ও পালনহারে...
মেনুকা পোডেল। নেপালে জন্ম পঁচিশ বছর বয়সের তরুনী। এই নারীটির প্রসংগে পরে আসছি। আমার এই লেখার প্রধান বিষয় আমার গান প্রীতি। মুল বিষয়ে যাওয়ার আগে গান নিয়ে ছোট্ট একটা ভূমিকা সেরে নিই। ভূমিকা ছাড়া কিছু লিখতে পারিনা। ভূমিকা ছাড়া সরাসরি বিষয়টা নিয়ে লিখলে মনে হয়, লেখাটার মাথার উপর কোনো ছাদ দিই নি।
গান আমার প্রান। তাই মাঝে মাঝে গান নিয়ে অনুসন্ধান করি। বিভিন্নভাবে দেখেছি গানের সাথে কোথায় যেন বিভিন্ন ধর্মের যোগসুত্র আছে। সঙ্গীতের উৎস সন্ধানে ইতিহাসবিদ, সঙ্গীতশাস্ত্রবিদ, দার্শনিক, গবেষক, শিক্ষাবিদেরা যুগ যুগ ধরে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু এর উৎপত্তি সংক্রান্ত সর্বজনীন গ্রহণযোগ্য কোন মতবাদ তারা অদ্যাবধি দেয়া সম্ভব হয়নি। তাই সঙ্গীতের উৎপত্তির বিষয়টি আজও মূলত লৌকিক উপাখ্যান ও ধর্মীয় কল্প-কাহিনীর সঙ্গে সম্পৃক্ত, যা যুগের পর যুগ মানুষ বিশ্বাস করে আসছে।
সৃষ্টিকর্তাই কি গানের স্রষ্টা! জানিনে। বাইবেলে অনেক জায়গাতেই গানের কথা বলা হয়েছে। “আনন্দে প্রভুর উপাসনা কর; আনন্দের গান নিয়ে তার সামনে এসো (Pslam ১০০:২)”। আবার ইহুদীদের ধর্ম গ্রন্থে বলা হয়েছে, “তারপর মূসা ও ইস্রায়েলের সন্তানেরা এই গানটি আদোনাইয়ের উদ্দেশ্যে গাইলেন এবং বললেন, আমি সদা প্রভুর উদ্দেশে গান গাইব, কারণ ঈশ্বর অত্যন্ত মহিমান্বিত (Exodus ১৫:১-২) । ইহুদীদের ধর্মীয় শাস্ত্রে ৪০০ বারের অধিক গান শব্দটি এসেছে। হিন্দু ধর্মে ভজনের গুরুত্ব সকলেরই জানা। মুসলমানদের কাছেও সুরেলা আওয়াজ পছন্দনীয়। বিশ্বের ৯০টি দেশে ৪৭৬ মিলিয়নেরও বেশি আদিবাসী বাস করে। অধিকাংশ আদিবাসী কিংবা মোটামুটি প্রত্যেকেই সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসী এবং সৃষ্টিকর্তার কাছে নিজেদের সমর্পন করার প্রধান মাধ্যম গান আর নাচ।
থাক। ধর্ম নিয়ে আলাপ আলোচনা বিশ্লেষনে আমি সব সময়ই শঙ্কিত বোধ করি। তার বড় কারন আমাদের চারিত্রিক অসহিষ্ণুতা। সেই অসহিষ্ণুতার বহিঃপ্রকাশ অপপ্রচার। আর অপপ্রচারের শিকার হতে চাই না। তাছাড়া ধর্ম সম্পর্কে আমার জ্ঞান, গ্রামের হাতুরে ডাক্তারদের চিকিৎসা সম্পর্কীয় জ্ঞানের স্তরের অনেক নীচে। তবে আমি গান পাগল মানুষ।
শৈশবে মাঝে মাঝে আমার মায়ের গলার গান শুনতাম। গান শোনার অভ্যাস সেই শৈশব থেকেই। দিনে একটাবার গান শুনবো না, তা কল্পনাতেও আসেনা। আমি যখন গান শুনি তখন পছন্দের অনেক গানের কথাগুলি আমার চোখের সামনে ডিজিটাল ছবি হয়ে ভেসে বেড়ায়, ভিজুয়ালাইজ করতে পারি। গান গেয়ে যে মনের কষ্ট দুর করা যায় তা আমি ছোট বেলাতে অনেক বার দেখেছি। বাবাহীন আমাদের মানুষ করতে যেয়ে আমার মায়ের কখনও সুখের সময় ছিল না। সন্ধ্যার পর হারিকেন জ্বেলে পড়তে বসতাম, আমরা ভাইবোনেরা। পাশের ঘর থেকে আমার মায়ের মৃদু, নরম চিকন গলার গান ভেসে আসতো। কত যে গান! মাঝে মাঝে পা টিপে টিপে মায়ের মাথার কাছে যেয়ে দেখতাম। মা গান গাইছেন, চোখ বন্ধ করে, মায়ের দুচোখের কোণায় পানির বিন্দু।
মেনুকা পোডেল এবারের ইন্ডিয়ার টেলিভিশন রিয়েলিটি শো ইন্ডিয়ান আইডল সিজন ১৪ এর একজন প্রতিযোগিনী। আমি ইন্ডিয়ান আইডল অনুষ্ঠানটি দেখিনি, সনি টিভির কর্মকর্তারা ইন্ডিয়ান আইডলের নতুন সিজন ১৪ এর একটি প্রোমো ভিডিও প্রকাশ করেছেন, ফেসবুকের কল্যানে কিভাবে যেন মেয়েটির অডিশনের ভিডিও ক্লিপটি নজরে আসে।
মেনুকা মঞ্চে উঠে গাইলো, “ও পালনহারে, নির্গুন আজারে, তুমরে বিন হামারা কৌনো নেহি” । প্রয়াত কিংবদন্তি লতা মুঙ্গেশকরের গাওয়া এই গানটি মুলত একটা ভজন যার গীতিকার আর সুরকার সঙ্গীতের দুজন জীবিত কিংবদন্তি, জাভেদ আখ্তার আর সুরকার এ আর রহমান।
মেনুকার গান শুনে অনুষ্ঠানের তিন বিচারক শ্রেয়া ঘোষাল, ভিশাল দাদলানি, কুমার সানু, কেউই তাদের চোখের পানি আটকে রাখতে পারেননি।
বিশাল দাদলানির ভাষায়, “মেনুকা হাম লোগ যে চিজ কো পুছতে হ্যায় না, আজ উসকো হাম ছামনে দেখা”।
মেনুকার সংগীত যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০১৮ সালে যখন সে নেপালি রিয়েলিটি শো, "নেপাল আইডল"-এর মাধ্যমে। তার অসাধারণ প্রতিভা এবং চিত্তাকর্ষক কণ্ঠস্বর দ্রুত তাকে নেপালে পরিচিতি এনে দেয়। তার অসাধারণ যাত্রা সেখানে থামেনি। সে তার দেশের সীমানা পেরিয়ে ভারতে চলে আসে। মেনুকা ভারতীয় টিভি গানের রিয়েলিটি শো, "সা রে গা মা পা"-তে অংশ নেয়। নেপাল থেকে ভারতে এই স্থানান্তরটি তার ক্যারিয়ারে একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক ছিল।
মেয়েটি চার বছর বয়সে একটি হোস্টেলে পড়াশোনা শুরু করে এবং হোস্টেলে থাকার সময় সে তবলা, হারমোনিয়াম এবং অন্যান্য বাদ্যযন্ত্রের আওয়াজ শুনতে পান। হোস্টেলের সিনিয়র এবং শিক্ষকদের প্রভাবে সে খুব অল্প বয়সেই গানের জগতে আকৃষ্ট হন। নেপালে একটি টেলিভিশন সাক্ষাত্কারে, মেনুকা শেয়ার করেছিল, "ছোটবেলা থেকেই আমার দিন-রাত কেটেছে গানের সাথে"। মেনুকা তার মাধ্যমিক স্তরের জন্য স্থানীয় মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে এবং কাঠমুন্ডূর সিরজানা কলেজ অফ ফাইন আর্টসে উচ্চ শিক্ষা সম্পন্ন করে। পরে, তিনি ভারতের মুম্বাইয়ের SNDT মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন।
মেনুকার গানটা গাওয়া দেখে, শুনে এই প্রথম আমার উপলব্ধি শরীরের কোষে কোষে ছড়িয়ে গেল, গান দিয়ে সৃষ্টিকর্তাকে ডাকা যায়। সৃষ্টিকর্তার কাছাকাছি যাওয়া যায়। বিশিষ্ট পরিচালক মহেশভাট অশ্রু ভারাক্রান্ত স্বরে মেনুকার উদ্দেশ্যে বলেছে, “যে চাঁদ তুমি আজ দেখালে মা, সে চাঁদ আগে কখনও দেখা যায়নি”।
আমার মায়ের মতো আমি হারিকেনের আলো স্তিমিত করে, মৃদু গলায় করুন সুরে গান করি না। আমি গান পারি না। ছোট মেয়েটি বিয়ে হয়ে চলে যাওয়ার পর নির্জন বাসার এককোণে কোনো এক সোফার এক কোনায় শরীর সংকুচিত করে শুয়ে বুকের কাছে মোবাইল ফোনে মেনুকার গানটা শুনি। “--- ইয়ে জীভান তুম হি না সাওয়ারেগেতো কিয়া কোই সোয়ারে…… ।“ দুচোখের কোণায় না। আমার চোখ ভরে পানি চলে আসে। জানিনে কেন!
রহস্যবাদী “ওশো” বলেছিলেন যে, “অন্ধকার দেখতেও চোখ দরকার কারণ অন্ধকারও চোখের একটি অভিজ্ঞতা” । মেনুকা পোডেল, এই জন্মান্ধ মেয়েটি তার আত্মার বিশুদ্ধতা দিয়ে, বিশুদ্ধ ভক্তির মাধ্যমে তার সত্তায় এত আলো পাওয়ার ক্ষমতা তৈরি করেছে। সেই আলোতে মেয়েটি অনেক কিছুই দেখতে পায়। আমরা আমাদের দৃষ্টি দিয়েও কিছুই দেখতে পারলাম না। জানিনে আর কবে পাবো।
অভিনন্দন, সেই সাথে প্রার্থনা মেনুকা, তোমার জন্যে।
লেখা সংগ্রহ: জনাব সাদিকুল আওয়াল এর ফেসবুক ওয়াল (https://web.facebook.com/sadiq.awal.39)
সংকলন: দৈনিক আলোকবর্তিকা।
https://youtu.be/h_KURKvBRGs