আমি কাউকে দোষ দিতে চাই না। আমি আমার ব্যক্তিক রাস্ট্রীয় চরিত্রের বর্ণনা করলেই সবাই বুঝে নেবেন এই বাংলাদেশ গত চৌত্রিশ বছর ধরে কোন তরিকায় চলছে? আমার রাজনৈতিক জ্ঞান ১৯৮৯ সাল থেকে পরিস্ফুটিত হয়েছিলো, কারণ তার পূর্বে অজ পাড়াগাঁয়ে লেখাপড়া করেছি, সেখানে জাতীয় পত্রিকা কালে ভদ্রে হাতে পড়তো। দেশ ও জাতির খবরাখবর জানার একমাত্র মাধ্যম ছিলো রেডিও বাংলাদেশ অথবা বিবিসি বাংলা অথবা ভয়েস অফ আমেরিকা। একমাত্র রেডিও বাংলাদেশের সকাল সাতটার খবর ছাড়া নিয়মিত শোনাও হতো না অন্যসব রেডিওতে প্রচারিত খবরগুলো। আমাদের সময় ইরাক ইরান যুদ্ধ আর প্যালেস্টাইনে ইসরাইলীদের নৃশংস হত্যাযজ্ঞ এবং নেলসন ম্যান্ডেলা, ইয়াসির আরাফাত সহ রাশিয়া বনাম আমেরিকার শীতল যুদ্ধ এইসব খবরে উত্তাপ ছড়াতো। যদিও রেডিওতে নিয়মিত গান, নাটক, ফুটবল খেলার ধারাবিবরণী শোনা আমার অন্যতম প্রিয় শখ ছিলো স্কুল জীবনে।
গ্রামাঞ্চলে বাস করা আমার সমবয়সী অর্থাৎ পঞ্চাশের আশেপাশে বয়সীদের প্রাত্যহিক জীবনের বিনোদনের বড় একটা অংশই ছিলো ঐ রেডিও। তবে সেই সময়ের প্রেক্ষাপটেই হোক আর আগ্রহের বিকল্প বিভিন্ন কর্মকান্ডে (খেলাধুলা, সাংষ্কৃতিক জগত, আত্মীয় বাড়ি বেড়ানো ইত্যাদি) জড়িত থাকার কারনেই হোক রাজনীতি সচেতনতা একদমই ছিলো না আমার। জিয়া, মুজিব, হাসিনা, খালেদা এসব নামের ব্যাপারে স্পষ্ট কোন ধারণা না থাকলেও প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ধানের শীষ, নৌকা, লাঙ্গল, দাড়িপাল্লা আর হাফেজি হুজুরের বটগাছ মার্কার স্লোগান শুনেছি সেই প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও। আমার সক্রিয় মিছিল করার একমাত্র অভিজ্ঞতা ছিলো স্থানীয় সরকার নির্বাচনে মেম্বর বা চেয়ারম্যান প্রার্থীর প্রতীকের হয়ে। সেটাও কারো একজনের প্ররোচনায় বিস্কিটের লোভে, কোন ব্যক্তি বা মতাদর্শের পক্ষে নয়।
তাই দেশ ও রাজনীতি নিয়ে আমার আগ্রহের শুরুর দিকের কিছুটা ইতিহাস বর্ণনা করলেই আমার চরিত্র সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া সহজ হবে। আমি ১৯৮৯ সালে খুলনার নামকরা বিএল কলেজে ইন্টারমিডিয়েট বা এইচএসসি শ্রেণীতে ভর্তি হই, আমার পাশের সাল ছিলো ১৯৯১। এই সময়ের মধ্যে একটা বিরাট আন্দোলন সংগ্রামের ভিতর দিয়ে দেশের মানুষ এরশাদ সরকারের ৯ বছরের কথিত স্বৈরশাসনের কবল থেকে মুক্ত হয়েছিলো। অভূতপূর্ব এক ঐক্য গড়ে উঠেছিলো সবগুলো রাজনৈতিক দলের মধ্যে। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবগুলো ছাত্র সংগঠন একত্রিত হয়ে তীব্র গণআন্দোলন সৃষ্টি করে স্বৈরাচার এরশাদের পতন ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলো। আসলে সেই প্রেক্ষাপট থেকেই আমি অধিকাংশ রাজনৈতিক জ্ঞান আহরণের সুযোগ পেয়েছিলাম তৎকালীন বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক, সাপ্তাহিক ও পাক্ষিক পত্রিকার মাধ্যমে।
এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের পুরোটা সময় জুড়ে এরশাদের দূর্নীতি ও কূকর্মগুলো নিয়ে সোচ্চার থাকতে দেখেছি অধিকাংশ পত্রপত্রিকাগুলোকে। কিন্তু আমার ব্যক্তিগত পছন্দের তালিকায় প্রথম ছিলো দৈনিক ইনকিলাব এবং দ্বিতীয় পছন্দের তালিকায় ছিলো দৈনিক আজকের কাগজ। মনে আছে এই দুই পত্রিকায় লেখা প্রতিটি অক্ষর গোগ্রাসে গিলতাম আমি, বিশেষ করে রাজনৈতিক বিশ্লেষণধর্মী লেখাগুলো বাদ দিতাম না একটা লাইনও। পুরোনো সংখ্যাও হাতে পড়লে পুরো ষোল পাতাই পড়তাম খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে।
আবার অন্য একটা দিকও রাজনীতির প্রতি আগ্রহী করে তুলেছিলো আমাকে। আমি দ্বিধাহীনভাবেই বলতে চাই তৎকালীন বিএল কলেজে ইসলামী ছাত্র শিবিরের ছাত্র নেতাদের খুবই আন্তরিক ব্যবহার, শিবির সভাপতির অতুলনীয় বক্তৃতা, ছাত্রদের দাবী দাওয়ার ব্যাপারে তাদের কর্মতৎপরতার কারনে আমি বিএল কলেজ শাখার শিবিরের সমর্থক ছিলাম! যদিও রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামী ছাত্র শিবির তখন রগ কাঁটা বাহিনী হিসেবে আভির্ভূত হয়েছিলো। যেহেতু বিএল কলেজে পড়তাম, তাদের ব্যবহার প্রত্যক্ষ করতাম এবং ছাত্রদল বা ছাত্রলীগের নেতাদের চালচলনে বিনয়ের ঘাটতি দেখতাম। সেই হিসেবে ছাত্রমৈত্রী ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতাদের ভালো লাগতো, যদিও তাদের সমর্থক খুবই কম চোখে পড়তো। একবার কলেজের সাধারণ শিক্ষার্থীদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট আন্দোলনে শিবিরের মিছিলেও শরিক হয়েছিলাম, যদিও নারায়ে তকবীর আল্লাহু আকবর ছাড়া বাকী শ্লোগানের সাথে কন্ঠ মিলিয়ে কলেজ প্রদক্ষিণ করেছিলাম।
আমি খুব স্পষ্টভাবেই মনে করতে পারি জীবনে ঐ একবারই বাংলাদেশের কোন ছাত্র সংগঠনের মিছিলে শামিল হয়েছিলাম। এরপর স্নাতক পর্যায়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করার সুবাদে কোন রাজনীতির সাথে যুক্ত হবার সুযোগ পাইনি বা ইচ্ছেও করেনি তবে রাজনৈতিক মতবাদ স্পষ্ট হয়ে গেছে ততদিনে। বিরাট এক আশাবাদ তৈরি হয়েছিলো বাংলাদেশে পিওর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে এরশাদ সরকারের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটিয়ে। বিশেষ করে আগামী বাংলাদেশে শাসন ব্যবস্থা নিয়ে তিন জোটের রূপরেখা আমাদের সময়ের তরুনদের উজ্জীবিত করে তোলে।
কি ছিলো সেই রূপরেখায়? সারসংক্ষেপ একটু দেখে নিই-
১. হত্যা, ক্যু, চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের ধারায় প্রতিষ্ঠিত স্বৈরাচারী এরশাদ ও তার সরকারের শাসনের কবল থেকে দেশকে মুক্ত করে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারায় দেশে পূর্ণ গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠাকল্পে :
ক. সাংবিধানিক ধারা অব্যাহত রেখে সংবিধানের সংশ্লিষ্ট বিধান অনুযায়ী তথা সংবিধানের ৫১ অনুচ্ছেদের (ক) ৩ ধারা এবং ৫৫ অনুচ্ছেদের (ক) ১ ধারা এবং ৫১ অনুচ্ছেদের ৩ নং ধারা অনুসারে এরশাদ ও তার সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করে স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী আন্দোলনরত তিন জোটের নিকট গ্রহণযোগ্য একজন নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ ব্যক্তিকে উপরাষ্ট্রপতির নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন।
খ. এই পদ্ধতিতে উক্ত ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে একটি অন্তর্বতীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে, যার মূল দায়িত্ব হবে তিন মাসের মধ্যে একটি সার্বভৌম জাতীয় সংসদের অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করা।
২. ক. তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ হবেন অর্থাৎ তিনি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কোনো রাজনৈতিক দলের অনুসারী বা দলের সাথে সম্পৃক্ত হবেন না অর্থাৎ তিনি রাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতি বা সংসদ সদস্য পদের জন্য নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করবেন না। তার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো মন্ত্রী নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করবে না।
খ. অন্তর্বতীকালীন এই সরকার শুধুমাত্র প্রশাসনের দৈনন্দিন নিয়মিত কার্যক্রম পরিচালনাসহ অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন ও নির্বাচন কমিশনের কার্যক্রম ও দায়িত্ব পুনর্বিন্যাস করবেন।
গ. ভোটারগণ যাতে করে নিজ ইচ্ছা ও বিবেক অনুযায়ী প্রভাবমুক্ত ও স্বাধীনভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে, সেই আস্থা পুন:স্থাপন এবং তার নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে।
ঘ. গণপ্রচার মাধ্যমকে পরিপূর্ণভাবে নিরপেক্ষ রাখার উদ্দেশ্যে রেডিও-টেলিভিশনসহ সকল রাষ্ট্রীয় প্রচার মাধ্যমকে স্বাধীন ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থায় পরিণত করতে হবে এবং নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী সকল রাজনৈতিক দলের প্রচার-প্রচারণার অবাধ সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।
৩. অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধামে নির্বাচিত সার্বভৌম সংসদের নিকট অন্তর্বতীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন এবং এই সংসদের জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকবে।
৪. ক. জনগণের সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতির ভিত্তিতে দেশে সাংবিধানিক শাসনের ধারা নিরঙ্কুশ ও অব্যাহত রাখা হবে এবং অসাংবিধানিক যে কোনো পন্থায় ক্ষমতা দখলের প্রতিরোধ করা হবে। নির্বাচন ব্যতীত অসাংবিধানিক বা সংবিধানবহির্ভূত কোনো পন্থায়, কোনো অজুহাতে নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা যাবে না।
খ. জনগণের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষ এবং আইনের শাসন নিশ্চিত করা হবে।
গ. মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী সকল আইন বাতিল করা হবে।
(চলবে)
লেখা: পল্লব খন্দকার
সত্ত্ব: দৈনিক আলোকবর্তিকা।
Leave a Reply