ছেলেবেলায় যা মুখে দিতাম তাই যেন ছিলো অমৃতের মতো স্বাদের। গ্রামে শৈশব কেটেছে তাই গ্রামের নিজেদের খামারে বা আঙিনায় উৎপাদন করা ধান, গম, দুধ, আম, জাম, লিচু, কলা, কাঠাল সবই খেয়েছি প্রাণভরে। সেগুলোতে না ছিলো ক্ষতিকারক রাসায়নিক বা বিষাক্ত উপাদান না ছিলো দাম দিয়ে কেনার প্রয়োজন। ইচ্ছে মতো খাওয়ার স্বাধীনতা ছিলো, নিজেদের জমিতে উৎপাদিত গমের আটা থেকে তৈরি করা রুটি তাই আট দশটা খেয়ে ফেলতাম রুটি তৈরি করার সময় গরম গরম। নিজেদের উৎপাদিত সকল খাঁটি জিনিসের স্বাদে আর পুষ্টিতে আমাদের শৈশব ছিলো সত্যিকারার্থে দুধে ভাতে।
বছর বছর ঝাঁক বেঁধে মৌমাছি উড়ে এসে জুড়ে বসত গ্রামের বাড়ির কোন একটা গাছে অথবা পশ্চিম ঘরের টিনের ঢাপের সাথে। আমি অবাক হতাম মৌমাছিদের এই অতিথি হয়ে আসা দেখে, খবর নেই বার্তা নেই একটা ঝাঁক এসে বসলো জামরুল গাছে অথবা গোয়ালের পাশের আমগাছে অথবা টিনের চালে ঘরের এক কোনে। কিছুদিনের মধ্যেই চাক বড় হতে থাকে, একসময় বোঝা যায় চাকে মধু জমেছে, গ্রামের চাক ভাঙ্গা এক্সপার্ট কাউকে খবর দিয়ে আনা হতো, সে নাকি আবার মন্ত্র জানে, মন্ত্র পড়ে চাক কাটলে আর মৌমাছি নাকি কামড়াবে না! যাই হোক চাক স্পেশালিষ্ট এসে প্রথমে খড় দিয়ে একটা বোচকার মত বানাতো, এরপর তাতে আগুন ধরিয়ে ধোঁয়া তৈরি করত চাকের নিচে গিয়ে। আমরা দূর থেকেই দেখতাম কি সুন্দর মৌমাছিগুলো সরে যাচ্ছে চাক ছেড়ে আর দিব্যি চাক কেটে এলুমিনিয়ামের হাড়িতে মধু সহ রাখা হচ্ছে।
একটু পরে মৌমাছিগুলো আবার চাকে বসে পড়েছে! সবই বড় চমকের বিষয়, একটাও কামড় না খেয়ে মধু সংগ্রহের অভিযান আমাকে বিস্মিতই করতো! সদ্য ভাঙ্গা চাকের গরম মধু যারা না খেয়েছেন মধুর আসল স্বাদ তারা জীবনেও বুঝতে পারবেন না। এখনো আমি মধু খেয়ে বলে দিতে পারি কতটা ভেজাল আর কতটা আসল। মৌচাকের কারনে মাঝে মাঝে ঝামেলাও হতো, রাতের বেলায় হারিকেনের আলোতে চলে আসতো দুই একটা মৌমাছি, কিছু বলতাম না, সুযোগ বুঝে ডলা দিয়ে মেরে ফেলতাম। সেই কর্ম করতে গিয়ে অসাবধানতাবসত মাঝে মাঝে হুল ফোটানোর যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে, চুন লাগিয়ে সে যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবার চেষ্টা করতাম। আবার অন্য ঘটনাও ঘটতো, রাতের বেলায় কে বা কাহারা চুরি করে চাক কেটে নিয়ে পালাতো। সকালে উঠে দেখতাম গাছতলায় পোড়া খড় পড়ে আছে, মাঝে মাঝে চাক কিছু আছে আর কখনো এমনভাবে কাটতো যে সব মাছি উড়ে চলে যেতো, শুধু মধুহীন মোম পড়ে থাকতো, তখন চোরদের মনে মনে গালিগালাজ করা ছাড়া কোন গতি ছিলো না। চাক উড়ে গেলে মন খারাপ হয়ে যেতো।
ছেলেবেলার আর একটি জিভেতে জল আসা খাবার পাকা তেতুলের সাথে কাঁচা মরিচ, লেবু পাতা আর লবন মিশিয়ে মাখানো ভর্তা। সেই মহা টক তেঁতুল ভর্তা মুঠো ভরে ভরে খেতাম আমি। আমাদের উত্তর ঘরের পিছনে একটা তেঁতুল গাছ ছিলো, আমার মনে আছে এই গাছটা একটা আজীব তেঁতুল গাছ, কিছু তেঁতুল এতো মিষ্টি যে তেঁতুল বলেই মনে হতো না, আবার কিছু তেঁতুল সেইরকম টক! তেঁতুল একটু বতি হওয়ার পর থেকেই আমার দৈনিক রুটিনের অংশ ছিলো গাছে উঠে তেঁতুল খাওয়া, সে কাঁচা হোক আর বেলে মানে আধা পাকা হোক। একবার স্কুল ছুটি চলছে এমন এক সকালে নাস্তা না করেই তেঁতুল গাছে উঠে বসলাম, তখন সবে মাত্র তেঁতুল পাকা শুরু হয়েছে। আমি মনের আনন্দে পাকা-অর্ধপাকা তেঁতুল গো-গ্রাসে খাচ্ছি গাছে চড়ে। হঠাৎ করে পেটের মধ্যে কেমন করে উঠলো, গাছ থেকে নামলাম, নেমেই হড়হড় করে বমি হয়ে গেলো, তেঁতুল যা গিলেছিলাম সব বের হয়ে আসলো। আসলে সকালে এমনি পেট এসিডে ভরপুর থাকে, আর আমি বেকুবের মত আরো এসিড খেয়ে পেট ভরে ফেলেছিলাম, শরীর তো আর যন্ত্র না, ঠিকই ব্যালেন্স করে দিলো আমাকে বমি করিয়ে। সেদিন থেকে কান ধরলাম আর সকালে উঠে খালি পেটে তেঁতুল খেতে যাবো না।
আমি বিশিষ্ট কাঁঠাল খাদক ছিলাম, এই খ্যাতি আমার আত্মীয় স্বজনদের মাঝে প্রচলিত ছিলো তাই বিভিন্ন আত্মীয় বাড়ি হতে আমাকে কাঁঠাল খাবার জন্য বিশেষভাবে দাওয়াত দেয়া হত! মাঝারি সাইজের কাঁঠাল আমি একাই সাবাড় করে দিতে পারতাম, রস খাজা হলে সবচেয়ে ভালো করে খাওয়া যেতো। তবে কাউকেই নিরাশ করতাম না, সব ধরনের কাঁঠাল সাবাড় করে তবেই বাড়ি ফিরতাম।
ছোটবেলার আর একটা মজার খাবার ছিলো যবের ছাতু, আহ ঝোলা গুড় আর নারিকেল কোরা দিয়ে মাখানো ছাতু খেয়ে কি যে তৃপ্তি লাগতো, পেটে থাকতোও অনেক সময়, আমি অনেকদিন সকালে শুধু যবের ছাতু খেয়েই স্কুলে গিয়েছি, মাঝে মাঝে আবার ঝাল লবন দিয়েও মাখিয়ে খাওয়া হতো ছাতু, আজকাল চোখেই দেখিনা কোথাও যবের ছাতু, আমাদের কিছু জমিতে গমের পাশাপাশি যব লাগানো হতো। আজকাল আর কোথাও দেখিনা যবের চাষ করতে, বড্ড দুঃখ পাই।
আরো কিছু মজার খাবারের তালিকায় ছিলো শুকনো বরই ঢেঁকিতে গুড়ো করে চালন দিয়ে চেলে সেই গুড়ো ঝোলা গুড়ের সাথে মাখিয়ে রোদে শুকানো হত। কেনো জানি এই খাবারটা আমার কাছে অমৃত স্বাদের লাগতো, একেকবার মুঠো ভরে নিতাম আর চেটে চেটে চোখ বুজে খেতাম। মাঝে মাঝে দুধ-ভাতের সাথে খাওয়া হতো, দুধ জমে গিয়ে একটা দইয়ের স্বাদ পেতাম যেনো বরই এর এই স্পেশাল আচার খেতে গিয়ে। আরো ছিলো আম সত্ব দিয়ে দুধভাত খাওয়ার মজা, শুধু আম স্বত্ব ঘরের গোপন জায়গা থেকে চুরি করে ভাইবোনদের সাথে ভাগাভাগি করে খাওয়ার স্মৃতিও মনে পড়ে।
নদী, খাল বা বিলের টাটকা জ্যান্ত মাছ, বাড়িতে পালন করা দেশি মুরগি বা হাঁসের ডিম ও মাংসের স্বাদ এখনো যেন মুখে লেগে আছে। নিজেদের বাড়ির পাশের আঙিনায় লাগানো সব ধরনের সব্জি, লাউ কুমড়ো পেপে পুই শাক, আবার শীতকালে পালং শাক, ফুলকপি, পাতা কপি, মূলা, সীম সব ছিল বড্ড তাজা। যেনোতেনোভাবে রান্না করলেও গাছ থেকে তুলে আনা সব্জির স্বাদের সাথে কোন কিছুরই তুলনা করা সম্ভব নয়।
গ্রামে নিজেদের গাভী ছিলো, নিয়মিত দুধ পেতাম, দাদী সেই দুধের সর জমিয়ে ঘি বানাতেন, সেই ঘি দিয়ে সকালে গরম ভাতের সাথে শুধুমাত্র কাঁচা মরিচ আর লবন মিশিয়ে খাওয়ার কি যে মজা ছিলো সে কথা আজ আর লিখে বোঝানো সম্ভব নয়, খাটি গাওয়া ঘি আর গরম ভাতের অসাধারণ সে রসায়ন!
পল্লব খন্দকার, ২১ অক্টোবর ২০২৩
mazhabkh93@gmail.com