আমরা একটু শিক্ষা গ্রহণের মৌলিক উদ্দেশ্যের তত্ত্বগত সংজ্ঞার প্রতি নজর দিই “শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনে নৈতিক, মানবিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, বিজ্ঞানভিত্তিক ও সামাজিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠাকল্পে শিক্ষার্থীদের মননে, কর্মে ও ব্যবহারিক জীবনে উদ্দীপনা সৃষ্টি করা।” এমন পরিচ্ছন্ন উদ্দেশ্যের পুরোপুরি বিপরীতেই অবস্থান করছে আমাদের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা, এখন শিক্ষার একমাত্র উদ্দেশ্য আকর্ষনীয় কর্মসংস্থান ও উন্নত জীবন যাপন।
ছোটবেলায় অভিভাবকদের কাছ থেকে আমাদের উপর বর্ষিত সবচেয়ে জনপ্রিয় উপদেশ বাণী ছিলো “লেখাপড়া করে যে, গাড়ী ঘোড়া চড়ে সে।” এই প্রবাদ বাক্যটি পৃথিবীর অন্য কোথাও অনুবাদিত হয়েছে কি না আমার জানা নেই। তবে বাক্যটি আমাদের কিন্তু শিক্ষা গ্রহণে উৎসাহিত করেছিলো শৈশবের কঠিন লেখাপড়ার সাথে সখ্যতা গড়তে। এরকমভাবে জাগতিক সম্পদহীন অনেক দরিদ্র পরিবারগুলোর মেধাবী সন্তানেরা এই প্রবাদ বাক্যটিকে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে জীবনকে পুরোটাই বদলে দিতে পেরেছে। আমরা চোখের সামনে উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্ণর ডক্টর আতিউর রহমানকে দেখি কিভাবে রাখাল বালক থেকে তিনি আনুষ্ঠানিক শিক্ষার কঠিন ধাপগুলো পেরিয়ে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হয়ে উঠেছেন। মনীষীদেরও অসংখ্য উক্তি আছে শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব নিয়ে। যেমন দার্শনিক এরিস্টটলের একটি বিখ্যাত উক্তি হলো – “শিক্ষার শেকড়ের স্বাদ তেঁতো হলেও এর ফল মিষ্টি।” আমরা জানি পবিত্র কুরআনের প্রথম বাণীটি পড়া সংক্রান্ত- “পড় তোমার প্রভূর নামে, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন।”
আমরা যারা অজপাড়া গাঁয়ে জন্ম নিয়েছি ও শৈশব পার করেছি তারা বিভিন্ন সুবিধার বিবেচনায় শহরে জন্ম নেয়া ও নামদামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করা শিক্ষার্থীদের চেয়ে বহুগুন পিছিয়ে থেকেছি। আমরা ভালো মানের স্কুল, শিক্ষক, লাইব্রেরী, অভিভাবক, গাইড কিছুই বলতে গেলে পাইনি। নির্ধারিত সিলেবাস অনুযায়ী গৎবাঁধা মুখস্ত করেই প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে সুবিধাপ্রাপ্তদের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলতে পেরেছি। আমাদের জ্ঞানের বহর বইয়ের পাতায় আবদ্ধ থেকেছে শহরের কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের আগ পর্যন্ত। শহরের কলেজে পড়তে গিয়ে বুঝতে পেরেছি কি অন্ধকারেই আটকে আছে গ্রামে আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তথা শিক্ষার সাথে যুক্ত সকল প্রকার অবকাঠামো এবং জনবল। যদিও আমি ভাগ্যবান যে কোচিং যুগের রমরমা সময়ের আগেই মাধ্যমিক স্তর পার করতে পেরেছি, আমদের সময় শুধুমাত্র দূর্বল বিষয়গুলোর উন্নয়নের জন্য প্রাইভেট শিক্ষকের কাছে পড়তে হতো। আজকালকার মত নির্দিষ্ট শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট বা কোচিং না করলে পরীক্ষায় নাম্বার পাবার ক্ষেত্রে কোন অসুবিধা পোহাতে হতো না।
যুগের চাহিদা মেটাতে বর্তমানে শিক্ষার্থীদের চেয়ে তাদের অভিভাবকদের অতিমাত্রায় সচেতনতা একজন শিক্ষার্থীর শৈশবের দিনগুলো কারাবাসের মত হয়ে গেছে। ছেলেবেলা থেকেই ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিসিএস পাশ করে সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে গড়ে তোলার জন্য তীব্র প্রতিযোগিতার দুনিয়ায় এসে হাবুডুবু খায় অনেক শিক্ষার্থী। অথচ আমাদের সময়ে অনেক অভিভাবক শুধুই ফাইনাল পরীক্ষার ফলাফল দেখে সন্তানদের বিচার করতেন, ভালো করার জন্য নির্দেশনা দিতেন। পরীক্ষায় প্রথম বা দ্বিতীয় হওয়া নিয়ে তাদের অতোটা মাথা ব্যথা ছিলো না, পাশ করলেই খুশি আর নিজের সন্তান পরীক্ষায় প্রথম বা দ্বিতীয় হতে পারলে গর্বিত অনুভব করতেন তাঁরা। কম গাইডেন্স পাওয়া সেইসব শিক্ষার্থীরাই কিন্তু পরবর্তীতে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা বিসিএস কর্মকর্তা হয়েছেন, প্রতিনিয়ত তাদের তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াতে হয়নি লেখাপড়া করানোর জন্য। কারন প্রত্যেক শিশুরই মানসিক গড়ন ও তাড়নার নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য রয়েছে; তাদের মেধা, মনন ও বিকাশের ভিন্নতা থাকা খুবই স্বাভাবিক। প্রাকৃতিক এই বৈচিত্রের ব্যাপারটি ভুলে গিয়ে আমরা এখন শিশুদের উপর মানসিক নির্যাতন করছি শিক্ষাকে পণ্য হিসবে গণ্য করে।
শিক্ষাকে পণ্য থেকে মানুষের মানবিক বিকাশের হাতিয়ার হিসেবে গণ্য করার আর কোন উপায় কি আদৌ আছে আমাদের কাছে? সাদা চোখে নেই, কারন সেরা বিদ্যালয়ে ভর্তি যুদ্ধ শেষে হাফ ছেঁড়ে বাঁচার মানসিকতা থেকে বের হওয়া মোটেই সহজ কাজ নয়। সন্তানের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে কে না চাইবে? আমাদের যৌথ পরিবারগুলো ভেঙ্গে একক পরিবারগুলোর স্বার্থপর মনোভাবের কারনেও এই অনিয়ন্ত্রিত প্রতিযোগিতা থেকে বের হওয়া যাচ্ছে না। আমরা যদি একটু সার্বিকভাবে সার্বজনীন মানবিক উন্নয়নের জন্য ভাবতে শিখতে পারি তাহলেই সম্ভব এই অযাচিত প্রতিযোগিতা থেকে বের হয়ে শিক্ষার্থীদের চাপমুক্ত স্বাধীন জীবনের স্বাদ ফিরিয়ে দেয়া। মানুষের স্বাধীন চিন্তার সুযোগ ছাড়া মননশীলতা, মানবিকতা আর সৃষ্টিশীলতা কোনভাবেই গড়ে ওঠা সম্ভব নয়। সমাজ থেকে যদি মানবিক ভাবনাগুলোই উবে যায় তাহলে সবথেকে ক্ষতিগ্রস্থ হবে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের সন্তানেরাই। তীব্র প্রতিযোগিতায় অন্ধ হয়ে একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা হারিয়ে পরষ্পরকে শত্রু হিসবে গণ্য করে লিপ্ত হবে চরম অনৈতিক দ্বন্দে। প্রত্যেকে নিজে টিকে থাকার লড়াইয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীকে পঙ্গু করে দেবার ঘৃণ্য মানসিকতা সম্পন্ন হয়ে উঠবে।
আমরা যদি জায়গীর শিক্ষকের যুগের দিকে তাকাই তখনকার সমাজ ব্যবস্থায় মানবিকতার বিষয়টি খুবই জোরালো ছিলো। নিজের সন্তানের পাশাপাশি আর একজন দরিদ্র পরিবারের সন্তানের লেখাপড়া চালিয়ে যেতে সহযোগিতা করা। লজিং মাস্টার একদিন তাঁরই লেখাপড়া শেখানো শিক্ষার্থীর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হবেন জেনেও সেটা চালিয়ে যেতেন নিজের প্রতিষ্ঠা পাবার উপায় হিসেবে। অন্যদিকে যিনি লজিং মাস্টারকে নিজ বাড়িতে থাকার মহত্ত্ব দেখাতেন তিনিও জানতেন লেখাপড়া শিখে এই মেধাবী মানুষটি জীবিনে প্রতিষ্ঠিত হবেন একদিন। হয়তো ঘটনাক্রমে হবেন তাঁরই প্রতিদ্বন্দ্বী, সেটা জেনেও এই যে সুযোগ প্রদানের সাংষ্কৃতি খুবই অনুপ্রেরণাদায়ক ছিলো তখনকার দিনে। অথচ আমরা জানি একজন লজিং মাস্টার শুধু তিনিবেলা খেতে পাওয়া ও মাথা গোঁজার একটা ঠাই পেতে নিজের পরিবার পরিজন ছেঁড়ে দূর এলাকায় গিয়ে ভিন্ন পরিবেশে নতুন একটা পরিবারের সাথে মানিয়ে নিয়ে অন্যের সন্তানের লেখাপড়ার দায়িত্ব নিতেন। এই পারষ্পারিক ত্যাগের মানবিক জায়গাটা ফিরিয়ে এনে একই সাথে বেড়ে ওঠা বা গড়ে ওঠার সমাজ ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার লড়াইয়ে নিজেদের নিয়োজিত করতেই হবে। সুস্থ প্রতিযোগিতা ফিরিয়ে আনার মাধ্যমে সহনশীল ও মানবিক শিক্ষার জন্য সমাজপতি ও শিক্ষাবিদদের অবশ্যই এক কাতারে দাঁড়াতে হবে।
চলবে…………..
পল্লব খন্দকার, ৩০ আগস্ট ২০২৩
mazhabkh93@gmail.com
প্রথম পর্বের লিংকঃ
Leave a Reply