আজ যে শিশু পৃথিবীর আলোয় এসেছে…আমরা তার তরে একটি সাজানো বাগান চাই…।’ মা-বাবার ঘরটা হয়তো শিশুর জন্য সাজানো বাগানই। কিন্তু এই পৃথিবীটাকে কি আমরা করতে পেরেছি তার জন্য সাজানো বাগানের মতো? অথবা সুকান্তের সেই বাসযোগ্য পৃথিবী? হয়তো পেরে উঠি না আমরা; কিন্তু শিশুটিকে আমরা যদি বড় করে তুলি আপন মমতায়, সঠিক বিকাশে, তাহলে সে হয়তো তার পৃথিবীটাকে তার মতো করেই বাসযোগ্য করে তুলবে। মনের মতো সাজাবে আপন পৃথিবীর বাগানটাকে।
শিশুর যত্ন বলতে আমরা সাধারণত শিশুর শারীরিক যত্নকেই বুঝে থাকি। বাচ্চা ঠিকমত খাচ্ছে কিনা, ঘুমাচ্ছে কিনা, বয়সের স্বাভাবিক বিকাশ হচ্ছে কিনা তা নিয়ে যেন চিন্তার শেষ নেই অভিভাবকদের। সে তুলনায় শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে তেমন একটা মনোযোগ দেওয়া হয় না। কিন্তু শিশুর শারীরিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতিও যত্নবান হওয়া এবং সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।
মনোবিদরা বলেন, শিশুর মনোজগৎ এবং বড়দের জগতের মধ্যে একটা বিপরীতমুখী চিন্তার প্রাচীর থাকে। এই প্রাচীর ভাঙার কাজ শিশুর নয়, বড়দেরই। বড়দের কাছে যে বিষয় ‘অমূলক’ বা ‘কাল্পনিক’ বলে মনে হয়, কোনো শিশুর কাছে সেটিই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বলে মনে হতে পারে। একই ভাবে বড়রা শিশুর যে অনিচ্ছা বা ভয়কে ‘অমূলক’ বা ‘হালকা’ বলে ভাবেন তা হয়তো শিশুর কাছে ভীতিকর হতে পারে। তাই ছোট্ট শিশুর কোনো ইচ্ছা, ভীতি অথবা আগ্রহকে যথাসম্ভব গুরুত্ব দিতে হবে।
#নিজের ইচ্ছা শিশুর ওপর চাপিয়ে না দেওয়া
এই সমস্যাটা মূলত আমাদের মায়েদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। আমরা আমাদের অপূর্ণ ইচ্ছেগুলোকে ওদের মাধ্যমে পূরণ করার চেষ্টা করি। আর এতে করে বাচ্চাগুলো চাপে চাপে জর্জরিত হয়ে যায়। আমরা অভিভাবকেরা কি কখনো বাচ্চাকে ডেকে বলি তার মনের কি ইচ্ছা? সে কি চায়? শিশুদের সম্পর্কে প্রচলিত ধারণাগুলোর একটা হচ্ছে শিশুরা খালি কলসির মতো। যাকে শিক্ষাদীক্ষায়, জ্ঞানে ও বুদ্ধিতে ‘পূর্ণ’ করে তোলার দায়িত্ব বড়দের উপর অর্পিত। যে কারণে শিশুর মাঝে নিজেদের ইচ্ছাকে চাপিয়ে দেয়ার প্রবণতা অভিভাবকদের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু মনে রাখতে হবে শিশুদের মানসিক বিকাশ শুরু হয়ে যায় খুব ছোটবেলা থেকেই। শিশুর স্বাভাবিক মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে পারিবারিক ও সামাজিক অবস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। নিজেদের আবেগ, চাওয়া পাওয়া কোনোভাবেই তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। তারা যেমন সেভাবেই বিকশিত হতে দিতে হবে তাদের।
#অধিক সময় কাটানো :-
আজকালকার বাবা মায়েদের চাকরিসূত্রে দিনের অনেকটা সময় কর্মস্থলে কাটাতে হয়। ফলে শিশুরা বাবা মায়ের সঠিক সান্নিধ্য পেয়ে ওঠে না। অনেকেই আবার সারাদিনের কর্মব্যস্ততার ফলে ক্লান্তিবোধ করে, কারো কারো মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়, সেই মেজাজ গিয়ে পরে শিশুদের ওপর, ফলে শিশুরা আরো বেশি আঘাতপ্রাপ্ত হয়, একাকীত্ব বোধ করে। তার শিশু মনে জেগে ওঠা হাজারো রকম প্রশ্ন তার মনে চাপা পড়ে যায়। ধীরে ধীরে তার মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটতে থাকে। তাই যতই ব্যস্ততা থাকুক না কেন শিশুদের সাথে একটা কোয়ালিটি টাইম কাটানো উচিত বাবা মায়েদের। পরিবারেরও উচিত তাদের মনের কথা খুলে বলা।
#ভুল থেকে শিখতে দিতে হবে
শিশুদের ভুল করতে দিতে হবে। সবসময় তাকে সংশোধনের দিকে যাবেন না। আচ্ছা আমরা বড়রা যা করি তার সবটুকুই কি ঠিক করি? আর সেখানে ওরা তো বাচ্চা। ওরা ভুল করবে এটাই স্বাভাবিক। শিশুরা যদি ভুল না করে তবে ভবিষ্যতে তারা জীবন, সময়, টাকা ও কঠোর পরিশ্রমের গুরুত্ব বুঝতে সক্ষম হবে না। ভুলের মাধ্যমে তারা বুঝতে শিখবে কোন কাজ করা উচিত, কোনটি উচিত নয়। তাদের নিজের কাজ ও দায়িত্বের ভার নিজের কাঁধে নিতে শিক্ষা দিতে হবে। এতে তাদের শুরুতে কিছুটা সমস্যা হলেও তারা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেককিছু বুঝতে শিখবে। আর এই শেখাটাই হবে প্রকৃত শেখা হবে। আমাদের এই মানসিকতা তৈরি করতে হবে যে ওরা বাচ্চা ওরা ভুল করতে করতেই শিখবে। পাশ্চাত্য সংষ্কৃতিতে আঠারো বছরে পড়তেই একজনকে নিজের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে হয়। সেকারনে বাবা মায়েরা শিশুদের ছোটবেলা থেকেই স্বাবলম্বী করে গড়ে উঠতে তাদের নিজের মত করে বেড়ে উঠতে সহায়তা করেন।
# শিশুর ইচ্ছার মূল্যায়ন করতে হবে
কোনো কিছু শেখার পেছনে প্রত্যেক শিশুর সহজাত প্রবৃত্তি ও প্রবল আগ্রহ কাজ করে। সেই আগ্রহের প্রতি কোনোরকম অনাগ্রহ দেখানো যাবে না। আপনার বাচ্চার যেটা ভালো লাগে সেটা করতে দিন তাকে। হ্যাঁ সে হয়তো প্রথমে ভুল করবে, করুক কিন্তু এটাতে সে যে মানসিক শান্তিটা পাবে তা অনেক দামি। আপনার শিশুটি যদি বলে, সে আঁকতে চায় তাকে আঁকতে দেন। আপনি পড়াতে চাইছেন বলে তার এখন পড়তে বসতেই হবে এমন কোনো কথা নেই। তার ইচ্ছা ও স্বাধীনতা মূল্যায়ন করলে শিশুর মন ভালো থাকবে। মানসিক বিকাশ সুস্থ ও স্বাভাবিক হবে।
#খোলামেলা আলোচনা :-
মনে রাখা প্রয়োজন যে মন খুলে আলোচনা করলে মনের গভীরে কোনো ক্ষত জমা থাকে না। একজন মানুষের অনেক অভাব অভিযোগ না পাওয়ার বেদনা থাকতে পারে। পরিবারের প্রতিটি সদস্য যদি নিজের খোলামেলা কথা বলে তবে তার প্রভাব শিশুর ওপর পড়তে বাধ্য। এর ফলে শিশুও তার স্কুলের বন্ধুদের বা শিক্ষক শিক্ষিকাদের বা আত্মীয় পরিজন অথবা বন্ধু বান্ধব সম্পর্কে তার মনোভাব খোলাখুলি বলবে – যার ফলে তার ভেতরে কোনো লুকোনো আবেগ বা ক্ষত তৈরি হবে না। আর বাচ্চা যদি খোলামেলা আলোচনা করে তার মধ্যে অপরাধ প্রবনতা কমে আসবে। এককথায় বাচ্চাদের বন্ধু হয়ে উঠতে হবে আমাদের।
# তুলনা না করা
আমাদের সবচেয়ে বড়ো সমস্যা আমরা সবার সাথে সবার তুলনা করি। কিন্তু আমাদের বোঝা উচিত প্রতিটি মানুষ যেমন আলাদা, শিশুর বেলায়ও তাই। সব শিশুকে একই ছাঁচে ফেলে তার সঙ্গে অন্য শিশুর তুলনা করা যাবে না। কারণ এতে করে ছোট থেকেই তার ভেতর হীনমন্যতা আর হিংস্রতা জন্ম নেবে। তাকে যেমন ভালো কাজের জন্য উৎসাহিত করতে হবে, তেমনি দুষ্টুমি করলেও অতিরিক্ত শাসন করা যাবে না। মনে রাখতে হবে, দুষ্টুমি, চঞ্চলতা শিশুর সুস্থ বিকাশেরই অন্যতম বৈশিষ্ট্য। করুক না হয় একটু দুষ্টুমি! ওদের জন্যই তো আমাদের আমরা পরিপূর্ণ।
#শিশুর সঠিক মানসিক বিকাশে পরিবারের ভূমিকা
কথায় বলে শিশুর প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হল তার পরিবার। কাজেই একজন শিশুর শারীরিক, মানসিক, সামাজিক প্রভৃতি বিকাশগুলি ঘটতে শুরু করে পরিবারের মধ্যেই। বর্তমান ডিজিটাল যুগে একটি গবেষণায় উঠে এসেছে মানুষের মানসিক সমস্যা সংক্রামক ব্যাধির মতো ক্রমবর্ধমান। তাই যদি শিশুকে ছোটবেলা থেকেই পূর্ণ মানসিকতার সুষম বিকাশ ঘটানো যায় তবে ভবিষ্যৎ জীবনে শিশু নানারকম মানসিক সমস্যার মোকাবিলা করে একজন সুস্থ সবল সামাজিক মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে। আর এই মানসিক দিকগুলো গড়ে উঠতে পারে একমাত্র পরিবারের মধ্যেকার পরিবেশে।
বর্তমান যুগে সোশ্যাল মিডিয়া, যন্ত্র নির্ভরতা ও পারস্পরিক সুসম্পর্কের অভাব প্রভৃতির ফলে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক ভাবের আদান প্রদান কমে যাচ্ছে। যার প্রভাব সুকোমল শিশুদের মনে পড়ে। ফলে শিশুরা নানাভাবেই বিকৃত মানসিকতার শিকার হয় এবং মোবাইল গেম, ভিডিও গেমে আসক্তি, অসামাজিক ভাবনা, নেশার প্রতি আসক্তি ইত্যাদির কবলে পড়ে যায়। এসব অনেক সময় বাইরের থেকে শিশুকে দেখে বোঝা যায় না। কিংবা বোঝা গেলেও অনেকেই বিশেষ আমল দেন না। কিন্তু মনে রাখা প্রয়োজন পুষ্টিকর খাবার যেমন শরীরকে সুস্থ রাখে তেমনি উপযুক্ত পারিবারিক পরিবেশ -ই শিশুর মানসিক গঠনকে সুন্দর করে তোলে। তাই শিশুর মানসিক বিকাশের দিকটি গুরুত্ব দেওয়া খুব প্রয়োজন দেখা দিয়েছে আজ।
#বয়ঃসন্ধিকালে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি
বয়ঃসন্ধিকাল ছেলেমেয়েদের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক সময়। এ সময় তারা মা বাবার চেয়ে বন্ধু বান্ধবের প্রতি বেশি নির্ভরশীল হয়। তাই মা-বাবা ছেলেমেয়ের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করতে হবে। তাদেরকে ভালো ও মন্দের দিক নির্দেশনা দিতে হবে। সতর্ক করতে হবে যাতে তারা বন্ধু নির্বাচনে সতর্ক ও সচেতন হয়। বাবা মায়ের প্রতি যাতে তারা আস্থাশীল হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
এই বিষয়গুলো ছাড়াও আরও কয়েকটি বিষয়ে নজর রাখা প্রয়োজন – ব্যর্থ হলে কখনো শাস্তি দেওয়া কিংবা বকাবকি করা অনুচিত। আর মনে রাখা প্রয়োজন পরিবারের সদস্যদের মধ্যে যে বন্ধন তাও শিশুর মনকে প্রভাবিত করে। তাই নিজেদের মধ্যে ঝগড়া হতে পারে কিন্তু এমন কথা কাউকে বলা উচিত নয় – যা শিশুরা শিখে গেলে তার ক্ষতি হতে পারে। মা বাবার বন্ধুত্বপূর্ণ ও মধুর সম্পর্ক শিশু মনে পরম সুখ ও নিরাপত্তাবোধ জাগায়।
আসুন আমরা আমাদের বাচ্চাদের ওপর আমাদের অপূর্নতা গুলো চাপিয়ে না দিয়ে ওদেরকে ওদের মতো করে বড়ো হতে দেই। ওদের হাসিতে ঝলমল করে উঠুক আমাদের পৃথিবী। ওদের আমরা অংকুরেই অযত্নে না বলে বলি অতিযত্নে বিনষ্ট না করে ফেলি। আমরা বাবা মায়েরা ওদের সবচেয়ে নিরাপত্তার জায়গা। সে জায়গাটা থেকে আমরা সুন্দর করে ওদের পাশে থেকে ওদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে সাহায্য করি। এই নিরাপত্তার অভাব বোধ থেকেই শিশুদের মনে আপনার অজান্তেই চরম হতাশা জন্মাতে পারে, ফলশ্রুতিতে আমরা ইদানীং উদ্বেগজনক হারে কিছু দূর্ঘটনা দেখতে পাই। শিশুদের সঠিক মানসিক যত্নের অভাবে এবং পরিবারের আপন মানুষের কাছ থেকে অবহেলা বা কটুক্তির শিকার হয়ে অনিয়ন্ত্রিত ক্ষোভ বা অভিমানে নিজেকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতেও দ্বিধা করে না। আমরা কেউই এমন চরম দূর্ঘটনার শিকার হতে চাই না, শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের সঠিক যত্ন নিন। এই অনুরোধ পৃথিবীর সকল অভিভাবকদের কাছে। ভালো থাকুক সব সন্তানেরা।
বনানী ঘোষ, খুলনা থেকে।
Leave a Reply