শিশু ও শ্রম এই শব্দদ্বয় বিপরীত অর্থকে বহন করে। 'শিশু' শব্দটি কোমলতার চিত্র আমাদের মননে সৃষ্টি করে আবার 'শ্রম' শব্দটি সৃষ্টি করে কঠিন কোন চিত্র। এই শব্দদ্বয় এমন এক চিত্র চিন্তায় সৃষ্টি করে যা ফুটিয়ে তোলে কোমল কারো দ্বারা কঠিন কোন কিছু সম্পন্ন হচ্ছে এমন বাস্তবতা।
বাংলাদেশের শিশু আইন অনুযায়ী অনুর্ধ্ব ১৮ বছরের সকল ব্যক্তিকেই শিশু হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে ৫-১৪ বছর বয়সের কাউকে জোরপূর্বক কাজে নিযুক্ত করে শ্রম আদায় করে নেওয়ায় 'শিশুশ্রম'।
বাংলাদেশে শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে আইন থাকা সত্ত্বেও এই চিত্র সাধারণ হয়ে উঠেছে। দিনের পর দিন এই চিত্র বাড়ছে আমাদের চারপাশে। কলকারখানা, ইটভাটা, রেস্টুরেন্ট, দোকান এমনকি বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুদের নূন্যতম এক মজুরি নির্ধারণ করে তাদের দিয়ে শ্রম আদায় করে নেওয়া হয় তবে যথাসময়ে শ্রম প্রদানে ব্যর্থ হলে ভোগ করতে হয় শাস্তি। এমন বাস্তবতার পেছনে রয়েছে আর্থ-সামাজিক কারণ। 'দারিদ্র্য' তার মধ্যে অন্যতম। দারিদ্র্যের কষাঘাতে বাধ্য হয়েই 'শ্রমকে' প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার আগে বেছে নিতে হয়। এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয় বাংলাদেশে নিম্নবিত্ত পরিবারে জন্ম নেওয়া শিশুদের।
নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলে সন্তানকে জন্মের পরপরই চিন্তা করা হয় আয়ের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে। বয়স ৮-৯ বছর হলেই স্কুল থেকে গন্তব্য হয়ে পড়ে কোন কর্মক্ষেত্র। ফলে তারা বঞ্চিত হয় মৌলিক অধিকার 'শিক্ষা' থেকে। শুধু ছেলে নয় মেয়েরাও জীবন ও জীবিকার তাগিদে অল্প বয়সেই কঠিন কাজের দিকে যেতে বাধ্য হচ্ছে।
ফলে তারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে তো ঝরে পড়েই পাশাপাশি অর্থের জোগান দিয়ে হাল ধরতে হয় পরিবারের। ছোট বয়সেই সম্মুখীন হতে হয় চরম বাস্তবতার। যে সময়ে কোমলমতি শিশুদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে জ্ঞান আহরণের কথা সে সময়ে এক কঠিন বাস্তবতাকে নিজের সঙ্গী করে নিতে হয়।
'শিক্ষা' মানুষের অন্যতম মৌলিক অধিকার। তবে 'দারিদ্র্য' সরাসরি মৌলিক অধিকারের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দারিদ্রতার কষাঘাতে অনেক শিশু তার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। বর্তমান সময়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়ার সাথে সাথে দাম বেড়েছে শিক্ষা সামগ্রীর। নিম্নবিত্ত পরিবারের কোন শিশু কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হলে যে শিক্ষা সামগ্রীর প্রয়োজন তা মেটাতেও ব্যর্থ হয় পরিবার।
শিক্ষা ব্যক্তিকে নৈতিক ও সচেতন হিসেবে গড়ে তোলে, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর যত কাজ রয়েছে তা সম্পর্কে সতর্ক করে। ফ্রান্সের বিখ্যাত লেখক ভিক্টর হুগো বলেছিলেন, ''যে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করলো সে জেলখানার একটি দরজা বন্ধ করে দিল।'' শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একজন শিক্ষার্থীকে নৈতিকতার পাঠ দেওয়া হয়। তাঁর এই নৈতিকতা সমাজের অনৈতিক ও অবৈধ কাজের ব্যাপারে তাকে সচেতন করে তোলে। ফলে সে সহজেই তা থেকে দূরে থাকে এবং গড়ে উঠে সচেতন নাগরিক হিসেবে। অপরাধ থেকে সৃষ্টি হয় দূরত্ব। যে অপরাধ থেকে দূরে থাকে সে জেলখানা থেকে দূরে থাকে। এভাবেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জেলখানা থেকে দূরে রাখে।
প্রবাদ প্রচলিত রয়েছে, ''আজকের শিশুই আগামী দিনের ভবিষৎ''। বাংলাদেশের শিশুদের একটা বৃহৎ অংশ যখন প্রাথমিক শিক্ষা থেকে ছিটকে পড়ে তখন তা দেশের উন্নত ভবিষ্যৎ সৃষ্টির পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। কেননা ঝড়ে পরা শিক্ষার্থীরাই পরবর্তীতে একটি প্রজন্ম হিসেবে গড়ে উঠবে যাদের অধিকাংশের অক্ষর জ্ঞান থাকবে না, থাকবে না নৈতিক মূল্যবোধ ফলে তাদের মধ্যে যতটা না মানবিকতা সৃষ্টি হবে তার চেয়ে বেশি সৃষ্টি হবে নীতি-নৈতিকতা ও শিক্ষা ছাড়া একটি প্রজন্ম।
একজন শিশু তার জীবনের শুরুতেই প্রাথমিক পাঠ গ্রহণ না করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বঞ্চিত হওয়া মানে একটি গাছ বীজ থেকে সুপ্ত হয়ে ফোটার আগেই নিঃশেষ হয়ে যাওয়া। যে বীজ গাছ হয়ে ফুটে উঠতে পারে না, সে ছায়া, অক্সিজেন কিছুই প্রদান করতে পারে না। একইভাবে যারা প্রাথমিক শিক্ষাও গ্রহণ না করে ঝরে পড়ে তারা পরবর্তীতে গড়ে উঠতে পারে না। বরং ঝরে পড়ার পর থেকে কর্মক্ষেত্রে পরিচয় হয় নানা জাতের মানুষের সাথে। মানসিকভাবে তারা তাদের অনুকরণ করে। কখনো কখনো তারা বিভিন্ন মাদকদ্রব্যে আসক্ত হয়ে যায়, জড়িয়ে পড়ে কিশোর অপরাধে।
শিশুশ্রম থেকে বাঁচিয়ে শিশুদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা। প্রয়োজন তাদের ভিতরে লুকিয়ে থাকা সম্ভাবনা গুলোকে প্রস্ফুটিত করার অনুপ্রেরণা দিবে এমন ব্যক্তির। স্কুলের শিক্ষকরা সবচেয়ে বড় অবদান রাখতে পারে এই জায়গায়। শিক্ষকদের আন্তরিকতা ও বিভিন্ন ফিঃ মওকুফ করার মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের স্কুলমুখী করা সম্ভব। আমাদের শিশুরা স্কুলমুখী হলে যথাযথ নৈতিক শিক্ষা পেলে ধীরে ধীরে মানবসম্পদ বাড়বে, কমবে শিশুশ্রম। শিশুদের পরিকল্পিত উপায়ে গড়ে তুললে একটি রাষ্ট্র পাবে উন্নত নাগরিক, আর উন্নত নাগরিকরাই দেশের বড় সম্পদ হিসেবে গড়ে উঠবে।
লেখা: রুদ্র ইকবাল, লেখক ও সাংবাদিক, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।
সূত্র: যায়যায়দিন, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩।