আমার কর্মজীবনের প্রায় সাতটি বছর দুইটি সরকারি প্রকল্পে প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা হিসেবে চাকুরি করার সুযোগ পেয়েছি। প্রথমটি একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানে বিজ্ঞানী হিসেবে আর দ্বিতীয়টি উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তা হিসেবে। আমার কর্মজীবনের শুরুতেই পরপর দুটি সরকারি চাকুরিতে বহাল থাকার কারনে সবসময়ই একজন উর্ধবতন কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে কাজ করতে হয়েছে। প্রকল্পের চাকুরি হবার কারনে বয়সে এবং একই বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজের ডিপার্টমেন্টের জুনিয়রকে নিজ দপ্তরের বস হিসেবে যেমন পেয়েছি তেমনই আমার থেকে ১৫-২০ বছরের সিনিয়রকেও বস হিসেবে পেয়েছি। এমনকি আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুকেও দাপ্তরিক বস হিসেবে পেয়ে তাঁর নির্দেশনায় সরকারি কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে এসেছি। ফলে আমাকে বিভিন্ন পর্যায়ে প্রয়োজনে বা অপ্রয়োজনে ভারসাম্য রক্ষা করে সবাইকে খুশি রেখে চাকুরি বহাল রাখার কৌশল প্রয়োগ করতে হতো। আমার কর্মজীবন পরবর্তিতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক এনজিও এবং সর্বশেষ ব্যবসার সাথে যুক্ত হবার কারনে ভারসাম্য রক্ষার কলাকৌশল কোথায় কেমন তা দেখার বিরল সৌভাগ্য হয়েছে।
আমার এই বহুবিধ চাকুরির সেক্টরে পদচারনায় এ দেশের শীর্ষ প্রশাসনে কর্মরত মন্ত্রী, সচিব, অধ্যাপক, মহাপরিচালক, লেঃ কর্ণেল, ডিআইজি ইত্যাদি পদমর্যাদার মানুষদের সাথে সাক্ষাৎ করার বা কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি যাদের সাথে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি তাঁদের অনেকেই প্রচন্ড মেধাবী, চৌকস এবং জনসেবায় আত্মনিয়োগকৃত ছিলেন। এঁদের মাঝেই কিছু ব্যতিক্রমও চোখে পড়েছে, কারো কারো মাঝে দেখেছি মেধার ঘাটতি, সততার অভাব, নিজের পকেট সেবায় মনযোগী হিসেবে। আমরা এমন দেখতেই অভ্যস্থ, সরকারি চাকুরেদের মধ্যে ভালমন্দ মিলিয়েই সবরকমের মানুষ থাকবেন। আমি অধিকাংশ ক্ষেত্রে একটা জিনিস খুব সাধারণ (Common) দেখেছি তাহলো সরকারি দপ্তরে সহজে কেউ বসের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেন না। সামনাসামনি কোন অপ্রাসঙ্গিক অথবা প্রাসঙ্গিক কথা উপস্থাপন করে বসের বিরাগভাজন সহজে কেউ হতে চান না। উর্ধবতন কর্মকর্তা মহা দুর্নীতিবাজ হোন অথবা বদমেজাজি হোন অধস্থন কর্মকর্তাগণ বসের এসব দোষের বিষয়ে মুখোমুখি কোন আলোচনা বা সমালোচনা করেন না। অধিকাংশক্ষেত্রে দেখা যায় দপ্তরে দুইটি বলয় তৈরি হয়ে গেছে, একটা বসের চামচা দল অপরটি বসের পিছনে সমালোচক দল। এই দুইটি দলের বাইরে আর একটি দলেও দুএকজন থাকেন, তাঁরা নিরপেক্ষ বা নীরব দল।
যুগে যুগে আমাদের দেশের সব সেক্টরের সরকারি দাপ্তরিক কার্যক্রম সমূহ এভাবেই বাস্তবায়িত হচ্ছে। যাকে বলে Boss is always right, এই আপ্ত বাক্যটিকে আপনি প্রশাসনিক শৃঙ্খলা হিসেবেও দেখতে পারেন। কারন আমাদের দেশে আবার সবাই নেতা হবার আশা করেন, বস একবার ছাড় দিলে দাপ্তরিক শৃঙ্খলা বিনষ্ট হবার পাশাপাশি কাজের গতিও কমে যাবার সম্ভাবনা থাকে। বসদের মানতে হয় আরো একটি কারনে তাহলো নিজের চাকুরির পদন্নোতি বা সিনিয়রিটি ও বেতন বৃদ্ধির জন্য বসের মূল্যায়নসহ সুপারিশ একান্তভাবে প্রয়োজন। বস আপনার উপর খুশি না থাকলে আপনি যত ভালো কাজ করেন না কেনো তা মূল্যহীন। আমি জানি না পৃথিবীর সব দেশেই কর্মী মূল্যায়নের একমাত্র পদ্ধতি কি এই বসের সুপারিশ নির্ভর? নাকি আছে কোন বিকল্প পদ্ধতি? বস নির্ভর পদ্ধতি কি সবসময় সঠিক মূল্যায়ন নিশ্চিত করতে সক্ষম? সব উর্ধবতন কর্মকর্তা কি তাঁর অধীনস্ত কর্মীদের মূল্যায়নে নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে বা পক্ষপাতিত্ব এড়ানোর যোগ্যতা রাখেন? আমার কেনো জানি মনে হয় এই বস নির্ভর মূল্যায়ন পদ্ধতির কারনে আমাদের দেশে অসংখ্য যোগ্য সরকারি কর্মী বা কর্মকর্তা বৈষম্যের স্বীকার হন, নিজেদের স্বকীয়তা হারান এবং একসময় দেশের প্রেক্ষাপটে অযোগ্য দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।
আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি এদেশের সকল সেক্টরের চাকুরিক্ষেত্রে কাগজে কলমে পেশাদারিত্ব কথাটি বহুল প্রচলিত শব্দ হলেও নির্মোহভাবে বিচার করতে পারার মত মানুষের এদেশে বড্ড অভাব। আমি চাকুরি জীবনের প্রথম দিকে একটি প্রকল্পের পরিচালক মহোদয়ের সাথে সুযোগ পেয়ে গিয়েছিলাম সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়য়ের মন্ত্রী মহোদয়ের বাড়ির এলাকায় তাঁর সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে। মন্ত্রী মহোদয় যেনতেন ব্যক্তি ছিলেন না, এদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে নাম লেখানো প্রথম সারির একজন ছাত্রনেতা ছিলেন তিনি। প্রকল্প পরিচালক মহোদয়ের চরম অপমান আমিসহ আরো জুনিয়র সহকর্মীগণ দেখেছিলাম সেই সৌজন্য সাক্ষাৎকারে উপস্থিত হয়ে। মন্ত্রী মহোদয়ের ব্যক্তিগত মৎস্য প্রকল্পের গাড়িতে (গাড়িটিও প্রকল্প থেকে সরবরাহ করা হয়েছিলো) নিয়মিত (অবশ্যই অবৈধভাবে) জ্বালানি তেল কেনো সরবরাহ করা হয়নি এই কৈফিয়ত চেয়ে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করা হলো। আমাদের প্রকল্প প্রধান নিজের গদি রক্ষায় চুপচাপ সেই গালিগালাজ শুনে অনেকটা হাসিমুখে জী বস, আপনিই মা-বাপ টাইপের আনুগত্য প্রদর্শণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। আমরা জুনিয়র সহকর্মীরা এখান থেকে কি শিক্ষা পেয়েছিলাম চাকুরি জীবনের শুরুতেই?
তাই সহজেই অনুমিত এদেশে আগা থেকে গোড়া পর্যন্ত জী বস সংষ্কৃতি খুবই প্রবল। স্বাধীনচেতা, আত্মমর্যাদাসম্পন্ন কারো পক্ষে সরকারি চাকুরি চালিয়ে যাওয়া বেশ কঠিন। চোখের সামনে অন্যায় জেনেও মুখ বুজে সহ্য করার ক্ষমতা থাকলে ভালো, আপনি টিকে গেলেন, আপনিও ভবিষ্যতে অন্যায় করার জন্য দক্ষতা অর্জন করলেন। এমনতর বস নির্ভর মূল্যায়ন চক্রের ফাঁদে আটকে গেছে এদেশের সরকারি চাকুরির অধিকাংশ দপ্তর বা সেক্টর। সার্বিকভাবে যা বেসরকারি চাকুরির জগতকেও আক্রান্ত করেছে, ফলে আমি অনেক স্বাধীনচেতা মানুষকে বিসিএস এর মতো সোনার হরিণ চাকুরি ছেড়ে ব্যবসা বা এনজিওতে যুক্ত হতে দেখেছি। এদেশে যারা জী হুজুর করেন না, বা অন্যায়ের প্রতিবাদ করেন তাঁরা বেয়াদব হিসেবে পরিচিতি পান। বস নির্ভর মূল্যায়নে তাঁরা অদক্ষ কর্মকর্তার তকমা পান, পদে পদে হয়রানির স্বীকার হন এবং একসময় হতাশ হয়ে তল্পিবাহক কর্মকর্তায় পরিণত হতে বাধ্য হন। যারা বেশী মাত্রায় স্বাধীনচেতা, আত্মবিশ্বাসী তাঁরা চাকুরি ত্যাগ করেন অথবা পাড়ি জমান বিদেশে। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমানোর আগে শেষ ক্লাসে এসেছিলেন, আমরা প্রশ্ন করেছিলাম এমন সোনার চাকুরি ছেড়ে কেনো বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন স্যার? তিনি বেশ অভিমান নিয়ে বলেছিলেন- “এদেশের অধিকাংশ মানুষই হিপোক্রেট”। তখন আমি হিপোক্রেট অর্থ অতটা বুঝতাম না, এখন তা হাড়ে হাড়ে টের পাই।
পল্লব খন্দকার, ২৯ জুলাই ২০২৩
mazhabkh93@gmail.com