https://www.moralparenting.org/
মো: মাহমুদুল হাসান
- শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
আমি এখন পড়াশোনা করছি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনার সুযোগ পাওয়ার পথটা আমার জন্য মোটেই সহজ ছিল না। আজ এ পর্যন্ত আসার পিছনে রয়েছে আমার দৃঢ় আত্মবিশ্বাস। আমি ছোটবেলা থেকে পড়াশুনা করেছি নিজের চেষ্টায়, যেখানে আমার বাবা মা বেঁচে থেকেও তাদের আমি কখনো পাশে পাইনি। আমি যখন ছোট তখন থেকেই আমার মা মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে আমার নানু বাড়িতে থাকেন, বাবা ঢাকায় থাকতেন। আমি থাকতাম দাদির কাছে, পঞ্চম শ্রেনীতে পড়ার সময় আমার দাদিও মারা যান! তারপরে থেকে বড় হওয়া বড় আব্বু (চাচা) ও বড় আম্মার (চাচি) কাছে। বাবার সামর্থ্য ছিল না আমাকে লেখাপড়া করানোর জন্য টাকা খরচ করার, আমার বড় ভাই কিছু টিউশন করে টাকা দিতেন অনেক কষ্ট করে, এই টাকা দিয়েই আমার পড়াশুনা চলতে থাকে। আর বড় আব্বু ও বড় আম্মার ঘরেই আমার বড় হওয়া। এভাবে অভাব অনটনের মধ্য দিয়ে অনেক কষ্টে আল্লাহর রহমতে PSC, JSC, SSC পরীক্ষায় GPA. 5 (A+) পাই। তারপর ভর্তি হলাম কারমাইকেল কলেজ রংপুরে।
তখন মেসে থেকে পড়াশোনা করার জন্য যথেষ্ট টাকার সংস্থান ছিলো না, বাবা কোনভাবেই টাকা দিতে পারতেন না। আমার বড় ভাই অনেক কষ্টে আমাকে মাসিক ২৫০০ টাকা দিতেন, এর বেশি দিতে পারতেন না। অথচ আমার রংপুরে থাকার জন্য মাসে কমপক্ষে লাগতো ৪০০০ টাকা, তখন সেই বাকি টাকাটা নিজেকে যোগাড় করতে হতো বিভিন্নভাবে খেয়ে না খেয়ে। টাকা যোগাড় করতে গিয়ে অন্যদিকে সময় নষ্ট হওয়াতে লেখাপড়ার ক্ষতি হতো, নিজেকে নিয়ে খুবই অসহায় বোধ করতাম। আমি চাইতাম না কোনভাবেই আমার লেখাপড়ার ক্ষতি হোক, কিন্তু সবদিক রক্ষা করে কিভাবে লেখাপড়া চালিয়ে যাবো ও ভালো ফলাফল করবো সেই দুঃশ্চিন্তায় দিন কাটছিলো।
এমতাবস্থায়, আমি মরাল প্যারেন্টিং ট্রাস্ট সম্পর্কে জানতে পারি এবং বৃত্তির জন্য আবেদন করি। কোন দিশা না পেয়ে এই ট্রাস্টের বৃত্তিটা যেন পাই সেই প্রার্থনা করতে থাকি মনে মনে। আমার কলেজের স্বেচ্ছাসেবক শিক্ষকের প্রচেষ্টা আর আল্লাহর রহমতে আমার বৃত্তিটা অনুমোদন হয়ে যায়। আমি কলেজে পড়তাম সেজন্য আমার জন্য নির্ধারিত বৃত্তির পরিমান ছিল ১৪০০ টাকা, যা দুই মাস পর পর আমাকে পাঠানো হতো। ১৪০০ টাকা অনেকের কাছে খুব সামান্য হলেও আমার কাছে ছিল বিপুল শক্তির উৎস্য! বৃত্তির টাকাটা যখন হাতে পেতাম তখন মনের মধ্যে অন্যরকম এক সাহস ও প্রশান্তি অনুভব করতাম। এ টাকাটা না পেলে হয়তো আর রংপুরে থাকা হতো না। হয়তো তখন অন্য কোন বাড়তি কাজ করতে হতো, পড়াশোনা তখন এতো ভালোভাবে চালিয়ে যেতে পারতাম না।
যারা মরাল প্যারেন্টিং ট্রাস্ট সম্পর্কে অবগত নন তাঁদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি যে সমাজের কিছু আলোকিত মানুষ আছেন যারা নীরবে শুভ উদ্যোগের সাথে যুক্ত থেকে অন্ধকারে নিমজ্জিত অনেকের জীবনে আশার প্রদীপ জ্বেলে দিয়ে থাকেন। মরাল প্যারেন্টিং ট্রাস্ট এর সেই সকল নৈতিক অভিভাবকদের মধ্যে একজন আমার বৃত্তির দায়িত্ব নিয়েছেন, আমি তাঁর নিজের সন্তান না হয়েও প্রেরিত বৃত্তির টাকায় পিতৃ স্নেহ আর ভালোবাসার দিশা খুঁজে পেয়েছি। আমার বাবা আমাকে লেখাপড়ার জন্য টাকা দিতে না পারলেও যাকে চিনি না, জানি না এমন একজন হৃদয়বান মরাল প্যারেন্ট পেয়ে আমি নিজেকে ধন্য মনে করি এবং আমি তাঁর সন্তানতূল্য বিধায় সুযোগ পেলে আমিও এই সমাজের হতভাগ্য কারো দায়িত্ব নিয়ে এই অপরিশোধযোগ্য ঋণ কিছুটা হলেও পরিশোধের চেষ্টা করবো।
আর একটি কথা না বললেই নয়, আমার HSC পরীক্ষা শেষে আমি আমার মামার থেকে কিছু টাকা নিয়ে একটি কোচিং এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য কোচিং করছি। এমতাবস্থায়, আমার বড়ভাই যে আমাকে মাসিক ২৫০০ টাকা দিতেন সেটি ভাই এর পক্ষে আর দেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। তিনি আমাকে সোজা বলে দিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার আর কোন প্রয়োজন নেই, এখন নিজেই কিছু একটা কর। ভাইয়ের অপারগতার কথা শুনে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম! আমার এতো দিনের স্বপ্ন প্রায় তখনই শেষ হওয়ার পথে।
আমার কাছে তো রংপুর থাকার মতো কোন টাকা ছিল না ওই তিন-চার মাস যে থাকব, বিশ্ববিদ্যালয়ের ফর্ম তুলব, তার কোন উপায়ও ছিল না। আমি ভেবেছিলাম আমার পড়াশুনা তখন থেকেই বুঝি শেষ। দুরুদুরু বুকে আমি আমার এই সমস্যার কথা ই-মেইল করে মরাল প্যারেন্টিং ট্রাস্ট এর প্রতিষ্ঠাতা ডঃ মাহবুব স্যারকে অবগত করি। স্যার তা সঙ্গে সঙ্গে আমার মরাল প্যারেন্টস কে অবগত করেন, তারা সঙ্গে সঙ্গে আমাকে ফোন করেন এবং আমার সমস্যার সমাধান করে দেন। আমাকে কোন দুঃশ্চিন্তা না করে মন দিয়ে পড়াশোনা করতে বলেন। তাদের আন্তরিক সহযোগিতায় এবং আল্লাহর রহমতে আজ আমার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে, আমি এখন দেশের অন্যতম একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করার সুযোগ পেয়েছি।
তাই, আমার মতে মরাল প্যারেন্টিং একটি বৃত্তি প্রদানের মাধ্যমেই নয় শুধু, তারসঙ্গে একজন স্বপ্নবাজ শিক্ষার্থীর নৈতিক অবিভাবক। আমি মনে করি এখন আমার দুজন অভিভাবক, একজন আমার নৈতিক অভিভাবক যারা আমার সঙ্গে অতি বিনয়ের সঙ্গে কথা বলেন, আমার যে কোন সমস্যার সমাধান করে দেন। আমার বর্তমান সময়ে পড়াশোনা করা সম্ভব হচ্ছে আমার নৈতিক অভিভাবকদের কল্যানেই। এখন আমি বৃত্তি পাই ৩০০০ টাকা, আর একটা টিউশনি করি। এই সামান্য টাকা দিয়েই আমার ঢাকা শহরে থাকা এবং পড়াশোনার খরচ চালাই। সর্বোপরি বলতে হয় মরাল প্যারেন্টিং আমার জীবনে এক আশীর্বাদ স্বরূপ।
সংকলন: দৈনিক আলোকবর্তিকা।