https://www.moralparenting.org/
নওশাবা ফারিহা
শিক্ষার্থী, লোকপ্রশাসন বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।
“আপনি যদি দরিদ্র হয়ে জন্ম নেন সেটা আপনার দোষ নয় কিন্তু দরিদ্র থেকেই যদি মৃত্যু হয় তবে সেটা আপনার দোষ”। উক্তিটি বর্তমান বিশ্বের সর্বোচ্চ ধনীদের একজন বিল গেটস এর। এই অসামান্য উদ্দীপনামূলক উক্তিটি আমার জীবনকে কিভাবে বদলে দিয়েছিলো আজ সেই সত্য গল্পগুলো আপনাদের জানাবো।
আমার জন্ম একটি দারিদ্র পীড়িত এলাকা হিসেবে খ্যাত লালমনিরহাট জেলার কালিগঞ্জ উপজেলায়। সে হিসেবে আমাদের পরিবারটিকে নিম্ন মধ্যবিত্ত হিসেবে ধরা যায়, কারন আমাদের নিজেদের ভিটা বাড়ি আছে। যদিও আমার পিতার আয়ের উৎস্য ছিলো অন্যের জমি চাষ করা এবং ইদানীং কৃষিকাজে ফসল উৎপাদন করে যথেষ্ট পরিমাণ আয় করা সম্ভবপর হয় না। সেই হিসেবে পরিবারে আর্থিক টানাটানি নিত্যদিনের ব্যাপার, অনেকটা নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। একারনেই আমার শৈশবকাল আর দশটি সচ্ছল পরিবারের সন্তানের মতো ছিলো না, এর অন্যতম কারন শুধুমাত্র অন্যের জমিতে কৃষিকাজ করে সংসারের খরচ নির্বাহ করতে গিয়ে আমার পিতা ঋণের ভারে জর্জরিত হয়ে পড়েন এবং এলাকা ত্যাগ করেন। তাই পিতার স্নেহ ও অভিভাবকত্ব থেকে আমি বঞ্চিত হই এবং আরো দূর্ভাগ্যজনক ঘটনা আমার ও পরিবারের জীবনে ঘটে যায় তিনি যখন নিরুদ্দেশ হয়ে যান!
এরকম অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে পড়ে আমার মা একা সংসার সামলাতে গিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েন। একদিকে আমার পিতার কোন খোঁজ পাই না, কোথায় আছেন, কি করছেন, তিনি কি বিপদে পড়েছেন নাকি ইচ্ছাকৃতভাবে আমাদের পরিত্যাগ করেছেন? এই দুঃসহ মানসিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে আমাকে পার হতে হয়েছে দীর্ঘদিন, পিতার শূণ্যতা বোধের ভিতর দিয়ে চরম অসহায়ত্বের মধ্যে পড়ে যাই আমি ও আমার পরিবার। নিয়মিত কোন আয়ের উৎস্য ছাড়া একজন গ্রামীণ নারীর পক্ষে পরিবারের ভার সামলানো কতোটা কঠিন তা ভুক্তভোগী ছাড়া কারো পক্ষে অনুমান করা সম্ভব নয়। এই অসম্ভব ব্যাপারটিকে পরম ধৈর্য্য, চরম পরিশ্রম আর কঠিন ত্যাগ-তিতিক্ষার মাধ্যমে সামাল দেয়ার চেষ্টা করেন আমার মমতাময়ী মা। তাঁর একমাত্র লক্ষ্য ছিলো জীবনে যদি বেঁচে থাকেন তাহলে আমাদের সবাইকে মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তুলবেন।
ছোটবেলা থেকেই আমি লেখাপড়ায় ভালো ছিলাম, আমার এই বেশ ভালো মানের শিক্ষার্থী হবার কারনে মায়ের ভিতর স্বপ্ন ও আশার সঞ্চার হয়েছিলো। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আমি তিনশত টাকা উপবৃত্তি পেতাম, সেই টাকা দিয়েই আমার শৈশবের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চাহিদাগুলো মেটানোর চেষ্টা করতাম যদিও তা অপর্যাপ্ত ছিলো। দরিদ্রতার অভিশাপের প্রতিটি ধাপের সাথে তখন থেকেই পরিচিতি ঘটায় আমি নিজেকে বিরূপ পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিয়েই লেখাপড়া চালিয়ে যাই। আমার মনে আছে এই সামান্য কয়টা টাকা দিয়েই আমি পোশাক, গাইড বই, স্যান্ডেল ইত্যাদি কেনার পাশাপাশি মাকেও সংসার খরচ দেয়ার চেষ্টা করতাম! এভাবেই আমার বাল্য জীবনের প্রাথমিক শিক্ষার পর্বটি শেষ করতে পেরেছিলাম, আমি জানি আমাদের মত দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের কাছে এই উপবৃত্তির মাত্র তিনশত টাকা কতটা মূল্যবান।
এরপর শুরু হয় আমার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়ার আরেক সংগ্রামী পর্ব যা আরো বেশি বৈচিত্র্যময়। আমার স্কুলটি ছিল আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় দুই কিলোমিটারের পথ, আজকাল মানুষ আধা কিলোমিটার পথ যেতেও যন্ত্র চালিত ভ্যান বা অটো ব্যবহার করে থাকে। হাইস্কুলে পড়াকালীন পাঁচ বছরের মধ্যে একটা দিনও আমার পক্ষে যাতায়াতের জন্য ভাড়া দিয়ে স্কুলে যাওয়া হয়নি। ঝড়, বৃষ্টি, রৌদ্র, তীব্র শীত যে পরিস্থিতি হোক পায়ে হেঁটে স্কুলে গিয়েছি আবার পায়ে হেঁটেই বাড়িতে ফিরেছি। টিফিনে বা ক্লাসের ফাঁকে স্কুলের ক্যান্টিনে বসে হালকা কিছু খাওয়ার ব্যাপারটি ছিলো আমার জন্য কল্পনার বিষয়! পরিবারের বেহাল আর্থিক দশা প্রত্যক্ষ করে আমি আমার উঠতি বয়সের শখ আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে অপূর্ণ ইচ্ছেগুলোকে টুঁটি চেপে ধরে মেরে ফেলার অভ্যাস গড়ে তুল্লাম।
আমি কখনোই টিউশনি পড়ার জন্য শিক্ষককে পুরো বেতন পরিশোধ করতে পারতাম না, স্যারকে আগেই বলে নিতাম আমার আর্থিক সমস্যার কথা। আমি সেইসব শিক্ষকদের অমায়িক আর দয়ালু ব্যাবহারের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি, তাঁরা আমাকে অর্ধেক বা নূন্যতম বেতন নিয়েই যত্ন করে পড়াতেন। অনেক স্যার আমাকে তাঁদের পাওয়া সৌজন্য সংখ্যার বইগুলো দিয়ে সহায়তা করতেন এবং উৎসাহিত করতেন জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবার সংগ্রাম চালিয়ে যেতে। শিক্ষকদের এই উৎসাহে আমার ভিতর জেগে উঠতো শিক্ষিত হয়ে বড় কিছু হবার তীব্র আকাঙ্ক্ষা, মায়ের কষ্টের ঋণ পরিশোধের প্রবল প্রচেষ্টা। বাধ্য হয়ে নানুর বাসায় চলে যেতে হয়েছিলো কিছুদিনের জন্য, আমি সে কারনে অষ্টম শ্রেনীর দুটো পাঠ্য বই সংগ্রহ করতে না পেরে বেশ অসুবিধায় পড়েছিলাম। আমার স্কুলের প্রধান শিক্ষককে বিষয়টি জানালে তিনি কোথা থেকে যেনো বই সংগ্রহ করে একদিন আমাকে ডাকালেন। সেদিন অনেকগুলো বাস্তবতার কথা বলে আমাকে সাহস দিয়েছিলেন তিনি, ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পাবার জন্য ভালো করে লেখাপড়া চালিয়ে যেতে উপদেশ দিলেন। দারিদ্রতার কারনে আমার জীবনের এমন হাজারো কষ্টের কথাগুলো ভাবতে ভাবতে টলমল চোখে ক্লাসে ঢুঁকে প্রতিজ্ঞা করলাম যে এই স্কুলে যদি একজনও ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পায় সে হবো আমি।
প্রধান শিক্ষকের অনুপ্রেরণায় আমি সেই শিক্ষার্থী যে আমার বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ের পর জেএসসি পরীক্ষায় প্রথম ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পাই এবং এসএসসি পরীক্ষাতে মানবিক বিভাগে গোল্ডেন জিপিএ গ্রেড অর্জন করতে সক্ষম হই। স্বাভাবিকভাবে আমার প্রতি আমার শিক্ষকদের প্রত্যাশা বেড়ে যায়, তাঁরা আমাকে শহরের কলেজে ভর্তি হবার জন্য পরামর্শ দেন। আসলে আমাদের নাজুক আর্থিক অবস্থার ভিতর এই ভাবনাটি ছিলো অলীক কল্পনার মতো। রংপুরের মতো বিভাগীয় শহরের সরকারি কলেজে পড়ার চিন্তা করাটা আমার জন্য বিলাসিতা ছাড়া আর কিছু নয়! সেই সময়ের মানসিক কষ্ট, দ্বিধা-দ্বন্দের মধ্যেই দারিদ্রতা জয় করা নিয়ে বিল গেটসের উপরোক্ত উক্তিটি কোথায় যেনো চোখে পড়ে বা মনে পড়ে যায়। অনিশ্চিত জেনেও আল্লাহর নাম নিয়ে অদম্য মনোবল আর সাহসে আমি রংপুরে সরকারি কলেজে ভর্তি হই।
শুরু হয় নতুন জীবন সংগ্রাম। পরিবার ছেড়ে অন্য একটি বিভাগীয় শহরে একা একা থাকার অভ্যাস তৈরি করা, পড়াশুনা চালিয়ে যাবার পাশাপাশি মাসের খরচ চালানোর নানামুখী চেষ্টা অব্যাহত রাখা। মাস শেষে বিশাল এক আর্থিক ধাক্কা সামলানোর জন্য তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করতাম কখন আসবে মায়ের পাঠানো লাকড়ি বিক্রির টাকা? উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের ঐ সময়ের কাঁটানো কঠিনতম মূহুর্তগুলো আমার কাছে ছিল বিষন্ন এক দূর্নিবীত যন্ত্রণার! এভাবে কি চলা যায়? আর কতোটা কষ্ট করতে হবে জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছাতে?
এমন দুরবস্থা ও অস্থিরতার মধ্যে এক বন্ধুর মাধ্যমে মরাল প্যারেন্টিং ট্রাস্ট সম্পর্কে জানতে পারি। এক বুক আশা নিয়ে খড়কুটো ধরে বেঁচে থাকার আশায় বৃত্তিটির জন্য আবেদন করি এবং আল্লাহর অশেষ রহমতে আমার মত হতভাগ্যের আবেদনটি অনুমোদিত হয়। দুই মাস অন্তর বৃত্তির টাকাটা হাতে পেতাম, তবে আগে থেকেই হিসাব করে রাখতাম পরের বারের টাকা পেয়ে কোন কোন খাতে খরচ করতে হবে। এই সামান্য বৃত্তি আর মরাল প্যারেন্টিং ট্রাষ্টের সাথে সংশ্লিষ্টদের উৎসাহ উদ্দীপনায় আস্তে আস্তে তীব্র অভাবের প্রতিকূলতা কাঁটতে আরম্ভ করলো আমার জীবনে। লেখাপড়ায় পূর্ণ মনযোগ দিলাম এবং এইচএসসিতেও গোল্ডেন জিপিএ অর্জন করতে সক্ষম হলাম। অনেকের দোয়া, আন্তরিকতা আর আমার মরাল প্যারেন্টকে পাশে পেয়ে আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেলো। আবারো এক বড় ভাই এর সহযোগিতা আর জমানো বৃত্তি থেকে পনেরো হাজার টাকা যোগাড় করে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিংয়ে ক্লাস শুরু করতে পারলাম।
আজ আমি নির্দিধায় বলতে পারি মরাল প্যারেন্টিং ট্রাস্ট আমার দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া স্বপ্নগুলো পুনরোজ্জীবিত করতে পাশে দাড়িয়েছে। আজ আমি একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করার সুযোগ পেয়েছি এবং ভবিষ্যতে আরো বড় স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে চলেছি। আমাদের প্রত্যন্ত এলাকায় কোন প্রথম শ্রেনীর সরকারি কর্মকর্তা নেই, আমার ইচ্ছে আমিই হবো সেই কর্মকর্তা। লেখাপড়া শেষ করে একজন বিসিএস ক্যাডার হয়ে আমার মায়ের জন্য গর্ব আর কষ্টের ফসল তুলে আনবো। আমি আমার মরাল প্যারেন্ট ইসতিয়াক হোসেন ও তাঁর পরিবারের প্রতি চির কৃতজ্ঞ থাকবো আজীবন। সেই সাথে মরাল প্যারেন্টিং এর আদর্শের সাথে আজীবন থাকতে চাই, এভাবেই অন্যের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে আলোকিত জীবন গঠনে সারথী হয়ে থাকবো।
Moral Parenting Trust
8/2 Indira Road, West Raja Bazar, Farmgate, Dhaka 1215
Permanent Address: Village – Sonakur, P.O. – Pulum, Thana – Shalikha, Magura
Email: moralparenting@gmail.com
Facebook Page: https://www.facebook.com/MoralParenting
সংকলন: দৈনিক আলোকবর্তিকা।
বোন তোমার সংগ্রামী চলার পথ হোক অগণিত মোরাল চাইল্ডদের স্বপ্ন পূরণের হাতিয়ার । শুভকামনা নিরন্তর ।