মনিটরিং নিশ্চিত করা ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই। কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধবে কে? আপনাকে আমাকেই বাঁধতে হবে, একত্রিত হতে হবে অন্যায় অনাচারের বিরুদ্ধে। অভিভাবকদের একাট্টা হয়ে ভালো শিক্ষকের দাবীতে চাপ তৈরি করতে হবে বিদ্যালয় প্রশাসনের উপর। যারা নিয়মিতই শিক্ষক হিসেবে অযোগ্যতার প্রমাণ দেবেন তাঁদের প্রতিষ্ঠান থেকে অব্যাহতি দিতে হবে। আগামী দিনের নাগরিকদের সুস্থ রাখতে হলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল ধরণের অসুস্থতা সারিয়ে তুলতে হবে প্রথমে।
চলবে ………………………………
পল্লব খন্দকার, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩
mazhabkh93@gmail.com