পৃথিবীর মানচিত্রে আমরা খুব ছোট একটা দেশ। অবশ্য আমাদের চেয়েও অনেক ছোট ছোট দেশ পৃথিবীতে আছে। জাতিসংঘ স্বীকৃত ১৯৫ টি দেশের মধ্যে আয়তনে আমরা চুরানব্বইতম তবে জনসংখ্যার দিক দিয়ে আছি অষ্টম অবস্থানে! নেই কোন উল্লেখযোগ্য খনিজ সম্পদ, আছে ৭০০ টি নদ-নদী, একটি উপসাগর আর অল্প বিস্তর পাহাড়। আছে সোনা ফলা মাটি, প্রতি বছর বছর বন্যায় নদী বয়ে নিয়ে যায় পলি, তাই ফসলের সম্ভারে আমরা খেয়ে-পরে বেঁচে থাকি। ওয়ার্ল্ডোমিটার এর তথ্য অনুযায়ী আমরা ১২৬৫ জন মানুষ প্রতি বর্গ কিলোমিটার এলাকায় বাস করি! এক্ষেত্রে পৃথিবীর মধ্যে আমরা ১০ বা ১১ তম অবস্থানে ওঠানামা করছি। আমরা ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জন করেছি এবং পঞ্চাশটি বছর পার করে এখনো দৌড়ে চলেছি উন্নয়নের পিছনে পিছনে।
অবশ্য এটা মানতেই হবে বছর বছর প্রাকৃতিক দূর্যোগ আর বছর বছর দূর্নীতির চ্যাম্পিয়ন আমরা যে টিকে আছি উন্নয়নের দৌড় প্রতিযোগিতায় তা আল্লাহর অশেষ রহমত এবং প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে! ঢাকার যানজট, সাম্প্রতিক অতীতে ফেরিঘাটের দূর্ভোগ, প্রতিনিয়ত বিভিন্ন দূর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল আর বাংলাদেশীদের সকল অনিয়মে অভ্যস্থতা দেখে অনেক সময়ই এ বিশ্বাস দৃড় হয় যে এ দেশ আল্লাহ চালান! আমার ৫০+ বয়সে এসে এই উপলব্ধির পাশাপাশি এদেশের গ্রামের অল্পতে তুষ্ট সহজ সরল মানুষ, অনেক মেধাবী শিল্প উদ্যোক্তা আর কৃষিখাতে নিয়োজিত জনবলের যৌথ প্রয়াসে ধীরে ধীরে হলেও এগিয়ে চলেছে দেশ। এছাড়া ইদানীংকালে প্রবাসী শ্রমিকরা ঘাম ঝরিয়ে সচল রেখেছে বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা। অন্যথায় রন্ধ্রে রন্ধ্রে দূর্নীতি কবলিত একটি দেশ কিভাবে চলতে পারে তা আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে কুলায় না! লোম বাছতে কম্বল উজাড় প্রবচনটি আমাদের জন্য যথার্থ, দূর্নীতিপ্রবন মানসিকতা নেই এমন কাউকে আর খুঁজেই পাই না। নিজে ঘুষ খাওয়ার সুযোগ পাই না, কিন্তু সরকারী দপ্তরে সুবিধা পাবার জন্য অনায়েশেই চা-নাস্তা-মিষ্টি খাওয়ার টাকা দিয়ে থাকি! এখন যে কি অবলীলায় এরকম স্পীড মানি লেনদেন হয় তা নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন! ওপেন সিক্রেট, টাকার গায়ে তো আর লেখা থাকে না উৎসের নাম, বেসরকারি কোম্পানীর নামী-দামী কর্মকর্তারাও ব্যবসা পাইয়ে দেবার শর্তে বিদেশ ট্যুর, পারসেন্টেজ নিয়ে পকেট ভারী করেন অনায়াসে।
সততার সংজ্ঞা বদলে গেছে আমাদের দেশে। দূর্নীতির মাধ্যমে কাড়িকাড়ি টাকা আয় করতে হবে, মসজিদে গিয়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে হবে, অকাতরে দানধ্যান করতে হবে, পানির মত মিথ্যা বলতে বাধবে না, এলাকার মানুষকে ডেকে ডেকে ঘুষের রাস্তা দেখিয়ে চাকুরীর ব্যবস্থা করে দিতে হবে। কেউ টু শব্দটি করবে না আপনার টাকার উৎস নিয়ে, বরং অত্যন্ত সমীহ করবে, আপনার মহাভাবুনতা নিয়ে উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় মেতে উঠবে! আর যে বেচারা দূর্নীতি করেন না, সত্য কথা বলেন কিন্তু উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা তিনি ভীষণ আনস্মার্ট, এ যুগে নাকি চলেন না? কিরে বাবা, মাল নিবি, কাম সেরে দিবি, এই না হলে সৎ ও দক্ষ কর্মকর্তা? এরশাদ সাহেবের উপজেলা পরিষদ সৃষ্টি যেমন উন্নয়নকে মানুষের দোর গোড়ায় পৌঁছে দিয়েছে পাশাপাশি দেশের শতভাগ গ্রামে গড়ে তুলেছে দূর্নীতিপ্রবন সমাজ ব্যবস্থা! দেশের কোন প্রতিষ্ঠান আজ দূর্নীতিমুক্ত নয়, আমার ভাবতে অবাক লাগে ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশে দূর্নীতি নাকি প্রধানতম ব্যাধি? মিথ্যা বলা নাকি এখন মহাপাপ নয় মহা আর্ট?
তাই অবাক বা হতাশ হয়ে সময় নষ্ট করে লাভ নেই, স্রোতের সাথে মিশে যাওয়ার প্রবনতায় আমরা এখন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন! এই চরমতম অবনমনের শেষ কোথায় আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে, কিন্তু কদিনই বা বেঁচে থাকবো? আর আমি মরে গেলে সব গোল্লায় গেলেই বা কি যায় আসে? অবশ্য দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে নাকি আর পেছানো যায় না, তখন নাকি মৃত্যু ভয়কে জয় করে মানুষ সামনের দিকে আগায়, আমি নাহয় স্বপ্ন দেখি সেদিনের। একদিন এদেশে সততা ও মেধার জয়জয়াকার হবে, মিথ্যাকে মানুষ ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করবে, দূর্নীতিবাজদের গায়ে প্রতিবাদী জনতা থুঃথুঃ ছিটাবে! সবাই ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে যা কিছু সুন্দর ও চির কল্যাণকর তাঁরই পূজা করবে, সততাকেই সর্বশ্রেষ্ট পন্থা হিসেবে গ্রহণ করবে।
পল্লব খন্দকার
২১ জুন ২০২৩।