প্রথম পর্বঃ
অনুমান করা যায় বৃটিশ আমলেই ভারতীয় উপমহাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রচলন ঘটেছিলো। তার পূর্বে আমাদের ভূখণ্ডে শুধুমাত্র অবস্থাসম্পন্ন পরিবারের সন্তানেরা পন্ডিতশালায় অথবা বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণকারী গুরুদেবের সাহচর্যে জাগতিক বিভিন্ন শিক্ষা লাভ করতো। সে আমলে শিক্ষক বা গুরুদের বাবা-মায়ের চেয়েও অধিক সম্মান দেয়া হতো, যদিও অধিকাংশ পণ্ডিত বা শিক্ষাগুরু ছিলেন অতীব দরিদ্র। কিন্তু সম্মানের দিক থেকে সমাজের সর্বোচ্চ পর্যায়ের মানুষ যেমন রাজা-বাদশাদের সমতূল্য ছিলেন তাঁরা। একজন গুরুকে মান্য করার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ পরিশ্রম ও ত্যাগ শিকার করতেন সেসব আমলের শিষ্যরাও।
সৃষ্টিকর্তার পরে পিতা-মাতার স্থান হলেও সে আমলে অনেক শিষ্য গুরুকে সৃষ্টিকর্তার সমান মর্যাদায় শ্রদ্ধা ও সম্মান করতেন। কারন তখনকার দিনে শিক্ষাগুরু মানে শুধুমাত্র লেখাপড়া শেখানোর জন্যই নয়, তাঁরা শিষ্যকে জীবন পরিচালনার জন্য যাবতীয় দীক্ষা যেমন- আত্মরক্ষা ও রণকৌশল, শরীরচর্চা, ধর্মীয় শিক্ষা ও আদব কায়দা, রাজনীতি এমনকি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত বিভিন্ন কাজ হাতেকলমে শেখাতেন। সেই সকল জীবনমুখী শিক্ষাদানে গুরুদেবগণ পারিশ্রমিক হিসেবে খুবই নগণ্য পারিতোষিক গ্রহণ করতেন। অনেকেই শুধুমাত্র তিনবেলা খাওয়া আর বছরে এক দুটি পোষাকের বিনিময়ে ধনাঢ্য ব্যক্তিদের সন্তানদের শিক্ষাদান করতেন। আর পাঠশালার পণ্ডিতগণ দান হিসেবে কারো গাছের লাউ, কারো গাভীর দুধ অথবা কখনো এক দুই পয়সা মাসোহারা পেতেন। দূরদেশে অবস্থিত নিজের পরিবারের সদস্যদের জন্য সেই সামান্য দান দক্ষিণা থেকে থেকেই কষ্ট করে গুছিয়ে কখনো পাঠাতে পারতেন কখনোবা সেটাও সম্ভব হতো না। অর্থনৈতিকভাবে এমন দূর্দশাগ্রস্থ হওয়া স্বত্বেও শুধুমাত্র সমাজে সর্বোচ্চ সম্মানের পাত্র হিসেবে বিবেচিত হতেন পণ্ডিত বা গুরুদেবগণ।
শুধুই সম্মান নয়, তাদের শিষ্যবৃন্দ গুরুকে ভীষণ ভয়ও পেতেন। পণ্ডিত সাহেবের হাতে শুধুমাত্র একটা বেত থাকতো, সেটি কেউ কেউ ব্যবহার করতেন নির্মমভাবে কেউবা শুধুই হাতের কাছে রেখেই শাসন করতেন। সামান্য সেই বেতের ভয়েই পাঠশালা থেকে বহু শিক্ষার্থী পালিয়ে যেতো, জীবনে আর পাঠশালামুখো হতো না। এমনকি গুরুদেব রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে শিষ্যরা রাস্তা ছেড়ে পাশে সরে বা লুকিয়ে পড়তো, সহজে পণ্ডিত সাহেবের মুখোমুখি হবার সাহস কারো ছিলো না। আর কোন শিক্ষার্থীকে যতোই মেরে তক্তা বানিয়ে দেয়া হোক অভিভাবকগণ পণ্ডিতকে কিছুই বলতেন না; উল্টো তাঁকে ক্ষমতা দিয়ে বলতেন- গুরু, শুধুমাত্র চোখ দুটো বাঁচিয়ে রেখে আপনি আমার সন্তানটিকে মানুষ করতে যতো পারেন বেত্রাঘাত করতে দ্বিধা করবেন না।
ব্রিটিশ সরকার তাদের অফিস আদালত পরিচালনার সুবিধার কথা বিবেচনা করে কম বেতনে ইংরেজি শিক্ষিত কেরানি তৈরির উদ্দেশ্যে ১৭৮১ সালে লর্ড ওয়ারেন হেস্টিং কলকাতা মাদ্রাসা যা বর্তমানে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় চালু করেন। এরপর ১৭৯১ সালে জোনাথন ডানকান বারাণসীতে সংস্কৃত কলেজ এবং ১৮০০ সালে লর্ড ওয়েলেসলি কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। মজার বিষয় হলো ফোর্ট উইলিয়াম কলেজটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো ব্রিটিশ ইংরেজদের ভারতীয় উপমহাদেশের ভাষা ও সাংষ্কৃতি শেখাবার উদ্দেশ্যে। তাই আমরা বুঝতে পারছি ইতিহাসের লিপিবদ্ধ পরিসংখ্যান অনুযায়ী এই উপমহাদেশে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করে বৃটিশ সরকার। এই শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করার পিছনে উপমহাদেশের মানুষের শিক্ষার প্রসারের চেয়ে নিজেদের শাসন পোক্ত করার উদ্দেশ্যই ছিলো প্রধান। তবে উপমহাদেশের মানুষদের মধ্যে শিক্ষা বিষয়ক সচেতনতা বৃদ্ধি ও চাকুরিতে শিক্ষার গুরুত্ব বৃদ্ধি পাবার কারনে লর্ড রিপন ব্রিটিশ ভারত সরকারের শিক্ষানীতি পর্যালোচনার জন্য এক সদস্য বিশিষ্ট হান্টার কমিশন ১৮৮২-৮৩ গঠন করেন। এরই ধারাবাহিকতায় বৃটিশ ভারত শাসনামল থেকে শুরু করে অধুনা বিভক্ত ভারত, পাকিস্থান ও বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়ে শিক্ষার মানোন্নয়নের ধারা অব্যাহত রয়েছে।
১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ ভূখণ্ডে প্রথম আনুষ্ঠানিক বিশ্ববিদ্যালয় “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’’ এরপর ১৯৫৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। তবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভূক্ত হিসেবে বৃটিশ আমলে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় শিক্ষানুরাগী ব্যক্তি ও জমিদারদের উদ্যোগে বেশ কিছু কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। এসব কলেজের মধ্যে প্রচীনতম হিসেবে ১৮৪১ সালে ঢাকা কলেজ, ১৮৬১ সালে চট্টগ্রাম কলেজ, রাজশাহীতে রাজা রায় বাহাদুর ১৮৭৩ সালে রাজশাহী কলেজ, বরিশালে ১৮৮৯ সালে প্রখ্যাত সমাজসেবক, রাজনীতিবিদ ও শিক্ষানুরাগী অশ্বইনীকুমার দত্ত ব্রজমোহন কলেজ বা বি. এম কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। এভাবে ১৮৮৩ সালে ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজ, ১৮৯২ সালে সিলেটে মুরারী চাঁদ (এমসি) কলেজ, ১৮৯৮ সালে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ, ১৮৯৯ সালে কুমিল্লায় ভিক্টোরিয়া কলেজ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশের সীমানায়। সে হিসেবে আমার নিজ বিভাগ খুলনায় বেশ অনেকটা সময় পরেই ঐতিহ্যবাহী ব্রজলাল (বিএল) কলেজটি ১৯০২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। অন্যদিকে খুলনা বিভাগের নামকরা যশোরের মাইকেল মধুসূদন (এম.এম.) কলেজটি আরো পরে ১৯৪১ সালে যাত্রা শুরু করে।
আমাদের দেশে প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলো প্রতিষ্ঠিত হবার সাল দেখেই অনুমান করা যায় আনুষ্ঠানিক শিক্ষার দৌড়ে আমরা কতটা পিছিয়ে ছিলাম। কলকাতা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার ৬০ বছর পর ঢাকা কলেজটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই পিছিয়ে থাকার কারন হিসেবে ধরা হয় তৎকালীন মুসলমান সমাজে ইংরেজদের প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি প্রচন্ড অনীহা। মুসলিম সমাজের মানুষেরা মনে করতেন ইংরেজি শিখলে ইসলাম ধর্মের অবমাননা হবে বা ইসলামি মূল্যবোধ ক্ষতিগ্রস্থ হবে। যদিও পরবর্তীতে হিন্দু সম্প্রদায়ের শিক্ষানুরাগ ও শিক্ষার কারনে বৃটিশ সরকারে তাঁদের শক্ত অবস্থান দেখে সব ধরণের প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে মুসলিম নেতাদের টনক নড়ে। সেই হিসেবে আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলন ও শিক্ষা বিস্তারে হিন্দু জমিদার ও শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিদের অবদান অনস্বীকার্য।
আমি নিজে গ্রামের প্রাইমারী ও হাইস্কুলে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণ করেছিলাম। সেই ১৯৮০ সালের দিকেই স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পাশ করা শিক্ষিত মানুষদের অনেক কদর ছিলো। তাই আমারও স্বপ্ন ছিলো জীবনে অন্তত স্নাতকোত্তর পাশ করবোই, যদিও সেটি অনেক কঠিন মনে হতো সেই শৈশবের দিনগুলোতে। আমার গ্রামটি অজপাড়া গাঁ হলেও আমদের মাধ্যমিক স্কুলটি ১৯৫৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো এবং মাগুরা জেলার মধ্যে বেশ নামডাক ছিলো স্কুলটির। আমাদের আধুনিক আমলেও দেখেছি নারী শিক্ষা নিয়ে মানুষের নেতিবাচক মনোভাব, যদিও আমার পরিবারের চাচা-ফুফুরা সবাই ছিলেন স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পাশ। অথচ আমার বংশেরই অন্যান্য চাচা-ফুফুদের অভিভাবকগণ নিজের সন্তানদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করতে পাঠানোর তাগিদ বোধ করতেন না। গ্রামে যথেষ্ট জমিজমা ছিলো যে পরিবারগুলোর তারা সাধারণত শিক্ষার ব্যাপারে উদাসীন ছিলেন এবং নারী শিক্ষার ঘোর বিরোধীতা করতেও দেখেছি অনেক মুরব্বীদের। (চলবে)
পল্লব খন্দকার, ২৬ আগস্ট ২০২৩
mazhabkh93@gmail.com
[…] […]